পোশাকের বাহানায় ধর্ষণ আর কতদিন?

ফাহমিদা জেবীন:

পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কাছে দেশটির আমজনতার দাবি, ‘হামকো বাংলাদেশ জ‍্যাছা বানাদো’। শুনে ভাবছিলাম হাসবো নাকি কাঁদবো! যে পাকিস্তানিরা শাসনের নামে আমাদের শোষণ করে বেড়াতো, আজ তারা কিনা বাংলাদেশকে রোল মডেল মানছে; একজন বাংলাদেশী হয়ে তখন গর্বিত হই বৈকি! হ‍্যাঁ, এখন আর লোডশেডিং এ অতিষ্ট মধ‍্যবিত্তকে একটু একটু টাকা জমিয়ে বা ধার-দেনা করে ইন্টিগ্রেটেড পাওয়ার সিস্টেম (আইপিএস) কিনতে বাধ্য হতে হয় না। পথ-ঘাট, শিক্ষা, সেতু, খাদ্য, দেশীয় বস্ত্র, জিডিপি ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা চোখে পড়ার মতোই এগিয়ে।

কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে উট পাখির ন‍্যায় বালিতে মাথা গুঁজে থেকেও তার উল্টো চিত্র অস্বীকার করা অসম্ভব। যেখানে রোজ কিনা জাতির বৃহত্তর অংশের (নারী) প্রতি বর্বরতা, সহিংসতায় একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে দেশ, মা, মাতৃকা। এক্ষেত্রে লোক চক্ষুর আড়ালে মাথার উপর দিয়ে পানি অনেক আগেই গড়িয়েছে। ধর্ম ব‍্যবসায়ীদের আশ্রয় আর ক্ষমতার প্রশ্রয়ে আমাদের নিত‍্য ডাল-ভাত চিত্র হয়ে ধর্ষণ এক শ্রেণির উৎসব তথা মহামারীতে পরিণত হয়ে স্থায়ী বসতি গেড়েছে।

এদিকে পরকীয়া আসক্ত একজন খুনি ভ্রু প্লাক করে, আইলাইনার-লিপস্টিক পরে আদালতে যান। আর তার ফাঁসির রায় হবার পর যে কিনা মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে আদালতে গেছেন- এই যদি হয় পত্রিকার নিউজ তখন আর আজকাল আশ্চর্য হই না। কারণ সেই স্বাভাবিকতা বহু আগেই হারিয়েছি।

আমি ৭১ দেখিনি। বড়দের কাছে শুনেছি, পড়েছি, সিনেমায় কিংবা পোস্টার, ব‍্যানারে দেখেছি পাক হানাদের বর্বরতা। যার সাথে অবিকল মিলে যাচ্ছে আজকের স্বজাতির পাশবিকতা! যে পুরুষ আজ পিশাচের রূপ ধারণ করেছে, জন্ম দেবার কালে মা তাকে নিষ্কলুষ, নিস্পাপ রূপেই দুনিয়া দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি (মা) পুত্র লালনে আদর আর শাসনের সংমিশ্রণে শক্ত হাতে লাগাম টেনে ধরেননি। এই শাসনবিহীন ‘আদর’ নামক আশকারা কখন পুত্রকে নষ্ট পথে এগিয়ে দিল আর তারপর সেই পুত্রের মাঝে ক্ষমতার লোভ, দ্রুত সম্পদ পাহাড় আরোহন প্রবণতা, রাজনীতির নষ্ট ভ্রূণে বেড়ে উঠা অন্যায়-অবিচারে জড়ানো এবং অন‍্যায় করে অনায়াসে পার পেয়ে যাবার সিস্টেম আস্তে আস্তে তার ভেতর থেকে চিন্তা, বোধ, বিবেক, বুদ্ধি, মানবিকতা র্সবোপরি মনুষ্যত্বকে গ্রাস করে পিশাচে পরিণত করেছে। তাই আজ সে মায়ের মুখে নিজ ভাষায় আর্তনাদ, ফরিয়াদ শুনতে-বুঝতে অক্ষম।

মাতৃর্গভ হতে জন্ম নেয়া মানবশিশু দিনে দিনে কেন, কীভাবে পিশাচ হয়ে যায়? পরিবার-সমাজের কী ঘাটতি ছিল? কী করলে মানবিক হতে পারতো? ঘটনা প্রেক্ষাপটে তার শাস্তি কী? শাস্তি প্রক্রিয়া তরান্বিত করণের উপায় কী? ঘটনা প্রেক্ষিতে শাস্তি বর্ধিত বা পরিবর্তিত হতে পারে কিনা? এমন অসংখ্য প্রশ্ন, প্রশ্নের উত্তর খোঁজা, সমাধানের পথকে এগিয়ে নেয়া এসব নিয়ে আমাদের মুখে কথা, মাথায় ব‍্যথা কম। বরং ধর্ষণ ব‍্যাধির জন‍্যে পুরুষের লোলুপতা নাকি নারীর পোশাক দায়ী এ নিয়ে তর্কের ব‍্যস্ততা। অনেকটাই ডিম আগে নাকি মুরগি আগে এ তর্কে ব‍্যস্ত রাখার মতো।

তেমনি স্ত্রী র্বষার পোশাকের প্রতি অতি অসচেতন আর ধর্ষণের শিকার নারীর পোশাকের ত্রুটি সম্পর্কে অতি সচেতন ‘অসম্ভবকে সম্ভব করা’ নায়ক অনন্ত জলিল দেশ ও জাতিকে দেয়া এক বয়ানে ধর্ষণের জন‍্যে নারীর পোশাককেই দায়ী করেছেন। অনন্ত সাহেব মূলত নায়ক কম, ব‍্যবসায়ী বেশি, তাই ভালো করেই জানেন এদেশে কোন কথার মার্কেট কেমন! তাইতো তিনি মানতে নারাজ এতে দায়ী পুরুষের রোষ, সস্তা পাবলিসিটির বাহানায় দিয়ে দিলেন পোশাকের দোষ। অন‍্যদিকে যারা ঠিক এই মার্কেটটি বুঝতে অক্ষম তারাই পড়ে যান স্রোতের বিপরীতে। ঠিক তেমনিভাবে বছর দু’এক আগে “ধর্ষণের জন্যে পোশাক দায়ী নয়” এই অতি সহজ সত্যটি বলতে গিয়ে মোশাররফ করিমের মতো অভিনেতাও পড়ে যান বিপাকে!

ধর্মের পোশাক পরিহিত ঝাণ্ডাধারীদের ফতোয়াবাজি তো আছেই, সেইসাথে নারীর পোশাক, চলাফেরার দায় চাপিয়ে ভিকটিম ব্লেমিং করে অপরাধ ধামাচাপা দেবার কী সস্তা প্রবণতা-ই না আমাদের!! যার জন‍্যে এমনও অনেক নারী আছেন, যারা সংসারে ধর্ষক পিতা, পুত্র, স্বামীর অপরাধ লোকলজ্জার ভয়ে আড়াল করে যান। হায়রে সভ‍্যতা! মাছ ঢাকতে সদা-সর্বদা শাকের আঁটি নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হয়! দিনে দিনে তাই সৎ এবং সত‍্যভাষণে আমাদের সাহসের দীনতা প্রকট হতে প্রকটতর হয়ে উঠছে।

যাক, যে লক্ষ্যে এতোকথা সেই মূলে আসি। স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিলাম রাস্তায় আকর্ষণীয় পোষাক বা সাজে কোনো নারীকে দেখলে অনেক পুরুষই স্বভাবত আকৃষ্ট হন। কেউ কেউ হয়তবা তার চেয়েও বেশী। কেউ শিস দিয়ে উঠে কিংবা পাশের জনকে খুঁচিয়ে বলতে পারে, ঐ দেখ, দেখ……….এখান থেকে সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে যে নারীর পোশাক বা সাজের জন্যে কেউ হয়তো অযাচিত আচরণ করে ফেলতে পারে এবং সেটা উর্ধ্বে ইভটিজিং পর্যন্ত যেতে পারে। কিন্তু রেইপ??? যারা রেইপড হয় তাদের সবাই কি এরকম আকর্ষণীয় পোশাক বা সাজ দিয়ে থাকে?

যুক্তির খাতিরে যুক্তি উত্থাপন কিংবা ফ্যাশনের নামে অনাবৃত পোশাকের পক্ষে আমিও নই। না একবারও বলছিনা, মেয়ে তুমি ইচ্ছেমত অনাবৃত পোশাক পরে ঘুরে বেড়াও। কিন্তু আমার সাফ কথা, পোশাকই যদি সম্ভ্রমহানিতার জন্যে দায়ী হবে, তবে এক বছরের কম বয়সী বা এক-দেড় বছরের ডাইপার পরা দুধের শিশুটির কী অপরাধ? কেন ধর্ষিত হতে হয় তাকে? প্রশ্ন রাখছি, তবে কি শিশুর ডাইপারও ধর্ষকের কাছে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী আকর্ষিক পোশাক?

বিবিসি সূত্র মতে, পোশাকের কারণে নারীরা ধর্ষণের শিকার হয় এমন মানসিকতার প্রতিবাদ জানাতে ২০১৮ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে রেইপড ভিকটিমদের পোশাক প্রদর্শনীর আয়োজন করে সেখানকার একটি সামাজিক সংগঠন। প্রতিবাদী এ প্রদর্শনীতে শ’খানেক নির্যাতিত নারী তাদের পোশাকের সাথে করে ‘মন্তব্য’ও জুড়ে দেন। ছয় বছর বয়সী বাচ্চার ফ্রক, স্কুল ড্রেস থেকে শুরু করে পুলিশের ইউনিফর্ম পর্যন্ত আছে সেখানে। Yes, a police uniform is also hung in the exhibit. সেইসময় একই প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিলেন কলকাতার জেসমিন পাথিজা। যাতে ছিল তার ১০ হাজার রেইপ ভিকটিমের পোশাকের ছবি সংগ্রহের প্রচেষ্টা। সেখানেও দেখা গেছে ‘উত্তেজক’ পোশাক থেকে শুরু করে ‘বোরখা’ পর্যন্ত বাদ যায়নি। সুতরাং এক্ষেত্রে পোশাক দায়ী, এই দাবি আসলে কতটা যৌক্তিক??

পোশাকের সাথে রেইপের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কিনা এ নিয়ে গবেষণাও কিন্তু থেমে নেই। কোন গবেষণাই কিন্তু সরাসরি এ ফল প্রকাশ করতে পারছে না যে পোশাকই দায়ী। মানছি ফ্যাশনের নামে অনাবৃত বা উগ্র পোশাকের সাথে টিজিং, এট্রাকশন, প্রপোজ, সেক্সুয়াল ইনটেনশন, এটুকু র্পযন্ত সম্পর্ক আছে বৈকি। কিন্তু সরাসরি রেইপের সাথে এর রিলেশন খুঁজতে গেলেই হিসাব পালটে যায়। পালটে যাওয়া সেই হিসাবের আঁধারেই সমীকরণের সমাধান আসে, একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকে চোখ বেঁধে অপরাধীকে উৎসাহিত করে ভিকটিমকে সুকৌশলে হ্যারাস করার অনন্য এক বাহানা মাত্র এই ‘পোশাক’। যে হিসাবটি স্রষ্টা প্রদত্ত মগজ আর নিজ কষ্টার্জিত জ্ঞানের কিঞ্চিৎ ব‍্যয়ে যে কারো পক্ষেই অনায়াসে মেলানো সম্ভব এবং সেইসাথে এ ও অনুভব করা সম্ভব, ভিকটিমের কাছে অন্ধ শ্রেণিটির ঋণের বোঝা কতটা বাড়ছে! অন্ধত্ব পায়ে ঠেলে যা সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেবার সময় এখনই।
আজ, এখন, এক্ষুণি সময় সবকিছু শুধরে নেবার!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.