পেশাওয়ার হত্যাকাণ্ড: যে মায়ের সন্তান আর ফেরেনি

Pakistan Boy 3উইমেন চ্যাপ্টার: পাকিস্তানের পেশাওয়ারে যে স্কুলে গতমাসে বর্বর তালিবান হামলায় ১৪০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী নিহত হয়েছিলো সেই স্কুলটি আজ আবারও খুলেছে। সকাল থেকে সেখানে ফিরতে শুরু করেছে সেদিনের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শিক্ষার্থীরা। শুধু ফিরছে না ওই ১৪০ জন। তবে তাদের অনেকের মা আজ সন্তানের হয়ে স্কুলে এসেছেন, অন্য মায়েরা তখন তাদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে ভয়াবহ ওই হত্যাযজ্ঞ। নিন্দা আর সমালোচনার ঝড় উঠে বিশ্বব্যাপী। পাকিস্তান সরকারও সন্ত্রাস দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেয়, সন্ত্রাসীদের বিচারে সামরিক আদালত গঠনের ব্যাপারে সবগুলো রাজনৈতিক দল একমত হয়। মোটামুটিভাবে গত ১৬ ডিসেম্বরের এই নারকীয় ঘটনা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিতটাই নাড়িয়ে দেয়।

একজন মা, যিনি তার সন্তানকে সেদিন হারিয়েছেন, তিনি বলছিলেন তার জীবনটাই কেমন বদলে গেছে সেদিনের ঘটনার পর থেকে। তার পুরো মন জুড়ে রয়েছে ১৪ বছরের কিশোর আমিশ। মা সামিয়া সালমান প্রতিনিয়ত শক্তি সঞ্চয় করতে চাইছেন শুধুমাত্র বেঁচে থাকার আশায়। এটাও চান, এই হামলাই যেন শেষ হামলা হয়, পাকিস্তান যেন বদলে যায় এই ঘটনায়।

সামিয়া জানান, অন্যসব দিনের মতোই ছিল গত ১৬ ডিসেম্বরের দিনটি। তারা খুব ব্যস্ত ছিলেন বোনের বিয়ে, বিয়ের কেনাকাটা নিয়ে। তাই সকাল থেকে টেলিভিশন তার দেখা হয়ে উঠেনি। যখন এক কাজিন তাকে ফোন করে জানতে চাইলো আমিশ কোথায়, স্কুলে গেছে কিনা, তার গলার স্বর শুনেই বুঝে গিয়েছিলাম, কিছু একটা হয়েছে। কাজিনের কথায় টিভি অন করেই খবরটা পান তিনি। কিন্তু তার ধারণাতেও তখন তেমন কিছু ছিল না, ভেবেছিলেন হয়তো ওদের জিম্মি করে রাখা হয়েছে।

সামিয়া বলছিলেন, ‘সারাদিন ধরে আমিশকে আমরা খুঁজেছি, হাসপাতাল, স্কুলের পিছনের পার্ক, কাছের বাসাগুলো, সব জায়গায়। কিন্তু কোথাও তাকে পাইনি। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমার স্বামী আমাকে ফোন করে জানায়, মনটাকে শান্ত করো, আমি ওর শরীর বাসায় ফিরিয়ে আনছি’।

কিছুদিন আগেই আমিশ তার আঙ্গুলে ব্যথা পেয়েছিল, সেটা দেখেই তাকে সনাক্ত করা গেছে। তার হাতের তালুতে গানশটের কারণে বিশাল বড় গর্ত হয়ে ছিল। মুখটা ওরকমই ছিল, সেই চোখ, সেই নাক। একটি বুলেট ওর চোয়ালের ভিতর দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছিল।

সামিয়ার মনে হয়, সেদিন যদি ছেলেটা স্কুলে না যেত, তাহলেই তো সে বেঁচে যেত। বোনের বিয়ের কারণে সেদিন তিনি চাইছিলেন, আমিশ যাতে স্কুলে না যায়। কিন্তু পরবর্তীতে আরও ক্লাস মিস হবে ভেবে আমিশের বাবা বললেন, থাক, আজ যাক সে। জোর করে ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে তিনি পাঠিয়েছিলেন স্কুলে। দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে নাস্তা করতেও রাজী হচ্ছিল না আমিশ, কিন্তু মোটামুটি জোর করেই তাকে খাইয়ে স্কুলে পাঠানো হয়েছিল সেদিন। কে জানতো, আর কোনদিন ছেলেকে দেখতে পাবেন না সামিয়া? একথা মনে হলেই সামিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসে।

সামিয়ার ভাষায়, আমিশ খেলতে ভালবাসতো, আর ভালবাসতো অংক। পরিবারের সবার ভালবাসাও ছিল তার জন্যই। প্রতিবেশি শিশুদের নিয়ে প্রায়ই সে ঘুরে বেড়াতো। বড়দের সাথে ঘুরতে যেতো। ভালবাসতো শিকার করতে, আর গাড়ির প্রতি নেশা ছিল অদম্য। গত কয়েক বছরে আমিশ তার জীবনের সর্বোচ্চ যাপন করে গেছে।

একটু মনে করে সামিয়া বলেন, ‘আমিশ প্রায়ই আমার ঘরে এসে তার ইয়ারফোন আমার কানে লাগিয়ে বলতো, গানটা শোনো, জাস্ট ডোন্ট ক্রাই। আমার ভাল লাগতো না গানটা। কিন্তু এখন আমি সেই গানটাই শুনি, এবং বুঝতে চেষ্টা করি, আসলে এর মধ্য দিয়ে সে আমাকে কি বোঝাতে চেয়েছিল’।

আমিশের এক বন্ধু জানায়, সে আমিশকে স্কুল থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছিল, কিন্তু পরমূহূর্তেই সে থেমে যায় এবং আবার দৌড়ে স্কুলের ভিতরে ঢোকে। হতে পারে, সে কাউকে বাঁচাতেই এটা করেছিল। আমিশের একজন শিক্ষক জানান, সে অডিটোরিয়ামে ফেরত এসেছিল, আর সেখানেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার বাম পাশে নয়বার গুলি করা হয়। মাথা থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত। কি হচ্ছে এটা বোঝার জন্য নি:শ্বাস ফেলার সময়টুকুও পায়নি আমিশ।

সামিয়া বলছিলেন, ‘আমার কাছে ওরা জুতাটা রাখা আছে, যেখানে রক্তের দাগ লেগে আছে। কিন্তু আমি চাই না এই রক্ত বৃথা যাক, আমি পাকিস্তানের পরিবর্তন চাই’। ‘আমার ১০ বছরের আরেকটি ছেলে আছে, যে অন্য স্কুলে যায়, কিন্তু আমি আর তাকে স্কুলে দিতে চাই না। আমার মেয়েরাও আছে মেয়েদের সেকশনে, ওরা আর ফিরতে চায় না ক্লাসে’।

‘আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, আমিশ আছে, ও ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার চারপাশে, যখন একা থাকি, কিছুই ভাবতে পারি না, পাগল পাগল লাগে। তখন আমি আল্লাহর কাছে শক্তি দেয়ার জন্য প্রার্থনা করি’।

সব মায়েদের ধৈর্য ধরতে হবে, একথাও বলেন সামিয়া। তার আশা, সরকার পরিস্থিতি বিবেচনা করতে সক্ষম হবে। ‘আমরা যদি নিজেদের না শুধরাই, একে-অপরের দেখভাল না করি, তাহলে শত্রুপক্ষ সবসময়ই আমাদের টার্গেটের বিষয়বস্তু খুঁজে পাবে।

কর্তৃপক্ষ স্কুলের অধ্যক্ষকে বলা হয়েছে তারা যেন স্কুলের এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? তারা কি এখন বন্দুক দিয়ে আত্মরক্ষার কৌশল শেখাবে ছাত্রদের? বর্ণমালার পরিবর্তে কিভাবে ট্রিগার টিপতে হয়, তা শেখাবে?

সামিয়া বলেন, ‘আমাদের ছোটসময়ে এরকম হামলার কথা শুনিনি, কিন্তু এখনকার বাচ্চাদের গল্পের বিষয়ই হচ্ছে মৃত্যু’।

 

শেয়ার করুন: