সোভিয়েত নারীর দেশে-২৭

8 March 2সুপ্রীতি ধর: এই সেইদিনই বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে গেল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বেশ ঘটা করেই এখন দিনটি পালন করা হয়। কর্পোরেট সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে দিনটি। জাতিসংঘ মহাসচিব দিবসটি উপলক্ষে বাণী দেন, সেই বাণী অনুসারে দিনটি পালিত হয় পুঁজিবাদের বিশ্বে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোরও এ উপলক্ষে বেশ ভাল অংকের একটা বাজেট থাকে, কাজেই খরচ তাদের দেখাতেই হয় বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের নামে। সকলে পার্পল কালারের পোশাক পরে নেচে-গেয়ে, বেশ আনন্দের সাথে দিনটি ‘উদযাপন’ করেন। কিন্তু দিনটি কী আসলেই উদযাপনের? এর পিছনে তো একটি রক্তাক্ত ইতিহাস। তা মেনে নিলে দিনটির রং হওয়া উচিত লাল, মোটেও তা পার্পল বা বেগুনি নয়।

অনেকদিন হয়ে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে এসেছি। প্রথম যেবার গেলাম দেশটাতে, বয়স অনেক কম। নারী অধিকার, নারী আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, কাস্তে-হাতুড়ের সাথে পরিচয় যদিও হয়ে গেছে ততদিনে, তারপরও নারীর অবস্থান, নারীর সম-অধিকারের বিষয়টি তখনও স্পষ্ট ছিল না। মহিলা পরিষদের বিভিন্ন মিটিংয়ে গিয়ে পিছনে বসে শুনতাম নারী নেত্রীদের কথা, খুবই উৎসাহব্যাঞ্জক মনে হতো। ভিতরে একটা শিহরণ অনুভব করতাম, শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যেত ঠিকই। কিন্তু এই আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন তখনও দেখে উঠিনি।

১৯৮৬ সালে সোভিয়েতে পা দিয়েই বুঝলাম এ এক অন্য ভূ-স্বর্গে আমার পদার্পণ। যেখানে মেয়ে হিসেবে আমি  বুক চিতিয়ে চলা অন্য এক মানুষ। প্রথম দুদিনেই বড় ভাইদের প্রতি আমার প্রশ্ন ছিল, ‘এই দেশের পুরুষরা কোথায়? ওরা কি করে?’ ট্রামে-বাসে-ট্রলি-দোকানে-মেট্রোতে সব জায়গায় মেয়েদের রাজত্ব। ইয়া মোটাসোটা আকারের ‘খালাবয়সী’ নারীরা সরকারি প্রায় সব বাহনের চালক, দোকানের ক্যাশে কেবলই মেয়েরা, বেচাকেনার কাউন্টারেও মেয়েরা, মাংস দমাদম কেটে মেয়েরাই দিচ্ছে। রাস্তাঘাটেও দেখি মেয়েদেরই চলাচল। তাহলে কি মেয়ের সংখ্যা বেশি এই দেশে? নাকি তারা দৃশ্যমান আর পুরুষরা অদৃশ্য?

বড় এক ভাই জানালেন, এইদেশের পুরুষদের একটি বড় অংশ সামরিক বাহিনীতে, আরেকটি বড় অংশ মাইন বা খনিতে। অন্যান্য সেক্টরেও আছে, তবে আনুপাতিক সংখ্যায় কম। প্রথম বছরে আমাকে পাঠানো হয় আরমেনিয়ার রাজধানী ইরেভানে। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল, না গরম, না ঠাণ্ডা। স্কার্ট পড়ে রাস্তায় বাচ্চাদের মতোন দৌড়াই, কেউ কিছু বলার নেই, আইসক্রিম খেতে খেতে নাকে-মুখে মাখাই, হাতের পিঠ দিয়ে নিজেই মুছি। যেন বয়স কমে ৮ কি ৯ এ ঠেকেছে।

নতুন দেশ, নতুন ভাষা, নতুন সংস্কৃতি, নতুন রাজনীতিরও দেশ। দেশে থাকতে ছাত্র ইউনিয়নের মিটিংয়ে যেতাম, মহিলা পরিষদের মিটিংয়ে-সভায় যেতাম, করতাম আবৃত্তি সংগঠন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের টগবগে রক্ত সেই নতুন পরিবেশে গিয়ে যেন ঝিমুতে ঝিমুতে ঘুমিয়েই গেল। সেই যে ঘুমালো, এখনও ঘোরের মধ্যেই আছি। সোভিয়েত নামক ঘোর। এখন মাঝে মাঝে সেই ঘোর কাটে ঠিকই, কিন্তু সমমনাদের হারিয়ে ফেলায় আবার ফিরতে হয় নিজের ভেতরেই।

ইরেভানে যাওয়ার কদিন পর মনে হলো, এই যে রাস্তাঘাটে হাঁটি-চলি-ফিরি, কই, কোথাও কোন নারীকে ঝগড়া করতে শুনি না। কেন? কোন বাড়ি থেকে ভুল করেও ঝগড়ার আওয়াজ আসে না কেন? বাংলাদেশি মানুষ আমি, সকাল-রাত ঝগড়া শুনে শুনেই তো বড় হওয়া। আবারও বড় এক ভাইয়ের দ্বারস্থ হই প্রশ্ন নিয়ে। উনি তখন জানালেন, এইদেশে মেয়েদেরই আধিপত্য, মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম করে, তাদের মূল্য অনেক, যেমন পরিবারে, তেমনি সমাজেও। নিজের চোখেই তার প্রমাণ মেলে।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এতো সুযোগ-সুবিধা, আর তার সিংহভাগই মেয়েদের জন্য। শিশু এবং বয়োবৃদ্ধদের জন্যও তেমনই। হাটে-ঘাটে-বাসে, চলাফেরায়, উঠতে-বসতে মেয়েদের সম্মান দেয় এই জাতি। ছোটবেলা থেকেই একটি শিশুকে বড় করা হয় এসব শিক্ষা দিয়ে। ছেলেশিশুদের আলাদা করে শেখানো হয় মায়ের প্রতি, বোনের প্রতি, মেয়েদের প্রতি তাদের আচরণ কি হবে। একটা রাজনৈতিক কাঠামো যে মানুষের লালনে-পালনে কত-বড় ভূমিকা রাখে তা এই দেশে না গেলে বুঝতেই পারতাম না।

কোনদিন ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বাসে উঠে জায়গা পাইনি, এমন কমই হয়েছে। এক্ষেত্রে তরুণ ছেলেরা উঠে জায়গা দিয়েছে। আর বয়োজ্যেষ্ঠ, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, শিশুসহ নারী বা গর্ভবতী নারীর বেলায় তো কথাই নেই। যে কেউ উঠে জায়গা করে দেবে, বাসে তাদেরকেই হাত ধরে তুলতে সাহায্য করবে। তাইতো একা একা সন্তানের মা হওয়া, সেই মেয়েকে বড় করতে গিয়ে আমার কোনদিন কোন অসুবিধাই পোহাতে হয়নি। ১৬ দিন বয়সী মেয়েকে নিয়ে সেই যে বেরিয়েছিলাম, প্রতিদিন, প্রতিরাতে সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়িয়েছি, বন্ধুরা হাত বাড়িয়েই রেখেছিল সবসময়, আফ্রিকান বলেন আর পাকিস্তানি বা লাতিন আমেরিকানই বলেন, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবাই আমার পাশে ছিল তখন, কখনও কোন একাকিত্ব আমায় পেতে পারেনি। কখনও খাবারের অভাব হয়নি। নিজে যেচে এসে বন্ধুরা রান্না করে দিয়ে গেছে। ছেলেরাই বেশি করেছে। এসব কী একদিন ৮ই মার্চের জন্য তোলা ছিল? থাকেনি। সোভিয়েত জীবনে প্রতিটি দিন আমাদের ৮ই মার্চ ছিল।

সেই দেশটিতে ঘটা করে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন হলেও মূলত বছরভরই ছিল নারী দিবস। হয়তো দিনটিতে একটু বেশি ফুল পেতাম বা গিফট পেতাম, শুভেচ্ছা পেতাম। কিন্তু বছরের প্রতিটি দিনই ভোগ করতাম নারী হয়ে জন্মানোর সুখ। যে গায়ের রংয়ের জন্য নিজের পরিবারেও উচ্ছিষ্ট ছিলাম, সেই রং কখনই আমার ফেয়ার এন্ড লাভলির মোড়কে ঢাকতে হয়নি সোভিয়েতে।

নারী বন্দনা পৃথিবীর সব সাহিত্যেই আছে তুলনামূলক কমবেশি। রবীন্দ্রনাথে যেমন আছে, তেমনি আছে পৃথিবীর অপর প্রান্তের লেখকের লেখাতেও। সোভিয়েত রাশিয়ায় পুশকিন থেকে শুরু করে আধুনিক লেখকদের লেখাতেও যেভাবে নারীকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যেভাবে তাদের জয়গান গাওয়া হয়েছে, এমনকি শিল্পকলাতেও নারীর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, প্রকৃতি আর নারীর মিশেল যেভাবে ঘটানো হয়েছে, তাতে একটা সমাজব্যবস্থা মানুষের মননে-চেতনায়-শিক্ষায় কি ধরনের প্রভাব ফেলে, তারই বহি:প্রকাশ মাত্র। তাই তো বলি, সবদিক দিয়ে ‘জয়তু নারী’ শব্দটি হয়তো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই খাটে, যেখানে নারীকে বছরের একদিন নয়, সারা বছর সম্মান দেখানো হয় যেমন ঘরে, তেমনি বাইরেও। নারী সেখানে শুধু একজন মা-ই নন, সকল অনুপ্রেরণার উৎসও। (চলবে)

শেয়ার করুন: