পুরুষ দিবস পালনই বা নয় কেন?

8 March 4গীতি আরা নাসরীন: নারী দিবস এলেই, প্রায়ই এই প্রশ্ন শুনি – শুধু ‘নারী দিবস’ থাকবে কেন? ‘পুরুষ দিবস’ নেই কেন? বিভিন্ন ভাবে উত্তরও দিয়ে আসছি অনেক দিন ধরে।

বাংলাদেশে কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় দিবস উদযাপিত হয়। এর মধ্যে বিশ্ব জলাভূমি দিবস থেকে শুরু করে, একুশে ফেব্রুয়ারী থেকে যার শুরু সেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বিশ্ব পানি দিবস, স্বাস্থ্য দিবস, প্রবীণ দিবস, যুবা দিবস, ধাত্রী দিবস ইত্যাদি নানা উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত দিবস রয়েছে। প্রত্যেকটি দিবসের নিজস্ব ইতিহাস, উদ্দেশ্য এবং কার্যক্রম থাকে। অন্য কোন দিবস পালনের ক্ষেত্রে অবশ্য আমি কখনো একথা শুনিনি যে, দিবস পালন করার মাধ্যমে দিবসটি যে জনগোষ্ঠীর জন্য নিবদ্ধ তাদের বরং অবমাননা করা হয়, কিম্বা নেতিবাচকভাবে আলাদা করে দেখা হয়।

নারী দিবস থাকবে কেন – এটি বলার মধ্যে দিয়ে নারী দিবসের ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে অসচেতনতা যেমন প্রকাশ পায়; তেমনি বোঝা যায়, নারীর জন্য একটি আলাদা দিবস থাকাটাও একটি গাত্রদাহের কারণ।

যেমন, সমান অধিকারের প্রসঙ্গ তুললেই, বহুবছর ধরে আমি এই বহুল ব্যবহৃত কথাটা শুনি – ‘তাহলে নারীর জন্য বাসে আলাদা সিট আছে কেন’? জনসংখ্যার অর্ধেকের জন্য বাসে শুধু পাঁচটা সিট দেওয়া, এবং এখানে নারী অনেকসময় বসার সুযোগ না পেলেও, এর সঙ্গে যারা সমানাধিকার চাওয়ার মধ্যে সমস্যা দেখেন: তাদের কখনো পথে-ঘাটে, বাসে চড়লে বা হেঁটে গেলেও যে নারী যৌন নিপীড়নের শিকার, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখি না। সম্পত্তি, মজুরীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুধু পুরুষ বলেই পুরুষ প্রজাতি সামাজিক এবং আইনগতভাবে বেশি নেন কেন, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখি না। বাসে ‘মহিলা সিট’ই শুধু তাদের কাছে নারীকে অনেক দিয়ে দেওয়ার প্রমাণ।

আপনারা অনেকেই জানেন, রাজনৈতিক ইতিহাসে নারী দিবস এসেছে ১৯০৮ সালের নারী পোষাকনির্মান শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী এবং অতিরিক্ত কর্মঘন্টার বিরুদ্ধে ধর্মঘটের দিনটিকে ভিত্তি করে। নারীর অতিরিক্ত কর্মঘন্টার অবসান হয়নি, ন্যায্য মজুরীও নিশ্চিত হয়নি, কিন্তু দিবসটি তারপরেও অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়াটা বৈষম্য বিষয়েই অসচেতনতার প্রমাণ। ১৯১০ সালে ডেনমার্কে দ্বিতীয় সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশন্যালের আগে এক মিটিংয়ে নারীর অধিকার সচেতনতার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিবসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন – জার্মান সমাজতন্ত্রী লুইস জিৎয, আর এর সমর্থন করেন ক্লারা জেটকিন।

ইউরোপের কয়েকটি দেশে এ দিবসটির উদযাপন শুরু হয়। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সেই দেশগুলির নারী অধিকারের দাবি প্রকাশের দিন হিসেবেই এই দিবসটি যুক্ত হয়। কিন্তু আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও এতটা ব্যাপকভাবে এই দিবস উদযাপন হতো না। জাতিসঙ্ঘ ১৯৭৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস এবং বর্ষ উদযাপন শুরু করার পর থেকেই দিবসটি ক্রমাগতভাবে বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হওয়া শুরু হয়। সুতরাং ‘নারী দিবস’ কোনো কুড়িয়ে পাওয়া চৌদ্দআনা কিম্বা নাম-সর্বস্ব দিবস নয়। যদি নাম-সর্বস্ব করে তোলা হয়, তবে তার পেছনের রাজনীতিকেও খতিয়ে দেখতে হবে।

নারী দিবসের বাণিজ্যিক ব্যবহারও হয়। নারীর কাছে প্রসাধনী এবং অন্যান্য পণ্য বিক্রি করার জন্য, ভোক্তা সমাজে দিবসটি একটি প্রমোশনাল দিবস হিসেবে বিবেচিত হয়। কেউ কেউ নারী জীবনের কাঠামোগত বৈষম্য জারি রেখেই নারী দিবস উদযাপন করতে চান। হয়তো একারনেই অনেকের কাছে নারী দিবসটিকে খেলো মনে হয়।

কিন্তু নারী দিবসের প্রয়োজন ফুরোবে না, যতদিন বৈষম্য থাকবে। আবার বৈষম্য দূর হওয়ার পরও আমার মনে হয়, মানুষ নারীর দীর্ঘ সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে এই দিবসের কথা মনে করে যাবে।

শুধু ঠাট্টা-মশকরা করে নয়, পুরুষের বর্তমান ভূমিকা পরিবর্তনের জন্য কেউ যদি একটি পুরুষ দিবস থাকার দাবি তোলেন, আমি তাকে সমর্থন করবো। এই নোট লিখতে লিখতেই তাহমিনা রহমান ১৯ নভেম্বর যে একটি পুরুষ দিবসও ঘোষিত আছে, সেই তথ্য দিলেন। ১৯৯২ সালে এর শুরু এবং পৃথিবীর ৭০টি দেশে এটি পালিত হয়। সেই পুরুষ দিবস নিয়ে কোন সাড়া-শব্দ কখনো শুনি না।

নারীবাদী চিন্তাধারা সমাজে নারী-পুরুষের ভিন্ন অবস্থান এবং বৈষম্য তুলে ধরে, পুরুষকেও কিন্তু নিজের  অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করবার সুযোগ করে দিয়েছে। পুরুষ-প্রধান যে চিন্তাধারায় সমাজ পরিচালিত হয়, তা পুরুষকেও মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে দেয় না। নারীর জন্য কোটা থাকবে কেন, কিম্বা সংরক্ষিত আসন থাকবে কেন, এই প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কিন্তু তার সাথে তো এই প্রশ্নও ওঠাতে হবে, পুরুষ জন্মগতভাবেই পুরুষ-কোটা-ভুক্তির সুবিধা লাভ করবেন কেন? ঠিক কি কারণে একজন পুরুষ-সন্তান খাদ্য-শিক্ষা-সুযোগ-সম্পত্তি বেশি পাবে? কেন তাকে শেখানো হবে, নারী তার অধস্তন, কিম্বা নারীকে নির্যাতন করা যায়? কেন পুরুষ যে কাজটি করবেন তার মূল্যায়ন হবে, আর নারীর শ্রম অবমূল্যায়িত কিম্বা মূল্যহীন হবে।

নারীকে মানুষ বলে মনে করা হয় না। কিন্তু পুরুষরা কি মানুষ হয়ে উঠতে পারেন? কেন যেন-তেন-প্রকারণে ক্ষমতাবান কিম্বা সম্পদশালী হয়ে উঠতে পারলেই তিনি শুধু সমাজের কাছে গুরুত্ব পান? কেন শারীরিক বলপ্রয়োগকে মনে করা হয় পুরুষালী? কেন ছেলে-শিশু ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধকে চাপা দিয়ে রাখেন, ধর্ষিত হওয়াকে পরাজিত হওয়া ভেবে? কেন পুরুষত্ত্ব অর্থ ভোগ-দখল? কেন সারাজীবন “সত্যিকারের পুরুষ” হবার মিথের কাছে পরাজিত বোধ করে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকেন?

নারী যেভাবে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে যাচ্ছে, আপনার মানুষ হবার সংগ্রামে আপনিও নামছেন না কেন প্রিয় পুরুষ?

শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে দেখুন:
http://en.wikipedia.org/wiki/International_Men%27s_Day
http://www.independent.co.uk/news/uk/home-news/yes-there-is-an-international-mens-day-too-10093903.html

 

শেয়ার করুন: