খামোখা বিপদ ডেকে আনবেন না

ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস:

আমাদের দেশে সংক্রমণ ৩০,০০০ ছাড়ালো আজ। জীবনে কোন কোন সময় পরোপকারী এবং স্বার্থপর একইসঙ্গে হতে হয়। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন যা পেয়েছিলাম তা অলরেডি বন্টন হয়ে গেছে। তারপরও ডেইলি কয়েকটা ফোন পাচ্ছি ‘স্যার সম্ভব হলে একটু দেখেন।’ আমার দেখা যদিও ফুরিয়ে আসছে। এরা লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারছে না। এই নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি ডাক্তার, আইনজীবী, গবেষক, শেয়ার ব্যবসায়ী, প্রবাসী, সাংবাদিক ইত্যাদি ক্যাটাগরির লোকজনও আছেন। ভীষণ খারাপ লাগছে কথা বলতে না পারা, লাইনে দাঁড়াতে না পারা, অমুকের তমুকের বিশেষ উপহার না পাওয়া এসব নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য।

এরই মধ্যে আপনাকে প্রভোকেট করা হবে যে আসেন না একটু ইফতার করে যান। যাবেন না। আসো না বাবা, কতোদিন দেখি না তোরে। যাবেন না। আসো না বন্ধু, ক্লাব/রেস্টুরেন্ট স্যানিটাইজ করা আছে। যাবেন না। তোমার পরিবারে কেউ অসুস্থ না, আমার পরিবারেও না, চলে আয়। যাবেন না। আমাদের এখানে কোভিড কন্ট্রোলে চলে আসছে, সরকার বলেছে, গুল্লি মারেন। যাবেন না। একটু আদা আর গরুর মাংস নিয়ে আসি আগোরা, বেঙ্গল, মীনা বাজার, উলওয়ার্থ, কিংবা আলী থেকে। যাবেন না। অন্য ইয়াং কাউকে পাঠান এবং মাস্ক, স্যানিটাইজার সঙ্গে দেন, গোসল দিয়ে ঘরে ঢুকান।

ছোটখাটো মেডিক্যাল সমস্যার জন্য ডাক্তারকে ফোন করেন। ক্লিনিকে বা হসপিটালে যাবেন না। কেউ ঈদের গিফ্ট বা তেল বা ঘুষ পাঠিয়েছে, ঘরের দরজার সামনে রেখে দিন একদিনের জন্য। সাথে সাথে ধরতে যাবেন না। কারো ইলেকট্রনিক গেজেট ধরতে যাবেন না। কেউ বললো টাকা নিয়ে যান। যাবেন না। অন্য মাধ্যমে পাঠাতে বলুন। অফিসে যেতে উবার/ট্যাক্সি/রিক্সা/গণ পরিবহন এভয়েড করে হাঁটুন কিংবা নিজে ড্রাইভ করুন। অফিসের গাড়িতে গেলে একদম নাক-মুখ-হাত ঢেকে এক সিটে একজনের বেশি বসবেন না, কারো সাথে কথা বলবেন না গাড়িতে। অফিসের ভিতরেও নো কথাবার্তা, কাস্টমারকে দূর থেকে ডিল করুন (ইউটিউবে এ নিয়ে ভিডিও আছে, দেখে নিন)। পার্কে, জিমে যাবেন না, লিফ্টে অবশ্যই উঠবেন না। লিফ্ট একটা ডেঞ্জারাস জিনিস কিন্তু। কোথাও কোনো রেলিং বা সিঁড়িতে হাত দিবেন না।

বাড়ির ছাদে হাঁটাহাঁটি করুন, পার্কে গেলে একা একা হাঁটতে পারেন। বলবেন এতো এতো মানুষ বাড়ি যাচ্ছে, গার্মেন্টসে যাচ্ছে, তাদের তো কিছুই হচ্ছে না। কথাটি সঠিক নয়। ওদের ইমিউনিটি আর আপনার ইমিউনিটি এক নয়। এক হলে এরইমধ্যে কয়েক লাখ লোক রাস্তায় মরে পড়ে থাকতো। রাস্তায় রাস্তায় রিকশাওয়ালার লাশ পড়ে থাকতো। বস্তির পর বস্তি উজার হয়ে যেতো, তা কিন্তু হচ্ছে না ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা আফ্রিকাতে। কারণ গরীব মানুষের শরীরে এমনিতেই প্রচুর মাইক্রো অর্গাজম থাকে যার মোকাবিলা তাদের ইমিউন সিস্টেম করে থাকে।

রাস্তার পাশে যে ফুচকা আর চটপটি বিক্রি হয় তাতে গু-মুতের জীবাণু পাওয়া গেছে। তাতে যারা এগুলো খায় তাদের কিছুই হয় না। কিন্তু একজন বিদেশী গিয়ে খাওয়া মাত্র তার পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে যায়। দেশে দেশে ডাটা এনালাইসিস করে দেখা যাচ্ছে করোনা একটা উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের ভাইরাস। ফলে এতে আক্রান্ত বেশি হচ্ছে ঐ শ্রেণির মানুষ, আক্রান্ত হচ্ছেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, মুনতাসির মামুন, কর্নেল ডা. নুরুজ্জামান, ব্যাংক কর্মকর্তা, পীর সা’ব, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সুশীল, আর ফ্রন্ট লাইন ওয়ার্কাররা। অবশ্য সহজে গিয়ে ধরা দিলে সে কাউকেই ছাড়বে না, না গার্মেন্টস কর্মী, না শপিং করতে যাওয়া লোকজন, না ট্যাক্সি ড্রাইভার।

ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস

নিউইয়র্কে এবং লন্ডনে এতো বাঙালি আক্রান্ত হওয়ার পিছনের ইতিহাসটা তাই। এদের বেশিরভাগই হয় ট্যাক্সি ড্রাইভার না হয় লাউটা, কদুটা, কিংবা কাচকি মাছ কিনতে গিয়ে ঘরে নিয়ে এসেছে করোনা। মনে রাখবেন, পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের বেশিরভাগই কিন্তু আক্রান্ত হয়েছে তাদের ঘরে। আর একটা কথা মনে রাখবেন পৃথিবীতে একমাত্র হেপ-সি ছাড়া আর কোন ভাইরাসের তেমন কোন কার্যকর ঔষধ কিন্তু বের করা যায় নাই। যেমন যুগ যুগ ধরেও গবেষণা করে এইডস, ইবোলা, ইয়েলো ফিভার, রস ফিভার, ডেঙ্গি, চিকনগুনিয়া, সার্স, মার্সের কোন কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার করা যায় নাই।

ফলে করোনার ঔষধ বা ভ্যাকসিন নিয়ে চিন্তা বাদ দেন। উপসর্গ দেখে দেখে এসব ফ্লু ভাইরাসের চিকিৎসা করতে হয়। একমাত্র প্লাজমা থেরাপি কিছুটা প্রমিজিং, কিন্তু তারও রয়েছে অনেক ধকল। এতো সোজা মনে কইরেন না। এমনও হয়েছে এই আমাদের সিএমএইচএসে যে একজন মেজরকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত প্রায় ৫০ ধরনের ঔষধ প্রয়োগ করতে হয়েছে। তা আপনি তো কোন উচ্চ মহল বা চেতনার বুদ্ধিজীবী না, ফলে আপনার এসব চিকিৎসা পাওয়ার কথা চিন্তা না করলেও চলবে।

আর একটা কথা, অবশ্যই এই ঈদে মধ্যবিত্ত এই আপনি বাড়ি যাবেন না, জামাতে যাবেন না, কারো বাসা থেকে আসা সেমাই বা পোলাও টাচ করবেন না। জীবনে বহুত খাইছেন, এইবার করলাভাজি আর কুমড়োর মুরুব্বা দিয়ে ঈদ করেন আর বসে বসে মুড়ি খান অন্তত আরো ৬০ দিন (অবশ্যই ঈদ করবেন তবে শুধুমাত্র পরিবারের সাথে)। অবশ্যই নো কোলাকুলি, নো পায়ে হাত দিয়ে ছালাম। পা এবং জুতা সিম্পলি ডেঞ্জারাস!

খারাপ সময় কেটে যাবেই। মানবজাতি এর আগেও এরকম খারাপ সময় পেরিয়ে সূর্যালোকের দেখা পেয়েছে। তবে খামাকা খারাপ সময় টেনে আনবেন না নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য।

জ্যাক মা কি বলছে সেটা কমেন্টে দেখেন। আপনি কোন স্বর্গে বা নরকে আছেন সেটি বিবেচনা করে কিন্তু সে কথাটা বলে নাই। সে কথাটা বলেছে সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যে। সায়েন্স না পড়লেও কাম টু সেন্স, যারা সায়েন্স বুঝে তাদের কথা শুনুন। ভালো থাকুন।

স্বাস্থ্য সমাজবিজ্ঞানী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২২/০৫/২০২০

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.