ফেলানির মায়ের জবানী

felani 3Felani-03-Fসালেহা ইয়াসমীন লাইলী: ‘কত কত লোক আসে। গ্রাম থেকে শহরের। দেশ থেকে বিদেশের। কেউ সাংবাদিক, কেউ গবেষক, কেউ লেখক, কেউ মানবাধিকার কর্মী, কেউ সিনেমা বানায়, কেউ নাটক। তদন্তের জন্য আসে গোয়েন্দারা। সবাই নিজের নিজের মতো করে প্রশ্ন করে। জবাবও খোঁজে নিজের পছন্দের। তারা সবাই খুচিয়ে খুচিয়ে দগদগে করে মন! যাতে ক্ষতের উপরে জমা আস্তর সরে যায়। এই ক্ষতের ব্যাথার পরিমাপ করতে সহজ হয় তাদের।

সাংবাদিকরা এসে ঝকঝকে স্পষ্ট উচ্চারনে তাদের শিখিয়ে দেয়া বুলি আমাকে আওরাতে বলে। গত চার বছরে অন্তত চার শত বার আমাকে ভিন্ন ভিন্ন টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে।তারা তাদের নিজের মতো করে যা শিখিয়ে দিয়েছে, আমি তাই বলার চেষ্টা করেছি। কেউ আমার নিজের কথা শুনতে চায় না। শুনলেও তাদের মন মতো হয়না বলে টেক-রিটেক হয়। লেখক, গবেষক, মানবাধিকারকর্মীরাও নিজের নিজের ছকে প্রশ্ন করে উত্তর লেখে নোটবুকে। নাটক সিনেমাওয়ালারাও ঘটনার দৃশ্যায়ন ও বাস্তবতার মিল খুঁজতে বার বার ঘুরে ফিরে একই কথায় ফেরে।

আমার বুকটা খা খা করে ওঠে প্রতিবার, বার বার। ‘আপনি যখন শুনেছেন আপনার মেয়ে গুলি খেযে মরেছে, আপনার কেমন লেগেছে? আপনার মেয়ে যখন গুলি খেয়ে কাঁটাতারের বেড়ায় উল্টো হয়ে ঝুলে ছিল, তখন নাকি সে মা, আমাকে পানি দাও বলে কাতরাতে কাতরাতে প্রাণ ছেড়ে দিয়েছে? এসময় নাকে তার বুকের রক্ত কাঁধ চুইয়ে মুখের ভিতর চলে গিয়েছিল?’ কতবার এমন প্রশ্নটার মুখোমুখি হয়েছি আমি তার হিসেব জানিনা।

এমন প্রশ্নগুলো আমাকে প্রতিদিন সেই কাঁটাতারের বেড়ার পাশে ঝুলিয়ে থাকা মেয়ের শরীরের নিচে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমি অসহায় মা, চোখের সামনে আমার কলিজার টুকরাকে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখি, পানির বদলে নিজের শরীরের চুইযে পড়া রক্ত গিলে ফেলতে দেখি! ক্রমে শীতল হয়ে যাওয়া দেহটাকে  টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে বিএসএফকে বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে দেখি! আমার চোখের সামনে ফ্লাশব্যাক হতে থাকে একটির পর একটি দৃশ্য। যা আমি নিজের চোখে সেদিন দেখিনি। শুধু পরে এই লোকগুলোর মুখে শুনেছি। অথচ এমন দৃশ্যগুলো শুনে শুনে আমার কল্পনার তার স্থায়ী আবাস গেড়েছে।

কখনও কারো প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আনমনে যখন আমি ফিরে যাই সেই দিনে, সেদিন সন্ধার আগে আমি মেয়েটাকে গোলাপী ফিতে দিয়ে চুল বেঁধে দিয়েছিলাম। সাজিয়ে গুছিয়ে বাবার সাথে দেয়ার সময় শেষবারের মতো বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম তার মাথাটা। সে সময়ের উষ্ণ নিশ্বাসের উত্তাপ আমি আজো অনুভব করতে করতে কেঁদে ফেলি। ক্যামেরাগুলো আমার কান্না দেখে খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে। ক্যামেরার পেছনের মানুষগুলোর চোখেও তখন তৃপ্তির ঢেউ খেলে ওঠে টগবগিয়ে। আমি অস্থির বোধ করি। আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। শুধু আমার অনুভুতিগুলো আমি বোঝাতে চাই।নিজের মতো করে। যদিও আমার অনুভুতির কোন গুরুত্ব নেই এদের কারো কাছে।

আমার মেয়ে হত্যার বিচার আমি কারো কাছে চাওয়ার অধিকার রাখি না।যারা হত্যা করেছে তাদের কাছে তো নয়ই, আমার নিজের দেশের কাছেও না। আমি অন্যায় ভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলাম। অন্যায়ভাবে আমার মেয়ে ফিরতে গিয়ে তার বাবার সামনেই গুলি খেয়ে মরেছে। এই অন্যায় আমার। তাই আমার মেয়ের হ্ত্যার দায়ও আমার। কষ্টের ভাগ নেয়ার যেমন কেউ নেই। হত্যায় দায়ও কেউ নেবেনা।

ফেলানীর হত্যার যে বিচারের প্রক্রিয়া চলছে তার ওপর কোন আস্থা আমার নাই। তারা প্রথম বারে দোষীকে বেকসুর খালাস দিয়েছে। আবারো হযতো তাই হবে। তারা নিজেরাই বাদী, নিজেরাই বিবাদী। নিজেদের আদালতে চলছে বিচার। এ বিচার সময়ক্ষেপন ছাড়া কিছুই হবে না। যদিও মেয়ের হত্যাকারীর শাস্তি হলে আত্মায় কিছুটা স্বস্তি পেতাম।

কিন্তু কেন আমাদের এই অন্যায় ভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে হয়? দারিদ্রতা কেন আমাকে এমন ঝুঁকি নিতে বাধ্য করে? বন্ধুকের নলের মুখে আমরা কেন দাঁড়িয়ে পড়ি? কেন আমাদের কাঁটাতারের ফাঁদে পাখির মতো গুলি খেয়ে মরতে হয়? সে প্রশ্নের জবাব আমি কার কাছে পাব?’

আমি আমার কথা রাখতে পারিনি, জাহানারা। কথা ‍দিয়েও আমি আসতে পারিনি তোমার কাছে। ক্ষমা করো আমাকে, বোন। যতদিন আমি তোমার সাথে দেখা করতে গিয়েছি কোনদিন তোমার প্রয়োজনীয় কথাগুলো শেষ করতে পারনি তুমি। মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে ফোন কল ব্যাক করতে বলেছ। আমি ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন দিয়েও তোমার কথাগুলো শেষ করতে পারিনি। কারণ তোমার কথা যে শেষ হবার নয়। তুমি তোমার প্রতিটি অনুভব, আক্ষেপ, অপারগতা প্রকাশ করতে চাও কথায়। কিন্তু সব কিছুর যে ভাষা থাকে না প্রকাশের। তা তুমি আমার চেয়ে হয়তো অনেক বেশী বুঝতে পার। আমি আর আসবনা। তোমাকে তড়পাতে দেখতে আর আসবনা আমি জাহানারা। আজ ৭ জানুয়ারী ফেলানী হত্যার ৪ বছর অতিক্রান্ত।

আমি আজ তোমার ফেলানীর মা হয়েছি! তোমার অনুভুতিগুলো আজ আমি বয়ান করছি। আর তোমাকে কাঁদাতে যাইনি। তোমার হয়ে তোমার ফেলানীর শোকে নিজে একবার কেঁদে নিলাম মাত্র!

লেখক ও সাংবাদিক

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.