উম্মে রায়হানা: জীবনে চলার পথে অনেক সময়ই ‘নিরপেক্ষ’ থাকা যায় না। কোন না কোন পক্ষ নিতেই হয়, নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে জানাতেই হয়। আবার ‘সাদা-কালো’ আর ‘ভালো-মন্দ’ বলে পরিষ্কার বিভাজনও সবসময় থাকে না। সাদা আর কালোর মাঝে অনেকটা ধুসর এলাকাও থাকে।
যে প্রসঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি তা একটু জটিল বলেই এতটা গৌরচন্দ্রিকা দিতে হলো।
কিছুদিন আগে অ্যানি আপা (নাসরিন সিরাজ) কখন নারীদের পক্ষে যাওয়া বিপদজনক – তাই নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত লেখা লেখেন। সেই লেখায় তিনি দেখান, ক্ষমতা কাঠামো নিজেই এত বেশি পুরুষতান্ত্রিক যে এই ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে নারী যখন ঢোকে, সে-ও একই আধিপত্যবাদী পৌরুষ হতে উদ্ভূত ক্ষমতা দেখায়। নারীর জন্য তা কোন সুফল বয়ে আনে না। অন্ধভাবে নারীর পক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়া তাই বিপদজনক।
উল্লেখ্য, এখানে নাসরিন সিরাজের লেখার মূলভাব নিজের মত করে লেখা হয়েছে। বোঝাবুঝিতে ভুলও থাকতে পারে।
সে যা-ই হোক, এরপর উইমেন চ্যাপ্টারে এই লেখার একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয়। বন্ধুপ্রতিম অগ্রজ সুপ্রীতি ধর সেই সমালোচনাটি শেয়ার করলে আমি তার নিচে একটি মন্তব্য লিখি।
মন্তব্যে নাসরিন সিরাজের কথার মূলভাব আমি যা বুঝেছি তার ব্যখ্যা নিজের মত করে দেওয়া ছাড়াও আর একটি কাজ করি- তা হচ্ছে- ঐ লেখার শুরুতে নারীর নামের সঙ্গে ‘পুরুষ অংশ’ জোড়া দেওয়া নিয়ে একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছিল, নাসরিন সিরাজের নামে তার পিতার নাম যুক্ত থাকা নিয়ে কথা উঠেছিল- তার প্রতিবাদ জানাই।
আগেই বলেছি, পক্ষ-বিপক্ষ চিহ্নিত করা যেমন জরুরি, বাইনারি অপজিশনে যাওয়ার আগে অন্যান্য বিষয়গুলো দেখাও জরুরি।
ব্যক্তিগতভাবে নামের সঙ্গে পিতা বা স্বামীর নাম যুক্ত করার পক্ষপাতী আমি নই। কিন্তু কেউ যদি করেন, তাকে শুধুমাত্র সেই কারণে খারিজ করে দেওয়া যায় না। বিশেষত কেউ ‘কী বলছেন’ তার সমালোচনা করতে গিয়ে তার পিতামাতা তাকে ‘কী নাম’ দিয়েছেন সে প্রসঙ্গে কথা বলার প্রশ্নই আসে না।
আমার কথাগুলো সুবিধাবাদী বলে মনে হতে পারে। মনে হতে পারে আমি জায়গা বুঝে যুক্তি সাজাচ্ছি। কিন্তু আমি নিজেকে দিয়েই চিন্তা করেছি। আমার নাম যদি উম্মে রায়হানা না হয়ে মুমু ইসলাম/রহমান/আহমেদ/গোমেজ/ ঘোষ/ সাহা /জিয়া শেখ/সিরাজ/আলি অর্থাৎ আমার পিতার নাম, পিতামহের নাম বা স্বামীর নাম জুড়ে দেওয়া কোন একটা নাম হতো তাহলে আমি কী করতাম?
কবিতা লেখার জন্যে অনেকে নাম বদলে ফেলেন। ইসলামিক বা সনাতনী নাম শিক্ষাসনদের জন্য তুলে রেখে সাহিত্য নাম নেন। এই ঐতিহ্য সাহিত্য জগতে পুরানো। ঐ সমালোচকের কথা শুনে মনে হওয়া স্বাভাবিক নারীবাদীদেরও তেমনি নামের সঙ্গে বাবা বা স্বামীর নাম থাকলে তা ছেটে ফেলে দিয়ে তারপর নারীপ্রশ্নে কথা বলতে হবে।

শুধু তিনিই নন। চারপাশে অনেক মানুষ আছেন যারা মনে করেন, নারীবাদীরা এমন হবেন, তেমন হবেন। অমন হতে পারবেন না , তেমনটা করতে পারবেন না ইত্যাদি।
এই ভুল বোঝাবুঝিগুলো সম্পর্কেই আজকের লেখা।
অনেকেই মনে করেন, নারীবাদীরা জীবনে কিছু না কিছু হারিয়ে নারীবাদী হন। তারা পিতার স্নেহ, ভাইয়ের আদর, প্রেমিকের সোহাগ থেকে বঞ্চিত বলেই চিৎকার করেন। এর চেয়েও ভয়াবহ ধারণা- তারা ডিভোর্স করেন, অ্যাবরশন করেন, তারা নেশা করেন, তারা প্যান্ট শার্ট পড়েন, চুল ছোট করে কাটেন ইত্যাদি।
নারীপ্রশ্নে কথা বলতে গিয়ে পুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করা বরং সহজ।
মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত ও গোঁয়ার পুরুষরা মনে করেন তাদের আশেপাশে চাকরি বাকরি করে বাসায় ফিরে রান্না করে টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেওয়া, সন্তানের হোম ওয়ার্ক করানো, শপিং, পার্লার, অফিস- সব কিছু ঠিকভাবে চালিয়ে যাওয়া সুপারওমেন নারীটিই পৃথিবীর নারী সমাজের প্রতিভূ। এত কিছু পেয়েও (বাবামা পড়ালেখা শিখিয়েছে, শ্বশুরবাড়ি চাকরি করতে দিচ্ছে, আর কী চাও?- এমন একটা ভাব) যে বা যারা অধিকারের জন্যে চিৎকার করে তারা আসলে সমস্যাজনক।
অনেকে মনে করেন, নারী প্রকৃতিগতভাবেই পিছিয়ে আছে, ফলে তারা কম পাবে- এটাই স্বাভাবিক। আবার অনেকে নিজের ভুল বুঝতেও পারেন। অনেকেই আমার সঙ্গে অনেক প্রসঙ্গেই তর্ক করে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন, অন্তত সে সময়ের জন্যে বলেছেন- আলোচ্য বিষয়টি নতুন করে ভাববেন। অনেক সংবেদনশীল পুরুষ বন্ধু আছেন- যারা ভুল ধরিয়ে দিলে খুশী হন। বলেন- “আমিও তো এই কাঠামোর বাইরে নই। তোদের কাছ থেকেই তো শিখবো।”
বরং অনেক আজব প্রতিক্রিয়া দেন নারীরা। অনেকে তো পুরুষের বৈরিতা শিকার করতে চান না, বাপ ভাইয়ের প্রসঙ্গ টানেন। পুরুষদের চেয়ে অনেক কম প্রিভিলেজ হয়েও অনেকে মনে করেন জেন্ডার ডেসক্রিমিনেশন নিয়ে কথা বললে হয়তো নিজের পরিবারকে ছোট করা হবে। পুরুষের পেশীশক্তি, আধিপত্য ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে বাপভাইয়ের স্নেহ বা প্রেমিকের সোহাগ মনে পড়ে যায়। উচ্চস্বরে বলেন- “ওরা কি পুরুষ নয়?”
পশ্চিমা সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজমের একটি শ্লোগান আমার ভীষণ পছন্দ। তা হচ্ছে ‘পার্সোনাল ইজ পলিটিক্যাল’- বিয়ে, ডিভোর্স, অ্যাবরশোন ইত্যাদি নিয়ে রাষ্ট্র ও ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলার সময় এই শ্লোগানের উদ্ভব হলেও – এটি এখনও প্রাসঙ্গিক। ব্যক্তিগত নিপীড়নের অভিজ্ঞতাকে রাজনৈতিক করে তোলাই নারীবাদের কাজ- এ কথা যেমন সত্য, নিজের সুবিধাভোগী অবস্থা ও অবস্থান দিয়ে পৃথিবীর সব নারীর পরিস্থিতি মাপা যায় না, নারীবাদের প্রয়োজনীয়তা খারিজ করা যায় না- সে কথাও একইভাবে সত্যি।
পুরুষতন্ত্র আর পুরুষ এক নয়, বাপভাই আর পুরুষ এক নয়, বন্ধু আর পুরুষ এক নয়, এই কথা এই ধরনের ধ্যানধারণা পোষণ করা নারীকে বোঝানো অনেক জটিল। পুরুষের আধিপত্য নিয়ে কথা বললে কেউ মনে করতে পারে, নারী অসুখী দাম্পত্যে আছে। এই যে সামাজিক স্টিগমার ভয়, এই ভয়ের উৎস অনুসন্ধান করার চেয়ে নারীবাদকে উড়িয়ে দেওয়া বরং সহজ।
আরও সহজ কাজ হচ্ছে ফতোয়া দেওয়া। তুমি নারীবাদী হয়ে এই করছ, ঐ করছ- ইত্যাদি বলা। যেমন কদিন আগেই, ‘আমি আমার শ্বশুরের অনুরোধে চুল লম্বা করতে চাই’ – শুনে একজন হা হা করে উঠলেন- এই তুই না নারীবাদী!
এ প্রসঙ্গে বলতে চাই, সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্যকে ক্রমাগত প্রশ্ন করেছি বলে বাবার স্নেহ, ভাইয়ের আদর, প্রেমিকের নিবেদন, স্বামীর যত্ন কোন অংশে কারো চেয়ে কম পাইনি।
কিন্তু এগুলো পেয়ে আমি ভুলে যাইনি যে, পৃথিবীতে এখনও ভাতের সঙ্গে পুড়ে মরে বৌ, যৌতুকের বলি হয় কিশোরী। এখনও পৃথিবীতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ধর্ষিত হয় পাঁচ থেকে ৫০ বছরের নারী। পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেও অর্ধেকের কিছু বেশি মজুরি পায় নারী শ্রমিক। এখনও সন্তানের অভিভাবকত্ব পায়না পেটে ধরা মা, পৃথিবীর মোট সম্পত্তির মাত্র এক শতাংশের মালিক সে।
অনেক অনেক পথ বাকি। এখনও।
প্রতি পদে পদে এ সমস্ত মোকাবেলা করতে হয় বলে এবং সুপ্রীতিদি ‘নারীর নামের পুরুষ অংশে’র বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার করে কথা বলতে প্রেরণা দিয়েছিলেন বলে এতদিনে লেখাটি দাঁড়ালো।
নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে পেরেছি কিনা জানি না। তাই আবারও বলছি- সমাজে প্রচলিত লৈঙ্গিক বৈষম্যকে চিহ্নিত করা, তাকে প্রশ্ন করা, চিৎকার করা তার পরিবর্তনে কাজ করে যাওয়া- সব মিলিয়ে নারীবাদী অবস্থান একটি দার্শনিক অবস্থান যা পুরুষাধিপত্যবাদী দর্শনকে, তার সর্বময়তাকে, সর্বব্যাপিতাকে প্রশ্ন করে, খারিজ করে, পরিবর্তন করে। নারীবাদ কোন ধর্ম নয়।