নিরাপত্তা হেফাজত আসলে কতটা নিরাপদ?

Rape victim pixসুপ্রীতি ধর (৭ অক্টোবর ২০১৩): ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে ভুল পথে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চলে এসেছিল ছোট্ট মেয়েটি। সন্ধ্যা হয়ে আসায় রাস্তার পাশে বসে কাঁদছিল। নিরাপত্তার কথা ভেবে স্থানীয় লোকজন তাকে তুলে দেয় পুলিশের হেফাজতে। কিন্তু থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা পরের দিন আদালতে হাজির না করে তাকে তিন দিন থানায় আটকে রেখে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে। কারা হেফাজতে সে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ফাঁস হয়ে যায় কিশোরী মেয়েটির ওপর বর্বর নির্যাতনের কথা।

গত ২৮ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানায় ঘটে এ বর্বরতা। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে গোবিন্দগঞ্জ জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. তারিক হাসান মেয়েটির জবানবন্দি গ্রহণ করেছেন। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত টিমও গঠন করা হয়েছে। তবে এখনও পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

গতকাল নিউজটি পড়তে গিয়ে বার বারই সীমা চৌধুরী আর ইয়াসমীনের কথা মনে পড়ছিল। এতো তোলপাড়া, এতো আন্দোলন, ধর্ষকদের শাস্তি হওয়ার পরও ধর্ষণ থেমে নেই। নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে বার বার ঘটছে এমন সম্মানহানির ঘটনা। তাই প্রশ্ন জাগে, এই যে নিরাপত্তা হেফাজত তৈরি করা হয়েছে প্রতিটি থানায়, সেগুলোর আসলে কাজ কী? সেগুলো কেন নিরাপদ নয়? কারা এগুলোর দায়িত্বে?

গতকাল যে পোর্টালে নিউজটা পড়ছিলাম, সেখান বার বার লেখা হয়েছে, মেয়েটি কারও নাম বলতে পারেনি। ভেবে পাই না, একটা কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করা হলো, সেখানে ও নাম জানবে কি করে? আর ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুলিশকেই। রক্ষক যেখানে ভক্ষক, সেখানে কী তদন্ত হবে, তা সহজেই অনুমেয়।

কিন্তু গতকাল থেকে এ নিয়ে খুব একটা আলোচনা-সমালোচনা চোখে পড়েনি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নামে একটি সংস্থা আছে, যার অতীতে বিশেষ নাম-ডাক থাকলেও এখন তহবিল ছাড়া এক পাও নড়ে না। তারা এখনও মানববন্ধন করে উঠতে পারেনি। সবকিছুরই আসলে সময় লাগে। শুধু সময় লাগে না নির্যাতনের। ততক্ষণে দম চলে গেলেও কিছু আসে যায় না। গরীবের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তাতে কী? ভারতেও গত কয়েক মাসে যেসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো মধ্যবিত্ত পরিবারে ঘটেছে বলেই তুমুল আন্দোলন হয়েছে, সরকার-বাহাদুররা অন্তত নড়েচড়ে বসেছে, বাধ্য হয়েছে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে। এখন তা কার্যকর হলেই হয়।

আমাদের দেশে কিন্তু কার্যকরের ইতিহাস আছে। সীমা চৌধুরী ধর্ষণের পিছনে জড়িত পুলিশ সদস্যদের ফাঁসি হয়েছিল। কিন্তু মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মানুষজন, বিশেষ করে ধর্ষক-নির্যাতকরা ভুলেই যায় শাস্তির কথা। তাই তারা নতুন উদ্যমে নির্যাতন শুরু করে।

আমাদের চলতি-বিগত রাষ্ট্র নায়কেরা উন্নয়ন-অনুন্নয়ের গল্প বলে যান এবং গেছেন, অন্যদিকে গরীবের শিশুরা থানা হেফাজতে ধর্ষিত হতে থাকে। এ নিয়ে কেন কোন জোরালো পদক্ষেপ কোন সরকারই নেয় না, তা আমার বোধগম্য নয় মোটেও। নাকি আমরা অপেক্ষা করবো, কবে নিজের ঘরে ঘটবে এই ঘটনা! বিবেক তখন নড়েচড়ে বসবে!

