হাত বাড়িয়ে দেখি কেউ নেই-৬

DAASশুচি সঞ্জীবিতা: আমাদের ছোটবেলায় অতি দরিদ্র একটি হিন্দু পরিবার ছিল। সেই সংসারে দুটি মেয়ে, তিন ছেলে নিয়ে এক বিধবা বাস করতেন। কাজের মধ্যে দুটো ছেলে করতো কাঠমিস্ত্রীর কাজ, আর মেয়েগুলো কিছুদূর পড়াশোনা করেই ক্ষান্ত দিয়েছিল। আর মা-টা এ বাসায়, ও বাসায় ঘুরে ঘুরে কাজ করে দিনশেষে টোনাভর্তি চাল-ডাল-আলুটা নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। সেই সময়ে মানুষের বাড়িতে অত কাজেরও চল ছিল না। খুবই টানাটানির সংসার ছিল তাদের।

এর মধ্যে মেজো মেয়েটির ওপর নজর পড়েছিল পাড়ার কালু শেখের। সারাদিন ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ায় আর রাতে মদ-গাঁজা খেয়ে পাড়া মাথায় তুলে হৈ চৈ করে। মেয়েটির নাম শিবাণী। সেও কিভাবে যেন প্রেমে পড়ে যায় ওই কালু শেখের। কালুর বাবা ছিল মুসলমান, তবে কালুর মা আবার হিন্দু ঘরের ছিলেন। তো, একদিন পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলো শিবাণী-কালু।

কালুর মা কান্নাকাটি করে ছেলে-ছেলে বউকে ঘরে ফিরিয়ে আনলেন। শিবাণীর মা বেঁকে বসলেন, মেয়ের মুখই কোনদিন দেখবেন না বলে। ভাইয়েরাও তাই। ফলে দুই বাড়ি অন্তর বাস করলেও মুখ দেখাদেখি বন্ধ। বাঁশঝাড়ের মধ্য দিয়ে ঠিকই দেখা যায় চলাফেরা, এমনকি কান পেতে থাকলে এক বাড়ির আলাপ-সালাপও সহজেই চলে আসে অন্য বাড়িতে।

প্রথমদিকে কিছুদিন ভালই চলছিল। তা মাস ছয়েক হবে হয়তো। এরই মধ্যে পেটে বাচ্চা আসে শিবাণীর। কালু শেখ আবার আগের নেশায় বিভোর হয়ে পড়ে। এবার বাড়তি অনুষঙ্গ যোগ হয় গায়ে হাত দেয়া। শিবাণীর ওপর কারণে-অকারণে অত্যাচার শুরু হয় কালু এবং তার মায়ের। মাঝে মাঝে বোনও এসে যোগ দেয়। পেটের বাচ্চাটি ঠিকমতো বড় হতে পারছে না খাওয়ার অভাবে। মারের শব্দ দুবাড়ি পেরিয়ে শিবাণীর মায়ের কানে যায়। ছেলেদের নিষেধ সত্ত্বেও মা ছুটে আসেন বাঁশঝাড়ের মাথায়, দূর থেকে দেখেন মেয়ের ওপর অত্যাচারের দৃশ্য। একদিন, দুদিন, তিনদিন। একদিন মা ঠিকই বেরিয়ে আসেন বাঁশঝাড় ছেড়ে, তখন মায়ের ওপরও চলে অত্যাচার। সেইসাথে যোগ হয় যৌতুকের দাবি।

মা আকাশ থেকে পড়েন। বিয়ে করেছো তোমরা, যৌতুক কেন দেবো? কোথা থেকেই বা দেবো? শিবাণী চোখের ইশারায় মাকে সরে যেতে বলে। ও লজ্জায়-অপমানে কুঁকড়ে যেতে থাকে। মা তখন অন্য প্রতিবেশিদের দ্বারস্থ হন মেয়েকে রক্ষায়। এরই মধ্যে একদিন শিবাণীকে এমন মার দেয়া হয় যে, ও বেঁচে আছে না মরে গেছে, তাই বুঝতে সময় লাগে। ও মরে গেছে ভেবে প্রতিবেশিরা থানায় খবর দিলে পুলিশ এসে কালুকে ধরে নিয়ে যায়। পাড়ার মানুষ ভাবে, এবার বুঝি একটু শান্তি হলো। কিন্তু শান্তি কি আর হয়!

কালু শেখের মায়ের দাপটে শিবাণী তখন নিজে গিয়ে সব অস্বীকার করে ফিরিয়ে নিয়ে আসে কালুকে। টিনের চাল বিক্রি করে জামিনের টাকা জোগাড় করে। এভাবেই চলতে থাকে দুটি বিষন্ন জীবন। প্রতিবেশিরা অতীষ্ঠ, মা তটস্থ, অপমানিত, কুণ্ঠিত। পুলিশে খবর দিলে শিবাণী ছাড়িয়ে নিয়ে আসে বলে প্রতিবেশিরাও আর আগ্রহী হয় না শিবাণীর বাঁচামরা নিয়ে। একে একে জন্ম নেয় দুটি মেয়ে। তৃতীয় সন্তানের সময় খোদ আমি সাক্ষী ছিলাম।

একদিন চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখি শিবাণীকে প্রচণ্ড মারধর করে ফেলে রেখেছে কালু। ছয় মাসের অন্ত:সত্ত্বা শিবাণীর শরীরে কাপড়ের বালাইটুকুও নেই। বাড়িভর্তি লোকজন, এর মধ্যেই শিবাণী এ অবস্থায় দৌড়ে অন্য ঘরে আশ্রয় নিল। পরে জানতে পারলাম, কালু শেখের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় সবার সামনেই কালু তার ওপর চড়াও হয়, আর শিবাণীও আত্মরক্ষায় ওই অবস্থাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এতে কালুর মা ক্ষিপ্ত হয়ে শিবাণীকে জোর করে ধরে আবার ঘরে পাঠায়। ভিতর থেকে কেবল ভেসে আসতে থাকে আর্তচিৎকার। শুনছিলাম, কালু শেখ শিবাণীর মুখের ওপর প্রস্রাব করে দেয় একটা পর্যায়ে। একসময় সব চুপ হয়ে যায়।

পুরো ঘটনাটাই ঘটে আমার চোখের সামনে। আমি চিৎকার করে কাঁদবো, না মারবো কাউকে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একসময় আমাকে ধরে ধরে নিয়ে আসা হয় ওই অবস্থা থেকে। এরপর অনেকদিন পর্যন্ত আমি স্বাভাবিক হতে পারিনি। কানে বাজতো সেই চিৎকার, শিবাণী আমাকে বলছে, ‘মাসী, আমারে বাঁচাও, আমার মায়েরে খবর দাও’। বাসায় ফিরে দেখেছিলাম, শিবাণীর মা গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে আর বলছে, ‘ও মরতে পারে না? ভগবান এতো মানুষরে মারে, এরে চক্ষে দ্যাহে না?’ মায়ের মন, কতটা কষ্ট পেলেই এমন কথা বলে!

তারও কয়েক মাস পরের ঘটনা। শিবাণীদের ঘরের অর্ধেক টিনের চাল নেই। গাঁজা খেয়ে সব শেষ করে দিয়েছে। মধ্যরাত থেকেই শিবাণীর চিৎকার। আমি অস্থির পায়চারি করি ঘরের মধ্যে। কেউ নেই যে বলবো তাকে। ভোরের আলো না ফুটতেই দৌড়ে যাই ওই বাড়িতে। বলা হয়নি, এর মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে শিবাণীকে খাবার পাঠাতাম আমি। ও আলুথালু চুল নিয়ে ঘুরে বেড়াতো পাড়ার রাস্তায়। খাবার পেলে খুশি হয়ে যেতো। তো, ওর ঘরে ঢুকতেই ও আমার পা জড়িয়ে ধরে। বুঝতে পারি, প্রসব বেদনা উঠেছে। কালু শেখের মাকে বলি, দাইমাকে খবর দিয়েছেন? আমার সাথে উনি নমনীয়ভাবেই বলেন, ‘ওইতা লাগবো না, এমনেই খালাস অইবো’।

আমি বাসায় ফিরে গরম জল বসাই, ব্লেড গরম জল দিয়ে ধুয়ে রাখি। বাসা থেকে কিছু পুরনো কাপড়-চোপড় আর বস্তা নিয়ে শিবাণীর ঘরে বিছিয়ে দিয়ে আসি। আমার এসব কাণ্ড দেখে এই বাসায় তখন কানাঘুষা। কান দেই না তাতে। আমার চাপে পড়ে শেষপর্যন্ত শিবাণীর মা একজন দাইমাকে ধরে নিয়ে আসেন। দুই মেয়ের পর এবার ছেলে বাচ্চা হয়। মূহূর্তেই দেখলাম, কালু শেখের মায়ের অবয়বের পরিবর্তন ঘটে গেল। ছেলে বলে কথা! কালু শেখের বংশধর।

মনে মনে বলি, যেই না বংশ, তার আবার উত্তরাধিকারী! আর কত মেয়ের সর্বনাশ যে হবে এসব উত্তরাধিকারীর হাতে। শিবাণীকে বলি, আর বাচ্চা নিস না, এটাই যেন শেষ হয়।

বেশ কবছর পর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কথায় কথায় শিবাণীর প্রসঙ্গ আসে। ওরা নাকি ভাল আছে, কালু শেখও আগের চেয়ে ভাল হয়ে গেছে। এখন মারধর কম হয়। শিবাণীর সাথে দেখা। সে হেসে বলে, ‘আমার শইল্লে কিছু নাই, তাই মাইর খাইলেও লাগে না আর। আর ধর্ম যখন গেছে, তখন তো সবই গেছে।’। আমি অবাক বিস্ময়ে ওকে দেখি আর পড়তে চেষ্টা করি ওর মনকে। (চলবে)

 

 

শেয়ার করুন: