লীনা হাসিনা হক: অনেকদিন লেখা হয় না কিছু। সময়ের অভাব? ইচ্ছের অভাব? বছরের শেষ দিকে সময় তো ছিল অঢেল। ইচ্ছেরই অভাব ছিল কি তাহলে?অনেকদিন ফেসবুকে অনুপস্থিতির কারণে বন্ধুরা অনেকেই জানতে চায় কি হয়েছে, আমি ঠিকঠাক আছি তো! দেশের বাইরে নাকি অসুস্থ! একজন বললেন অনেকদিন কোন পোস্ট দেখি না, তাঁকে ব্লক করে দিয়েছি কি না!
মাঝে মাঝে কি যে একধরনের বিষণ্ণতা ভর করে। কিছুই ভালো লাগে না করতে, মনে হয় এতো ছুটাছুটি কি জন্য করছি! অথচ আমারতো অভাব নাই কিছু, মাস গেলে বাঁধা মাইনে আছে, মাথা গোঁজার ঠাই আছে, সন্তানরা আমায় ভালবাসে, তাদের ভবিষ্যৎও সো কলড উজ্জ্বল। মা আছেন এখনো। ভাই বোনেরা দিনে একবার অন্তত খোঁজ নেয়। কাছের বন্ধুরা ফোনে আমার ম্লান কণ্ঠ শুনে উদ্বিগ্ন হয়। অকৃতী অধম হওয়ার পরেও আমার কম তো নাই। তবে কিসের কারণে আমার বিষণ্ণতা?
এই বিষণ্ণতা কি আমার রক্তের মধ্যে আছে? আয়নার সামনে দাঁড়াই যখন মধ্যবয়সী এক নারীকে দেখি, ক্লান্ত। কেন? জীবনের ছুঁড়ে দেয়া সব চ্যলেঞ্জেই তো সামলেছি আমার মতন করে। নিজের করা ভুল গুলো শুধরাতে সব পারিনি হয়তো, কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা পাই নাই। তাহলে কেন আমার মনে হয় পথ চলা শেষ হবে কবে?
জীবন আমার শুরু হয়েছে সময়ের আগেই, জীবনের অম্ল মধুর তিক্ত কষায় সব অভিজ্ঞতাই হয়েছে। অনেকটা বন্ধুর পথ পেরোতে হয়েছে প্রায় পাহাড়ি নদীতে র্যাফটিং এর মতো করে, হোঁচট খেয়েছি, ব্যথা পেয়েছি, কেটেছে, রক্ত ঝরেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পথ পাড়ি দিতে পেরেছি। তাহলে এখন যখন জীবনের মসৃণ পথে চলছি তখন কেন ক্লান্তি? জীবনের সব অভিজ্ঞতাই সময়ের আগে আগে হয়েছে বলেই কি এখন মনে হয় আর কতদূর? তবে কি আমি আয়নায় সেই তরুনীকে খুঁজি জীবনের কোনও বাধাকেই যে পরোয়া করতো না? স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতার কাটা সেই তরুনীকে খুঁজে পাই না বলেই কি এই অবসাদ? কি কথা বাকী ছিল আমার সেই সাহসী তরুনীর সাথে? সে যে আমায় কথা দিয়েছিল জীবনের সব দায় মেটানো হলে পরে আমরা একসাথে যাব কোথাও!
জানি অনেকেই বলবে দুঃখবিলাস! তাই কি? দুঃখতো করছি না, শুধু বলছি ভালো লাগে না কিছুই, বিষণ্ণ লাগে! ক্লান্ত লাগে! কেন লাগে!
কত কথা যে মনে মনে ভাবি। ছোটবেলায় একটা খেলা খেলতাম, নামটা এখন মনে করতে পারছি না, খেলাটা ছিল এরকম যে একজন উচ্চারণ না করে শুধু ঠোঁট নাড়িয়ে একটা কোনও শব্দ বলবে, অন্যজনকে তা বলতে হবে। কাজের কারণে কত মিটিংয়ে যেতে হয়, আজকাল খেয়াল করছি যেকোনও মিটিং শুরু হওয়ার কিছুখন পরে আমি আর কিছু শুনতে পাই না, লোকেদের ঠোঁট নাড়া দেখি শুধু।
থট রিডিং বলে ব্যাপারটা আমি যাদের সাথে মিশি আমার মতনই সাধারন মানুষ তাদের আয়ত্তে নাই, নাহলে কি যে মুশকিল হতো। কারন কেউ হয়তো খুব আগ্রহ
করে কিছু বলছে, অথচ আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না, মনে মনে বলছি চুপ করো। ভাগ্যিস, মনের কথা মুখের চেহারায় ফুটে উঠে না, তাহলেও কি যে হতো।
কৈশোর আর তারুন্যের প্রিয় জায়গাগুলোতে ঘুরলাম কয়দিন, দুএক জন বন্ধুকে ফোন করি, কিন্তু কেমন যেন তাল ছাড়া। অফিস ছুটি নিয়ে ঘরে বসে থাকি কয়দিন কিন্তু তাতেও তো তাল ফিরে আসে না! আমি মানুষটা এমনিতেও খাপছাড়া, তালছাড়া, মাপ ছাড়া তবুও চলছিলাম তো। তালটা কোথায় যে কাটলো!
ফোন বেজে যায়, কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কেন? আবার যাকে ফোন করি সে ফোন না ধরা পর্যন্ত করতেই থাকি, কেন?
একই গান বার বার শুনি। শুনতেই থাকি। মাঝে মধ্যে কোনও একটা গানের কলি কি কবিতার পঙক্তি মাথার মধ্যে বাজতে থাকে। বাজতেই থাকে। ‘তোমায় গান শোনাবো…।
তিন প্রিয় লেখকের তিনটা বই একসাথে পড়তে শুরু করে কোনটাই শেষ করে উঠতে পারি না।
মেয়ে আগ্রহ ভরে বলতে আসে তার স্কুলের বন্ধুদের কথা, একটু পরে কথা শেষ না করেই চলে যায়…ডেকে ফিরালে বলে তুমি তো শুনছো না! তাইতো, তার অনেক কথাই যে আসলে মন দিয়ে শুনিনি!
মা’র সাথে কথা বলি যখন, একটু পরেই মা বলেন, কি হয়েছে রে তোর? মা কি গলার স্বরে টের পান আমার অন্যমনস্কতা নাকি কথার ছাড়া ছাড়া ভাবে?
ভোর পাঁচটায় ফোন করি যখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে থাকা ছোট ভাইকে, সে ভয় পেয়ে যায়, কি হয়েছে আপা? কিছু তো হয় নাই, শুধু ভাইয়ের গলার স্বর শুনতে ইচ্ছে হল।
সব কাজই করি কিন্তু কিছুতেই যেন আমি নাই। নিজেকে মাঝে মাঝে পুতুল মনে হয়, আমার বাড়ীর দেয়ালে ঝোলানো কাপড়ের পুতুল যেমন নিজের ইচ্ছেমত জায়গা বদল করতে পারে না ঠিক তেমন আমায় সব কিছু করতে হয় জীবনের প্রয়োজনে! আমার কেবল ইচ্ছে করে চুপচাপ বসে থাকতে কিন্তু চুপ থাকতে চাইলেও কেউ পারে না। এই অন্যমনস্কতা কেউ কেউ খেয়াল করে, বেশীরভাগ খেয়াল করে না। লোকেদের সময় বড্ড কম আজকাল। আমিই কি অন্যদেরকে সময় দেই? খুব কম।
কিছু আনন্দ অনুষ্ঠানে বাধ্য হই যেতে, কিছু আনন্দ অনুষ্ঠানে নিজের ইচ্ছেয় সামিল হই, কিন্তু আনন্দকে ঠিকমত খুঁজে পাই না, আমার কাছে বেশী সময় থাকতে চায় না, কোথায় কোথায় যে চলে যায়!
দিনশেষে যখন নিজের মুখোমুখি হই, জানতে চাই, ও আকাশলীনা, কি হয়েছে তোমার। কি যে হয়েছে তার তা সে নিজেও বুঝতে পারে না। শুধু মনে মনে আউরে যায়,
আলো — অন্ধকারে যাই — মাথার ভিতরে
…….স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয় — শান্তি নয় — ভালোবাসা নয়,
…হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়?
রিকশায় উঠলে একটু পরেই অন্যমনস্ক হয়ে যাই। সঠিক ঠিকানা ছাড়িয়ে চলে যাই, রিকশাচালক রাগ হয়, দু একজন বকাও দেয়। নিজের বাড়ীর ঠিকানাও ভুল করে
ছাড়িয়ে যাই। ভাবি, এরকম করতে করতে একদিন যদি সত্যি চলে যাওয়া যেতো, কেমন হবে সেটা?
কিন্তু যাওয়া কোনদিন হয় না, হবেও না, শুধু ক্রমশ আরও বিষণ্ণ, আরও ক্লান্ত হতে থাকবো তবু ঠিকানা ছাড়িয়ে চলে যাওয়া কোনদিন হয় না…এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে………