যে তোমায় ভোলে ভুলুক, আমি তোমায় ভুলবো না

Taslimaইশরাত জাহান ঊর্মি: এই বেলা স্বীকার করে নেয়া ভালো। কে জানে আর বলার সুযোগ পাই না পাই। আচ্ছা তসলিমা নাসরিন কে আমি খুব পছন্দ করি-এই কথা খুব সাহস করে এই সময়ে আর কেউ বলে? তসলিমা নাসরিন অশ্নীল, শুধু শোয়াশুয়ির কথা বলে, ধর্ম নিয়ে তিনি যা বলেন তা অকথ্য…এই কথাগুলির সাথে আমি এখন কম-বেশি একমত। আমার এখন এও মনে হয়, তিনি মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ…কিন্তু আজ থেকে ২২বছর আগে…

জানিনা কেন, এত কিছু ভুলে গেছি, এত কিছু ভুলে যাই, কিন্তু ঐ দিনটি পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে পড়ে। বালিয়াকান্দিতে আব্বুর বইয়ের লাইব্রেরি। ফরিদপুরে মোকাম করতে যান তিনি। সেবার আমি সাথে গেলাম চোখের ডাক্তার দেখাতে। কাজ শেষে ফরিদপুরের রহমানিয়া লাইব্রেরি। আব্বু লিস্ট মিলিয়ে বই বাঁধা-ছাদা করাচ্ছেন, আমি “গল্পের বই” কিনতে বাছাবাছি করছি। দোকানদার জোর করে গছিয়ে দিলেন নির্বাচিত কলাম। আমি খুবই বিরক্ত। ঐ দামে দুইটা উপন্যাস হয়। আর কলাম জিনিসটা কি, খায় না মাথায় দ্যায়? সংবাদ পত্রিকায় দেখেছি হৃৎকলমের টানে, সেরকম কিছু? কিন্তু বইয়ের প্রচ্ছদটা দারুণ। এক মহিলার কপালের অর্ধাংশ। সেখানে লেপ্টে যাওয়া টিপ।

দোকানী বললেন, এই বইটা পড়। ভারতে আনন্দ পুরষ্কার পাইছে, নতুন লেখিকা। আব্বুও বলল, হ্যাঁ নাও-নাও, গল্প-টল্প পড়া বাদ দিয়ে একটু শিক্ষামূলক কিছু পড় (আহারে বেচারা আমার আলাভোলা বাপটা, যদি জানতেন, খাল কেটে কি কুমির আনছেন তিনি…কি যে শিক্ষা পাবে তাঁর মেয়ে এক জনমের মতো…)

ফরিদপুর থেকে লোকাল বাসে বাড়ি ফিরছি। বাসের মধ্যেই পাতা উল্টাই। যখন বই থেকে মাথা তুলি তখনও বাস পোঁছায়নি গন্তব্যে। কিন্তু আমার কি হয়। হঠাৎই মনে হয়, আমি যেন কাউকে চিনি না। সবকিছু কেমন অচেনা লাগতে থাকে। এই যে লোকাল বাস, দ্রুত ধাবমান সবুজ গাছগুলি, মধুখালি চিনির কলের মধ্যের সাজানো-গোছানো রাস্তা, তারপরেই পুরোন সেই মঠটা, মঠ পার হলে জামালপুর, তারপরই তো বালিয়াকান্দি। এত চেনা রাস্তা, বাসের ভেতর অধিকাংশ পরিচিত মানুষ…কিন্তু আমি যেন কোন আগুন্তুক, আমি এসবের কিছু চিনি না। ক্লাশ এইট এ পড়া একটা মেয়ে, মাত্রই বছরখানেক আগে থেকে গিলে ফেলতে শিখছি কান্না, কেবলই বালিশে মুখ গুঁজে ভেতরে অতল জলের গান শোনা… তসলিমা নাসরিন নামে অচেনা-অজানা এক মহিলা বাচ্চা মেয়েটাকে অদ্ভুত এক অচেনা জগতে ধাক্কা দিয়ে ফেলেই যেন কোথায় হারিয়ে গেলেন। তখনও আমি সিমন দ্যা বুঁভ্যেয়ার এর নাম শুনিনি। ভার্জিনিয়া উলফ নামে কেউ একজন আছেন, তাও জানি না।

বিপ্লব কি দলবেঁধে মিছিল করে হয়? অথবা লাঠি নিয়ে মাথায় লাল ফেট্টি বেঁধে?

