সুমন্দভাষিণী: নিজের ফেসবুক একাউন্টে এক ছাত্রীর ছবি আপলোড করে তাতে অশালীন মন্তব্য করে ছড়িয়ে দেয়ার অপরাধে এক যুবককে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বুধবার চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানায় এ ঘটনা ঘটে। এটা আজ সকালে বিবিসি বাংলার ওয়েব পেজে প্রকাশিত একটি খবর।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহাদাৎ হোসেন বিবিসিকে জানান, মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার মেকানিক ইমরান হোসেন নগরীর এক কলেজ ছাত্রীর বাসায় মেরামতের কাজ করার সময় মোবাইল ফোনটি হাতে পান। সেখান থেকে ঐ ছাত্রীর ছবি সংগ্রহ করে নিজের ফেসবুক একাউন্টে আপলোড করেন ইমরান হোসেন।
ছবিতে নানা অশালীন মন্তব্য করে সেটি ফেসবুকে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শেয়ার করার পর ঘটনাটি জানাজানি হলে পুলিশকে জানায় ঐ ছাত্রীর পরিবার। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযুক্ত ইমরান হোসেনকে আটক করে। এরপর তাকে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে ইমরান হোসেন তার অপরাধ স্বীকার করেন। এবং তাকে শাস্তি দেওয়া হয়।
খবরটি নি:সন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং শাস্তিটিও যথোপযুক্ত। এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। সাইবার অপরাধ এতোভাবে বিস্তার পেয়েছে যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও হিমশিম খায় মাঝে-মধ্যে। ‘ম্যানুয়াল’ অপরাধেরই যেখানে কুলকিনারা হয় না, সেখানে ডিজিটাল তো আরও দূরের বিষয়।
তবে এখানে এই প্রসঙ্গের অবতারণা করলাম ভিন্ন একটি কারণে। বিভিন্ন মাধ্যমে খবরটি এসেছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। দৈনিক কালের কণ্ঠ লিখেছে, ‘জেলা প্রশাসনের নির্বাহী হাকিম শাহাদাৎ হোসেন জানান, কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এক ছাত্রীকে ফেসবুকে উত্ত্যক্ত করত ইমরান। ইমরান বাকলিয়া থানা এলাকায় মোবাইল ফোন মেরামতকারী একটি প্রতিষ্ঠানে টেকনিশিয়ানের কাজ করে। কিছুদিন আগে ওই ছাত্রী তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনসেটটি মেরামত করতে ইমরানকে দিয়েছিল। ইমরান তখন ওই ছাত্রীর মোবাইল ফোন থেকে তার ছবি নিয়ে নেয়। পরে এসব ছবি ইমরান নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আপলোড করে অশালীন মন্তব্য লেখে। বিষয়টি ওই ছাত্রীর ভাইদের দৃষ্টিগোচর হলে তাঁরা বাকলিয়া থানা পুলিশকে জানান। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সোপর্দ করে। ‘
এখন প্রশ্ন হলো, দুটি মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটের বক্তব্যে সুক্ষ্ম তফাত আছে। সেই তফাতটা কি উনি নিজে করেছেন, নাকি সাংবাদিকরা করেছেন? বিবিসি যে এটা করেনি, তার কারণ তাদের একটা সম্পাদকীয় নীতিমালা আছে, সেই নীতিমালার বাইরে গিয়ে একটা লাইনও বাড়তি লেখেন না। তাহলে কি অন্য গণমাধ্যমগুলো হরহামেশাই এমন মনগড়া কাহিনী লিখছে? কী ধরে নেবো আমরা সাধারণ পাঠকরা?
এটা তো নতুন নয়। অনলাইনের নামে গজিয়ে উঠা সব ভূঁইফোঁড়রা দিনকে রাত, রাতকে দিন করে দিচ্ছে। বিশেষ করে নারী ইস্যু হলে তো কথাই নেই। রগরগে কাহিনী বানিয়ে পাঠকদের তারা দেদারসে গেলাচ্ছে। আর আবাল পাঠকরাও তা গিলছে। সাংবাদিকতার গোষ্ঠী উদ্ধার হয়ে যাচ্ছে একের পর এক এসব ঘটনায়। সবশেষ সেখানে শোরগোল তুলেছে হ্যাপী-রুবেল কাহিনী।
বুঝেই পাই না, হ্যাপী-রুবেলের ব্যক্তিগত ফোনালাপ কি করে ধারাবাহিকভাবে প্রচার হয় টিভি চ্যানেলে! আর সেখানে রিপোর্টার মতামতও প্রকাশ করে। অবশ্য সেই চ্যানেলটির রিপোর্টাররা সুযোগ পেলেই মতামত দেন তাদের রিপোর্টে, লাইভ সম্প্রচারে। যা সাংবাদিকতার নীতিমালার সাথে একেবারেই যায় না। সাংবাদিকদের কাজ হলো খবরটি পরিবেশন করা, দর্শকরা সেখান থেকে নিজেদের মতামত তৈরি করে নেবে। সাংবাদিক কখনই দর্শক-শ্রোতাদের ওপর মতামত চাপিয়ে দিতে পারেন না। কিন্তু সেই কাজটিই দিনের পর দিন করে যাচ্ছে আজকালকার সাংবাদিকরা। তাদের দিয়ে করিয়ে নেয়া হচ্ছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।
বলছিলাম, একেকটি খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্নভাবে পরিবেশনের ধরন নিয়ে। যেকোনো সড়ক দুর্ঘটনার খবর বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। একটা দুর্ঘটনা ঘটার সাথে সাথে নানা ধরনের সংখ্যা উঠে আসতে থাকে বিভিন্ন মাধ্যমে। যেন সংখ্যার প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু এই খবরটি যে কত মানুষকে অস্থির করে তোলে, এটা কেউ ভাবে না। কোন কোন গণমাধ্যম আবার বিভিন্ন পুলিশ কর্মকর্তার বরাতও দেন। আদৌ তারা কথা বলেন কিনা সন্দেহ আছে। দিনের পর দিন দেখেছি, সেই সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন করে ভিন্ন পরিসংখ্যান বা ভিন্ন বর্ণনা পেয়েছি খবর পরিবেশন করতে গিয়ে। একটা জায়গায় কাজ করতে গিয়ে শিখেছিলাম, ধারণাপ্রসুত হয়ে নিউজ করা যাবে না। স্থানীয় সাংবাদিক যদি বলেন যে, হ্যাঁ তিনি এতোগুলো লাশ সেখানে দেখেছেন, তাহলেই সেটা গ্রহণযোগ্য হবে।
এখানেও একটা কথা আছে। সেই স্থানীয় সাংবাদিক বাসায় বসেও অন্যদের কাছ থেকে খবর নিয়ে বলে দিতে পারেন যেকোনো তথ্য। কাজেই সেই সাংবাদিকের ওরিয়েন্টশন জরুরি। সেইক্ষেত্রে ক্রসচেক করা যায়। পুলিশের নম্বর পাওয়াটা এখন খুবই সহজ, একটু কষ্ট করে নিজেই ফোন করে নিলে ভ্রান্তি থাকে না।
আজই আরেকটা নিউজ দেখছিলাম যে, স্বামী সন্তান চাননি, কিন্তু স্ত্রী সন্তান-সম্ভব হয়ে যাওয়ায় তাকে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে স্বামী। কেউ কেউ লিখেছে, মেয়েটির গায়ে এসিড ছোঁড়া হয়েছে, কিন্তু মেয়েটি নিজের মুখে বলেছেন, তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় তার স্বামী। দুটোই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও ইনফরমেশন গ্যাপ থেকে যাচ্ছে, যা আমাদের কাম্য নয়। এক্ষেত্রে মামলায় তারতম্য যেমন হয়, তেমনি চিকিৎসা ক্ষেত্রেও।
সাংবাদিকতা আসলে অনেক কঠিন একটা পেশা। সবচেয়ে বড় কথা প্যাশন না থাকলে এই প্রফেশনে কারও আসা উচিত না। ভাসা ভাসা জ্ঞান দিয়ে সাংবাদিকতার কী ফল হতে পারে তা আমরা হালের সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতা দেখেই টের পাই।
আগে ভাল, সৎ মানুষ হতে হবে, তারপর পেশাদারিত্ব। নইলে যেকোনো পেশাই মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। আমাদের এখন সময় এসেছে পুরো বিষয়টিই পর্যালোচনা করে দেখার।