ওঠো আনারকলি ওঠো, মোমবাতি প্রজ্জ্বলনে যেতে হবে

মাসকাওয়াথ আহসান:

সেলিম ভাই ও আনারকলি আপা সাংস্কৃতিক জুটি। অত্যন্ত নান্দনিক জীবনযাপন করে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্বোপার্জিত স্বাধীনতার সামনে দাঁড়িয়ে সেলিম ভাই যখন আবৃত্তি করতো, আমি জানতাম হে অর্জুন আমি ঠিকই জানতাম ফুল ফুটবে না ফুল ফুটবে না ফুল আর কখনোই ফুটবে না, আনারকলির বুকের মধ্যে তখন ভালোলাগার ফুল ফুটতো একে একে।

সেলিম ভাই সংস্কৃতি করে করে সরকারি কাজের ঠিকাদারি পেতে শুরু করে। বিমানবন্দরের সৌন্দর্য্য বর্ধন, সরকারি প্রিন্টিং-এর কাজ। আর আনারকলি নিয়মিত মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে, সংস্কৃতি এলাকায় অভিমানী চেহারা করে ঘুরে, টেলিভিশনের মর্নিং-শোর সফল সাংস্কৃতিক জুটিতে পরিণত হয়।

গণভবনের পিঠাপুলির আসরে আপার সঙ্গে কোরাসে গান করে আনারকলি সমাজে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ফেসবুকে আনারকলি সে ছবি দিলেই সেখানে ললিতা এসে লিখে দেয়, ক্যানডিড ফটো। আনারকলি তখন এনজিও ব্যুরোতে গিয়ে ললিতার এনজিও রেজিস্ট্রেশনের কাজটি করে দেয়। এইভাবে আনারকলি, ললিতা একটি রুলিং এলিট সার্কেল হয়ে ওঠে।

মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার থেকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, এরকম সব জমকালো আয়োজনে উপস্থিত থাকে তারা। রেখার মতো হাসে, শাবানা আজমীর মতো টিভি বাইট দেয়। সুবর্ণা আপার মতো চোখ ঘুরিয়ে কথা বলে, খুশী আপার মতো সবসময় খুশি খুশি ভাব ধরে রাখে।

লর্ড কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারের মতো সেলিম ভাই মোহর ছড়ায়; সহমত ভাই ও শিবব্রত দাদা তাকে সেন্টার ফর রুথলেস ইনটেলিজেন্স (ক্রাই)-এর উপদেষ্টা পরিষদে নিয়ে যায়।
সেলিম ভাই সারাদিন গুনগুন করে গাইতো, এমনি করে দিন যদি যায় যাক না। আনারকলি মোমবাতি প্রজ্জ্বলন জোটের প্রাণ হয়ে শহরের নানা জায়গায় সংস্কৃতি বাঁচিয়ে বেড়াত।

১৫ জুলাই থেকে আনারকলি আপা আর ললিতা হাঁটুর বয়েসী জেন জি’দের রাজাকার বলে ট্যাগিং করতে করতে ৩ অগাস্ট নিজের বাড়িতে ছেলে-মেয়ের ঘর থেকে কথা ক আর আওয়াজ উডা গানের শব্দ শোনে।

আনারকলি ও ললিতা ছেলেমেয়ের সঙ্গে কনফ্রন্ট করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। সেলিম ভাই বলে, এক একটা যুগের নিজস্ব চাওয়া থাকে। ওদের বাধা দিতে যেওনা; ফল বিপরীত হবে। ৫ অগাস্ট ছেলে-মেয়েরা ছাদে বিজয় উৎসব করলে; আনারকলি অজ্ঞান হয়ে যায়।

ললিতা আর রাবেয়ার ফেসবুক কালচারাল ওয়ার চলতে থাকে। এতোদিন ললিতার যেমন ক্ষমতার দম্ভে মাটিতে পা পড়তো না; এখন রাবেয়ার সেরকম দম্ভে মাটিতে পা পড়ে না। কিন্তু সমস্যার জায়গা হচ্ছে, দুজনেই দুটি যুগক্ষণের দুটি মানবতাবিরোধী অপরাধী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করছে। ফলে একে ‘কালচারাল ওয়ার’ না বলে ‘ক্যানিবাল ওয়ার’ বলাই শ্রেয়।

৫ অগাস্ট থেকে কী যে হয়, আনারকলি বার বার অজ্ঞান হয়ে যায়। সচিবালয়ে আনসার প্রতিবিপ্লব দেখে সেলিম ভাই তাকে পানি ছিটিয়ে জ্ঞানে ফেরায়। কিন্তু একে একে সমস্ত প্রতিবিপ্লব ব্যর্থ হলে; আনারকলি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফাইভ স্টার হোটেলে পার্টি নেই, গণভবনে গিয়ে মাঝে মাঝে আপার মাথায় তেলপানি বসিয়ে দেয়া নেই। কী যে নেই, কী যে নেই হাহাকারে ভেতরে ভেতরে শুকিয়ে যেতে থাকে আনারকলি। মনে হয় চারপাশ থেকে কেউ ইঁট গেথে তাকে কবর অথবা কারাগারে আটকে ফেলছে।

সেলিম ভাই ঘরে বাইরে উপন্যাসের সন্দ্বীপের মতো যে স্বদেশী দাড়ি রেখেছিলো, তার ওপর টুপি চড়িয়ে পাড়ার মসজিদে যাতায়াত শুরু করে, বন্দে মাতরম নেই তো কী হয়েছে এবার নারা এ তাকবির দিয়ে ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিলিয়ে যাবে।

কিন্তু আনারকলির কী হবে, সে সন্ধ্যা হলেই সাইকো সমাটিক ডিজঅর্ডারে অজ্ঞান হয়ে যায়। খাগড়াছড়ি অস্থির হলে সেলিম ভাই আবার আনারকলিকে জাগায়। কিন্তু খাগড়াছড়ি শান্ত হলে আনারকলি আবার অজ্ঞান হয়ে যায়।

ললিতা ছাড়ার পাত্রী নয়। সে সাড়ে পনেরো বছর ধরে গুম-ক্রসফায়ারে সহস্র খুন দেখে একবারও তারাপদ রায়ের কবিতা বলেনি। ১৫ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট বড্ড শান্তি কমিটি হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-ছাত্রীদের নির্মূল করে বার বার ক্যাম্পাসে সব কিছু স্বাভাবিক হবার কৃষ্ণচূড়া গাছ খুঁজেছে। কিন্তু ৫ অগাস্ট থেকে ফেসবুক মহল্লার এমনেস্টি আপা হয়ে উঠেছে সে।

ছাত্রলীগ খুব শুদ্ধ ছাত্রসংগঠন এরকম বিশ্বাসের শিবব্রত দাদা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অশুদ্ধ শিবিরের সভাপতি পরিচয় পেয়ে ইউরেকা ইউরেকা বলে দৌঁড়াতে থাকে। সহমত ভাই তখন নস্ট্রাদামাসের মতো বলে, আগেই কইছিলাম এইডা শিবিরের বিপ্লব আছিলো।

বিজেপির রিপাবলিক বাংলার শিবসেনা উপস্থাপক ময়ূখ তখন, ব্রেকিং নিউজ ব্রেকিং নিউজ বলে, শিবির শিবির রবে দৌড়ায়।

সংস্কৃতি মামারা তখন ছ্যা ছ্যা করছে; রুচির মোহন ফতুয়া পরে। সেলিম ভাই দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ঘরে ঢুকে আনারকলিকে মুখে পানি ছিটিয়ে জাগাতে চেষ্টা করে, ওঠো আনারকলি ওঠো, মোমবাতি প্রজ্জ্বলনে যেতে হবে।

 

মাসকাওয়াথ আহসান: রম্যলেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট

শেয়ার করুন: