কালো মেয়ের উপাখ্যান

Shanta
শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া:

টিভিতে, পত্রিকায়, বিলবোর্ডে রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে ফর্সা না হতে পারলে মনে হয় জীবনই বৃথা।

বাঙালির চিরাচরিত শ্যামবর্ণ আর চলবে না। এবার এদেশের নারী-পুরুষ উভয়কেই হতে হবে সাদা।না হলে না জুটবে চাকরি, না পাওয়া যাবে ভালোবাসা।বিশেষ করে নারীকে হতে হবে ফর্সা, আরও ফর্সা, আরও একটু ফর্সা।

কয়েক বছর আগে রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের নামে ত্বকের পক্ষে ক্ষতিকর প্রসাধনী বাজারে ছাড়ায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল একটি বেশ বড় প্রতিষ্ঠানকে। সে প্রতিষ্ঠানটি নিষিদ্ধ হলেও রঙ ফর্সাকারী ক্রিম বিক্রির ব্যবসা কিন্তু মোটেই থেমে নেই।বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন এর প্রকোপ বাড়ছে।বাজার ছেয়ে গেছে দেশি বিদেশি, চকবাজারি ক্রিমে। এগুলো মেখে কে কতদূর সাদা হচ্ছে তা জানি না তবে ত্বকের যে সাড়ে তেরটা বাজছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

গ্রামে বসবাসকারী আমার এক বন্ধু আরেক খবর জানালেন।মেয়ের বিয়ের আগে নাকি বাবা মায়েরাই চট জলদি রঙ ফর্সা করার ক্রিম কিনে আনছেন এবং মেয়েকে মাখাচ্ছেন। যাতে বিয়ের আগেই কালো মেয়ে ধবল রঙ ধারণ করে। তাতে যৌতুক কম দিতে হবে। কারণ কালো মেয়ের জন্য পাত্রকে মোটা অংকের টাকা যৌতুক দিতে হয় আর ফর্সা মেয়ের যেহেতু সুন্দরী বলে চাহিদা বেশি তাতে যৌতুকের অংক কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিন সপ্তাহ, চার সপ্তাহ, ছয় সপ্তাহে রঙ সাদা করার বিভিন্ন ক্রিম রয়েছে। এগুলোতে পারদ ও অন্যান্য এমন সব রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যাতে ত্বক সত্যিই সাদা হয়(সাময়িক ভাবে)। কিন্তু পরে ত্বকের ক্যান্সার যেমন হতে পারে, তেমনি হতে পারে অন্য চর্মরোগ।

কিন্তু প্রশ্ন হলো সাদা হওয়ার জন্য আমাদের এতো আকুলতা কেন? নৃতাত্ত্বিকভাবে আমরা মূলত অস্ট্রালয়েড। আমাদের গায়ের রঙ শ্যামলা। আমরা আফ্রিকার অধিবাসীদের মতো কৃষ্ণাঙ্গ নই। আবার ইউরোপবাসী বা ককেশীয়দের মতো শ্বেতাঙ্গ নই।চীন, জাপানের অধিবাসীদের মতো আমরা মঙ্গোলয়েড বা হলুদ ত্বকের অধিকারীও নই। এদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠির মানুষ এসেছে। কেউ এসেছে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে, কেউ এসেছে আমাদের দেশ দখল করে তাদের রাজ্য বিস্তার করতে, কেউ এসেছে দাস হয়ে, আবার কেউ এ‌সেছে লুট-তরাজ করতে এবং আমাদের দাস বানিয়ে অন্যত্র চালান দিতে।

আর্য, শক, দ্রাবিড়, হুন, চৈনিক, আরব, তুর্কি, পারসিক, পাঠান, কাবুলি, হাবসি, মঙ্গোল, মগ, হার্মাদ(পর্তুগিজ),বর্গি(মারাঠি),ইংরেজ-কত জাতি গোষ্ঠির মানুষই না এদেশে এসেছে। তারা আমাদের ধর্মান্তরিত করেছে, শাসন করেছে, শোষণ করেছে, লুটতরাজ চালিয়েছে, অনেক নারীকে বিয়ে করে এদেশে বসতি করেছে, আবার অনেক নারীকে ধর্ষণ করেছে।সাদা পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে যে সন্তানরা জন্ম নিয়েছে তাদের গায়ের রঙ হয়েছে কিছুটা সাদা।

বাংলার ইতিহাস বলে, আামরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাদাদের দ্বারা ঘৃণিত, পদদলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, লুণ্ঠিত, শোষিত ও শাসিত হয়েছি। আর্যরা আমাদের অনার্য, কালো বলে ঘৃণা করেছে। আমাদের ভাষাকে হেয় করেছে। সংস্কৃতকে দেবভাষা নাম দিয়ে আমাদের প্রচলিত ভাষাকে পাখির ভাষা বলে অবজ্ঞা করেছে। আমাদের সংখাগরিষ্ঠ জন যারা ছিল অনার্য, যারা শূদ্র, চণ্ডাল, মালো, কৈবর্ত, তাদের জন্য বেদপাঠ নিষিদ্ধ করে রেখেছে। শুধু উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণের অধিকার ছিল ব্রহ্মবিদ্যালাভের।প্রাকৃতজন ও তার ভাষা ছিল সংস্কৃতসেবীদের কাছে ঘৃণিত।

একইভাবে পাঠান, সুলতানি, মোগল, নবাবি আমলে দরবারের ভাষা হয়েছে ফার্সি। আমাদের পূজা-পার্বণ, লোকাচার ধর্মের দোহাই তুলে বেদায়েত বলা হয়েছে।

মগ,হার্মাদ,বর্গিরা এদেশের গ্রামে গঞ্জে, জনপদে হামলা করেছে, লুটতরাজ চালিয়েছে, বহু নারীকে ধর্ষণ করেছে, বহু মানুষকে দাস হিসেবে ধরে নিয়ে গেছে।

ভদ্রবেশী শিক্ষিত ইংরেজ, নীলকর কুঠিয়াল বর্বর ইংরেজ, গোরা সৈন্য এবং ব্যবসায়ী ইংরেজ আমাদের দেশের উপর শাসন, শোষণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটতরাজ কম করেনি।আর সবশেষে পশ্চিম পাকিস্তানিরা (যাদের মধ্যে ছিল প্রচুরসংখ্যক ফর্সা)আমাদের শ্যামলা বাঙালির উপর হত্যা, ধর্ষণ নির্যাতনের তাণ্ডব চালিয়েছে মাত্র ৪৪ বছর আগে। এত তাড়াতাড়ি আমরা সাদাদের কুৎসিত চেহারা ভুলে ফর্সা হওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠলাম?

যে সাদা রঙটি ঐতিহাসিক কারণে হওয়া উচিত ছিল ঘৃণিত, তা হয়ে উঠল আমাদের অতি আকাঙ্ক্ষিত!

আমি কালো, আমি শ্যামবর্ণের এর অর্থ কি এই নয় যে আমি এদেশের ভূমিপুত্র-ভূমিকন্যা? আমি কালো এর মানে, আমার জননী বা আমার পূর্ব প্রজন্মের কেউ ভিনদেশি প্রেমিক-প্রেমিকা গ্রহণ করেনি। আমার পূর্ব প্রজন্মে কোনো ভিনদেশি নেই, আমার ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে মালো, কৈবর্ত, প্রাকৃতজনের রক্ত।

প্রাচীনকাল থেকে এই ভূখণ্ডে পূজিত হয়েছেন কালী, বিশালাক্ষী, মহালক্ষী, চণ্ডী, ভূমাবতী, কৃষ্ণের মতো শ্যামবর্ণের লোকজ দেব প্রতিমা।

মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতির বিহারে আমরা যে দেব ও মানুষের রূপ দেখি তা প্রাকৃতজনের চেহারা-বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন।

আমাদের সাহিত্যে যে ফুল্লরা, লহনা, বেহুলা, ভেলুয়া, মলুয়া, মহুয়া, চন্দ্রাবতীর দেখা মেলে তারা এদেশের নারী, শ্বেতাঙ্গিনী নয়, শ্যামলী।

এদেশের মানুষ-যারা আবহমান কাল থেকে শুনেছে পুথিপাঠ, কবিগান, জারি, সারি, মুর্শিদি, মারফতি,যারা চড়কের মেলায়, রাস উৎসবে, দোলযাত্রায় আনন্দে মেতেছে, যারা নবান্নে, বৈশাখে, ঈদে, পূজায় সামিল হয়েছে, যারা রোদে, জলে, বৃষ্টিতে, প্লাবনে সংগ্রাম করেছে, মাঠে শ্রম দিয়েছে, সাগরে নদীতে নৌকা ভাসিয়ে মাছ ধরেছে, জাল বুনেছে তারা পলল-সন্তান,পলিমাটির মতোই তাদের গায়ের রঙ।

শ্যামলাবরণ আমার, এই কালো রঙ নিয়ে আমি গর্বিত।এই রঙ আমার জাতিসত্ত্বার পরিচয়বাহী। আমি কোনো বিদ্বেষ প্রচার করতে বসিনি। এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী সব ধর্মের, সব রকম গায়ের রঙের মানুষকে নিয়েই আমার দেশ। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পাহাড়ি, সমতলবাসী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি সকলেরই আবাস এখানে। জন্মসূত্রে পাওয়া রঙ নিয়েই আমি খুশি। আরও ফর্সা, আরও একটু সাদা হওয়ার লোভ বা আগ্রহ যেমন আমার নেই তেমনি এদেশের কোনো মানুষেরই সেই আগ্রহের প্রয়োজন নেই। ফর্সা হওয়ার সাধনা ছাড়াও আমাদের করার মত অনেক কাজ রয়েছে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.