আমার মা মহিলা পরিষদ নামে একটা সংগঠন করতেন। সেই সংগঠনের কাজ ছিল স্বামী পরিত্যক্তাদের স্বামীর সাথে মিল-তাল করিয়ে দেওয়া। অথবা স্বামীকে নরমে-গরমে বুঝিয়ে এ্যাট লিস্ট বউটাকে যেন না পিটায় সেই অনুরোধ করা…আজ থেকে বাইশ বছর আগে, বাংলাদেশ তখনও এত বড়লোক হয়নি।

আমি কিন্তু রুখে দাঁড়ালাম। একা এবং কয়েকজন। স্কুলে দুই সঙ্গী ছিল আমার, ক্লাশের ফার্স্ট গার্ল রুবী আর সেকেন্ড গার্ল লীনা। ওদেরকে পড়তে দিলাম ‘নির্বাচিত কলাম’। অনেকটা নিষিদ্ধ রেড বুকের মতো।

আমরা তিনজন। বড়দের মুখে মুখে তর্ক করি। কেন, যে ব্যাটা পিটায় তার কাছেই আবার কেন পাঠাতে হবে নির্যাতিতাকে?

আমরা তিনজন, স্কুল থেকে ফেরার পথে শিস বাজানো ছেলেগুলোর সাথে ঝগড়া, তর্ক করি, আমরা বদলে যাচ্ছিলাম, আমরা খোলস ছেড়ে নতুন সাপ হচ্ছিলাম, আমরা ছোবল দেওয়া শিখছিলাম…ছোট্ট গ্রামে আমাদের বিশেষত: আমাকে নিয়ে রি রি পড়ে গেল। লীনার শিক্ষক মা লীনাকে আমার সাথে মিশতে মানা করে দিলেন, আম্মু আমাকে রীতিমতো বলতে শুরু করলেন, তোর মতো নির্লজ্জ মেয়ে কেমনে পেটে ধরছিলাম, আর এই হারামজাদী তসলিমা নাসরিনটা কে? তোরে ইঁচড়ে পাকা বানাচ্ছে…

আমি দাঁতে দাঁত চাপি। আর ঐ মহিলার আরও আরও বই জোগাড় করি। আমার বেহায়াপনা বেড়েই চলে।  কত কি শেখায় আমাকে ঐ মহিলা, কত কি ভাবায়! মথ থেকে প্রজাপতি হওয়ার যন্ত্রণা পোহাচ্ছি তখন। তারপর একদিন সেই কালো সন্ধ্যা এলো…থাক সেই গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।

অনেকদিন তার কোন বই পড়ি না। কমপক্ষে ১০ বছর তো হবেই! এর মধ্যে কত কি হলো। ইউরোপ, কলকাতা, হায়দরাবাদ-রাজনীতি। সেদিন তাঁর নির্বাসন বইটা পড়ছিলাম। খুব কাঁচা লেখা মনে হলো।  ভালো লাগেনি। কিন্তু কেন জানি না, আজ ৮ই মার্চ থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠছে। সকাল থেকেই কাজে-কর্মে ভুল হচ্ছে,  ভোরের কাগজের সাংবাদিক মন্টি আপা বলল, তোর হইছে কি? সাব্বীরের সাথে কথাই বলতে ইচ্ছা করছে না। দীর্ঘশ্বাসটা এখন কান্নায় বদলে যাচ্ছে। বানের মতো কান্না।

প্রিয় তসলিমা নাসরিন, আপনি আমার প্রিয় নন আর । এই বেলা স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি ঈর্ষা করি আপনার সাহসকে। নি:শঙ্ক চিত্তের চেয়ে বড় সম্পদ না কি নাই, কিন্তু আমার যে সাহস নাই, একটুও সাহস নাই। সাহস নাই বলেই এখন শাড়ি আর চুড়ি কিনে ঘর বোঝাই করি।

আপনি আমার কেউ হন না। তবু কেন আজ মনে হচ্ছে, আপনাকেই বলি,

সকাল তোমার সাথে আজ একজনমের কান্না কাঁদবো বলে এসেছি….

শেয়ার করুন: