আমার আম্মু যখন আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু

রুখশানা টিনা:

মনে আছে, আমার ছোটবেলায় আম্মুর ক্লাশ বা পরিক্ষার সময় আম্মু আমাকে সাথে নিয়ে যেতেন, সবসময়। আম্মু পরীক্ষা দিতেন, আমি আর আব্বু বাইরে অপেক্ষা করতাম। কিছু সময় পর আব্বু আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ঘুরে দেখাতেন, আর নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতে শেখাতেন। নতুন নতুন জিনিস এবং ঘটনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। অনেকটা সময় পাবার কারণে কিনা জানি না, আব্বুর সাথে আমার বেশ ভালো একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল। আম্মু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হওয়ার কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়টাও আমার আপন হয়ে গেল। মাঝে মাঝে তো আব্বুর দৃষ্টির সীমানার ভিতরে তো একা একাই ঘুরে বেড়াতাম। মনে অনেক সাহস ছিল, এটা আমার আম্মুর বিশ্ববিদ্যালয়। এতোকিছুর মধ্যে আম্মুর সাথেই সখ্যতা গড়ে ওঠেনি তখন। কিন্তু এখন আম্মুই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।

পরীক্ষা শেষে সময় পেলেই আম্মু আমাকে নিয়ে যেতেন জাদুঘর, চিড়িয়াখানা অথবা পদ্মার পাড়ে। আমার বিনোদনের জন‍্য। সামান‍্য পরিমাণ সময় পেলেও আম্মু এটা করতেন। কিন্তু যদি কখনো সময় না থাকতো তখন আমার খুব অভিমান হতো। সারা রাস্তা গাল ফুলিয়ে থাকতাম, বাসায় এসেই কান্না। আম্মু শুধু একটাই কথা বলতেন, “অন‍্যায় আবদার করতে হয় না মা, তোমাকে পরিস্থিতি বুঝতে হবে না?” আব্বু আহ্লাদ দেখাতে আসলে বলতেন, “ওকে কাঁদতে দেন, ওকেও তো বুঝতে শিখতে হবে। এখন ছোট্ট আছে, কিন্তু ধীরে ধীরে বড় হবে। অভ‍্যাসগুলো থেকে যাবে।”

আবার কেউ আমাকে অন‍্যায়ভাবে বকা দিলে বা আমার পাওনা না পেলে সোজা ছুটে আসতাম আম্মুর কাছে অভিযোগ নিয়ে। তাকে তো কিছু বলতোই না, উল্টো আমিই বকা খেতাম। কারো সম্পর্কে নালিশ করে নিজে বকা খাবার ব‍্যাপারটি আমার একদমই পছন্দের ছিল না। আম্মুর উপর খুব রাগ হতো। কিন্তু এখন খুব গর্ববোধ হয় আমার আম্মুর এমন বুদ্ধিমত্তার জন‍্য।

অনেক অপ্রয়োজনীয় আবদার না মানায় আম্মু ধীরে ধীরে আমার খুব অপ্রিয় একজন মানুষ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন আম্মু আমার সবচেয়ে প্রিয় সবচেয়ে কাছের।

আমার মনে হতো, অফিস বাদে আম্মুর বাকি সব সময়ই আমার। কিন্তু আম্মু সবার প্রিয় হবার কারণে সবাই আম্মুর কাছে সময় চাইতো। প্রিয় বৌ, প্রিয় বৌ মা, প্রিয় ভাবী, প্রিয় চাচী, প্রিয় জা ইত‍্যাদি হয়ে উঠলেও আমার মনে হতো প্রিয় মা হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু এখন বুঝি আম্মু সবকিছু ছাড়িয়ে একজন ভালো মানুষ। আমার আম্মু সবার থেকে বেশি প্রিয় আমার কাছে।

দোকানে কোন ভালো জিনিস দেখলে নিজের বিলাসিতা বাদ রেখে আমার জন‍্য সেই জিনিসটা নিয়ে আসতেন। কিন্তু আমার আবদার করা জিনিসটি দিতে ইচ্ছে করেই দেরি করতেন যেন আমার ধৈর্য্য এবং অপেক্ষা করার ক্ষমতা বাড়ে। নিজের আবদারের জিনিস না পেয়ে খুব অভিমান হতো। একটা সময় মনে হতো আম্মু আসলে আমাকে ভালোই বাসে না। আম্মু বলতেন,”যখন বড় হবা তখন বুঝবা, তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি।” ঐ সময় কথাটা অযৌক্তিক মনে হলেও এখন এই সময়ে দাঁড়িয়ে কথাটা খুব সত্যি।

আমি কারো সম্পর্কে আম্মুকে কিছু বললে আম্মু তা শুনতেন না। হোক সে ছোট বা বড়। বরং আমাকে বকা দিতেন, যেন আমি কখনোই কারো নিন্দা না করি। ভালো কথা বলতে না পারলে যেন চুপচাপ থাকি। খুব রাগ হতো। সবার মা সবার কথা শোনে সবাইকে সাপোর্ট করে আমার আম্মু করে না। আমি মনে হয় আম্মুর কেউ না।

আম্মু সবসময় আমাকে কাছে নিয়ে পড়াশোনা করতেন, অফিসের কাজ করতেন। তাতে আম্মুর ক্লাসের পড়া আর অফিসের কাজ ছিলো আমার মুখস্থ। এখন বুঝি আম্মু আমাকে কাছে রাখতে কতটা ভালোবাসতেন। আমাকে কাজের সাথে, লেখাপড়ার সাথে পরিচয় করাতেন। এমন অনেকদিন গেছে আব্বু পাশে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন, আমি আম্মুর কোলে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছি। ঘুম ভেঙ্গে দেখি আম্মু পড়ছেন। পরদিন সকালে রান্না করে আমার টিফিন, আব্বুর টিফিন, দুপুরে কী খাবো সবকিছু তৈরি করে নিজে অফিসে গেছেন। এতো অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেও তাকে আমি সবসময় হাসিমুখে থাকতে দেখেছি।

মাঝে মাঝে বাসার ছোট ছোট কাজের দায়িত্ব আমার উপর পড়তো, না পারলে সহযোগিতা পেতাম। কিন্তু থাকতো। আম্মুর উদ্দেশ্য ছিল কোন কাজকে যেন আমি কখনো ছোট করে না দেখি।

অফিস লেখাপড়া স্বামী সংসার সন্তান প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন সবকিছু সামলে নিজের জন‍্য সময় পেতেন কতটুকু, চিন্তার বিষয়। আমার খুব রাগ হতো, কিন্তু আম্মু কথা শুনতেন না। বলতেন, প্রতিবেশীরা সবাই আপনজন, মিলেমিশে থাকতে হয়। বিপদে আপদে তারাই সবার আগে এগিয়ে আসে।

কখনো আমি আমার কোন কিছুর অভাব বুঝতে পারি নি । প্রয়োজনীয় সবকিছু চাহিবার আগেই সামনে হাজির থাকতো। আমার স্কুলের পোশাক, টিফিন বক্স, বই-খাতা এবং আমার স্কুলে যাবার ব‍্যবস্থা সবকিছুই প্রস্তুত থাকতো। নিজে পছন্দের পোশাক না কিনে আমার জন‍্য পছন্দের একাধিক পোশাক কিনে আনতেন। কোথাও একা দাওয়াত খেতে হলে, আমার জন‍্য কিনে নিয়ে আসতেন যেন আমিও খেতে পারি। যেটা আমার খাওয়া নিষেধ সেটা আম্মুর শত পছন্দের হওয়া সত্ত্বেও কখনও খেতে দেখিনি।

খাবারের পুষ্টিমানের বিষয়টি তাঁর নখদর্পণে থাকায় সব থেকে বিপদে পড়তাম আমি। প্রিয় খাবারগুলো সবসময় না পাওয়ায় খুব রাগ হতো। শর্ত ছিল প্রিয় খাবারগুলো মাসে একবার পাবো। মনে হতো আম্মু আমাকে ভালোবাসলে কখনোই এমনটা করতে পারতেন না। এখন মনে হয় , ভালোবাসেন বলেই এতো ত‍্যাগ।

আব্বুর স্কুলের কাজের সহায়ক ছিলেন আম্মু, পাশের বাড়ির অসুস্থ মানুষের সেবা করতেন আম্মু। সুবিধা-অসুবিধায় সবার আগে মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে যান আম্মু। সবার ভরসার জায়গায় আম্মু। আমার খুব রাগ হতো, এতো কেন? নিজের কথাটাও তো একবার ভাবতে হবে! এখন বুঝি কেন। অনেকটা সময় লেগেছে বুঝতে, কিন্তু বুঝেছি। তাই খুব গর্ব বোধ হয়।

মনে আছে, আম্মুর মাস্টার্স পরীক্ষার সময় অফিস থেকে খুব কষ্টে ছুটি নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে হবার কারণে আমরা খালার বাড়িতে ছিলাম। ঠিক শেষ পরীক্ষার আগের রাতে আমার জ্বর। ১০৩/১০৪°। সারারাত আমার পাশে জেগে মাথায় পানি ঢাললেন জলপট্টি দিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন সকালে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, জ্বর কমলো না‌। সবাই নিষেধ করেছিল যেতে, কিন্তু আম্মু গিয়েছিলেন পরীক্ষা দিতে চোখ ভরা জল নিয়ে। শুধুমাত্র আব্বুর উপর ভরসা রেখে। মনে আছে আব্বু বলেছিলেন, “তুমি যাও আমি আছি তো”। কিন্তু আম্মু বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। পাশ করার মতো উত্তর দিয়েই পরীক্ষার হল থেকে চলে এসেছিলেন।

আম্মুর সুবাদে মনে হয়, মিষ্টি আর আইসক্রিম আমার অতি প্রিয় খাবার। একবার অসুস্থ হবার কারণে আমার ওপর আইসক্রিম এর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। এরপর থেকে আম্মু তার এতো পছন্দের আইসক্রিম আর খান না। কারণ আম্মু খেলে আমি খেতে চাইবো। কিন্তু আমি আম্মুকে দায়ী করতে শুরু করলাম আমার পছন্দের খাবার আমাকে খেতে দেবে না বলে নিজেও খায় না।

এতো বাঁধা এসেছে তবু থেমে যাননি। চাকরি, সংসার, পড়ালেখা, সন্তানের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠা, সুস্থ পরিবেশ, সুসম্পর্ক, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সবকিছু সামলেছেন একা। এতো ব‍্যস্ততার মাঝে আমার গুরুত্ব ছিল সবার আগে। এটা এখন বুঝি।

আম্মুর জীবনে আব্বুর অবদান অনেকটা। এটা না বললেই নয়। ঠিক তেমনি আব্বুর জীবনে আম্মুর অবদান অপরিসীম।

একটা সময় পর্যন্ত খুব রাগ হতো, খুব অভিমান হতো, কিন্তু আম্মু বলতেন, বড় হও তখন বুঝবা। সত্যিই এখন বুঝি। আমার আম্মুর জন‍্য আমি গর্বিত। আগে মনে হতো আম্মু পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ আম্মু। কিন্তু না আমার আম্মু পৃথিবীর সবথেকে ভালো আম্মু , তার থেকে বড় কথা আম্মু একজন ভালো মানুষ। সবাই পছন্দ করে বলে হিংসে নয় বরং গর্ব হয়।

সমানে চলার পথে চারপাশ থেকে অনেক বাধা এসেছে, কিন্তু থেমে যাননি, অনেক বিপদ এসেছে কিন্তু ধৈর্য্য হারাননি। এই হার না মানা আমার আম্মুর জন‍্য অনেক অনেক ভালোবাসা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.