এর আগেও টাঙ্গাইলে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা থেকে একটি টিম গিয়ে সেখানে প্রতিবাদও জানিয়ে এসেছে। এতে কি বিষয়টার সুরাহা হয়েছে? হয়নি। মেয়েটিকে তো তার নিজ বাবাই ঘরে তুলতে চায়নি। তাহলে আমরা কোন পরিবর্তনের কথা বলছি?

রাস্তায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ জানাতেও আজ আমি নিরাশ বোধ করি। কেন জানি মনে হয়, সময় নষ্ট ছাড়া এটা আর কিছু না। চাই দুর্ধর্ষ কোন কর্মসূচি। যাতে আর একটি মেয়েও ধর্ষণের শিকার না হয়, নির্যাতনের শিকার না হয়। যাতে ধর্ষণের আগে ধর্ষকদের আত্মা আড়ষ্ট হয়ে যায়, যাতে তাদের আতংকে-ভয়ে পুরুষাঙ্গই উত্থিতই না হয়, চাই তেমন কর্মসূচি, তেমন পদক্ষেপ। এইদেশে আইনের অভাব নেই, কিন্তু আইন থাকে পুরুষের পক্ষে। কাজেই আইনকে আজ আর বিশ্বাস নেই আমার।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছি আমরা। রাস্তাও আমাদের দখলেই থাকবে, পাশাপাশি পাড়ায়-মহল্লায় তৈরি করতে হবে লাঠিয়াল বাহিনী, যারা কেবল নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধেই সদা জাগ্রত থাকবে। দু’একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে এমনিতেই কমে আসবে ধর্ষণের লালসা।

শুরুতেই বলছিলাম নিরাপত্তা হেফাজতের কথা। যে হেফাজত নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেটা রেখে কী লাভ? দেশের প্রতিটি থানায় অভিযান চালাতে হবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। পুলিশ আমাদের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে, তা নয়, তারা এক শিশুকে পেয়ে ধর্ষণ করে ফেললো? কেমন মানসিকতা তাহলে এসব পুলিশের। দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে ওদের শাস্তি কার্যকর করতে হবে। নয়তো এসব ঘটনা ঘটতেই হবে।

আর সবচেয়ে বড় কথা, ধর্ষণের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জোরালো থেকে জোরালো করতে হবে, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অব্যাহত রাখতে হবে। কোনমতেই কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া যাবে না। নারীর সম্ভ্রমহানি করে কোন জাতি এগোতে পারে না, তাই আসুন শামিল হই প্রতিবাদে।

ফেসবুকে ফড়িং ক্যামেলিয়া নামের একজন ঠিকই লিখেছেন, ‘কোন মেয়ে ধর্ষিত হলে আমার কষ্ট হয়, আফসোস হয় না। কারণ তার বন্ধু, স্বজন, আত্মীয়, চেনা-অচেনা কোন মেয়ে যখন ধর্ষিত হয়েছিল তখন সে প্রতিবাদ করেনি। দেখেও না দেখার ভান করেছে।
সেই ভাইটির জন্য আমার আফসোস হয় না, যার বোন ধর্ষিত হয়ছে অথচ অন্যের বোন ধর্ষিত হলে সে চুপ ছিল।
আজ আপনি চুপ থাকবেন কাল আপনার প্রিয় জন ধর্ষিত হবে। আপনি ধর্ষক কে বড়জোর একটা চড় কিংবা পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারবেন কিন্তু ধর্ষকটির প্রকৃত শাস্তি তখনই হবে, যখন সবাই প্রতিবাদ করবে। আপনি কারো পাশে না থাকলে কেন অন্যরা আপনার পাশে থাকবে?

একবার ভাবুন তো ঐ ধর্ষিত মেয়েটির জায়গায় আপনার বোন, মা, বন্ধু, প্রেমিকা হলে কি করতেন?

তবে ক্যামেলিয়া একটা বড় ভুল করেছে। গোবিন্দগঞ্জে ধর্ষণের শিকার এই কিশোরী মেয়েটির সামাজিক অবস্থান আসলে কোন প্রতিবাদের জন্ম দেয় না, ওরা কেবলই শিকার হয় নানারকম নির্যাতন-বৈষম্যের। কাজেই এদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের একান্ত কর্তব্য ও দায়িত্ব।

শেয়ার করুন: