ওয়ার্কিং ফ্রম হোম: প্রেক্ষিত কোভিড-১৯

শাহাজাদী বেগম:

আসসালাতু খায়রুম মিনান্নাওম……………

বীথির ঘুম ভেঙ্গে যায়। একদিকে তমাল এক হাতে ওকে জড়িয়ে আছে, অন্যদিকে তিন বছরের স্নেহা ডান হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। নড়াচড়ায় যেন ঘুম না ভাঙ্গে, তাই আলতো করে তমালের হাতটা সরিয়ে পাশ ফিরে আস্তে আস্তে উঠার চেষ্টা করতেই তমাল হাতটা টেনে ধরে। ‘আরেকটু ঘুমোও’ বলেই বীথিকে জড়িয়ে নাক ডাকতে থাকে। সে সাবধানে হাতটা সরিয়ে স্নেহা’র গায়ের উপর দিয়ে উঠে পড়ে। ফজরের নামাজ, শিথিলায়ন শেষে দুইটা তলপেটের জন্য আসন। তিন তিনটা সিজারিয়ান ডেলিভারি-এটুকু করতেই হয়। পেশাগত উৎকর্ষতার সাথে ফিগার, গ্ল্যামার এসব এই যুগেও নারীর যোগ্যতার অংশ হয়েই আছে।

সাধারণত: এর পরেই গোসল সেরে অফিসের জন্য তৈরি হয় বীথি। কিন্তু এখন কোভিড-১৯ এর কারণে ওয়ার্কিং ফ্রম হোম চলছে তাদের দুজনেরই। তিনজন ছুটা সহকারি, ড্রাইভার সবাই গ্রামে চলে গেছে। কাজেই সবকিছু এখন তাকেই সামলাতে হচ্ছে। বীথি ছেলেদের রুমে যায়। ছেলে দুটো অঘোরে ঘুমোচ্ছে। দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খায়। ছেলে দুটো এতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে!

নাস্তার জন্য আটার রুটি, সবজি আর ডিম পোচ, সাথে কাঁচা রসুন, ভেজানো কাঁচা ছোলা, আদা কুচি, কালোজিরা লবন-কাঁচামরিচ, ধনেপাতা ও লেবুর রস দিয়ে মাখানো। এইসব ভেষজ শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ঠাণ্ডা-সর্দি এসবও প্রতিরোধ করে বলে প্রচার করা হচ্ছে। এমনি এমনি তো আর কেউ মুখে তুলবে না, তাই সব মাখিয়ে সালাদের মতো করা হয়েছে। ক্ষতি যেহেতু নেই, তাই খেতেও সমস্যা নেই। পরিবারের সুরক্ষার জন্য এটুকুতো করাই যায়।

তমালকে বেডটি দিয়ে এসে টেবিলে নাস্তা লাগিয়ে গোসলে যাবে ভাবতেই স্নেহার কান্নার আওয়াজ। বীথি স্নেহাকে থামাতে বিছানায় ওর পাশে আবার শোয়। অনেকটা সময় লাগে স্নেহাকে আবার ঘুম পাড়াতে। বীথির অফিস সাধারণতঃ আটটায়। এখন বাসায় থেকে অফিস, তাই সাড়ে আটটায় অনলাইনে থাকতে হয়। শুরুতেই টিম মিটিং। সে টিম লিডার ফরিদ ভাইকে রিকোয়েস্ট করেছে টিম মিটিংটা সকাল ৯টায় করার জন্য। এই ফাঁকে বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে নাস্তাটা করানো যায়।

বীথি পূর্ব আর ধ্রুবকে ঘুম থেকে উঠায়। ওরা ফ্রেশ হয়ে এলে একসাথে নাস্তা করবে। হঠাৎ মনে পড়লো মিটিং এ যেই ডকুমেন্টটা নিয়ে আলোচনা হবে সেটা দেখাই হয়নি। তাড়াহুড়ো করে এক নজর চোখ বুলিয়ে কিছু ফিডব্যাক মার্ক করে রাখলো।

তমাল বরাবরের মতো সকালে গোসল সেরে অফিসের কাপড়-চোপড় পরে নাস্তাটা করে নেয়, তারপর কফির মগ হাতে ল্যাপটপে নিজের ডেস্কে। মিটিং, ট্রেনিং, নতুন নতুন কনসেপ্ট নোট তৈরি, প্রাথমিক বাছাই হওয়াগুলোর আবার প্রপোজাল লেখা-ফিডব্যাক, লগ ফ্রেম, ইমেইল, তার মাঝেই ফেইসবুকিং আর একটু টিকটক। ওয়ার্ল্ডোমিটারেও নজর রাখতে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তের আপডেট এর জন্য। উহঃ এত্তো ধকল যাচ্ছে! একমগ কফি হলে ভালো হতো!

বীথি…বীথি… সাড়া না পেয়ে কফির কথা বলার জন্য নিজেই বাইরে আসে, ডাইনিং রুমে পা দিয়ে তমাল দাঁড়িয়ে পড়ে –

– ফরিদ ভাই, আরেকবার বলবেন, আমি মনে হয় পয়েন্টটা মিস করেছি।
– আপনি একদম মনযোগী না বীথি
– সরি ভাই
– একটুপরে ওয়েবিনার এ যে মিটিংটা হবে সেখানে বিভিন্ন দেশের লোকজন থাকবে, চীন থেকে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতাও জানাবে। দয়া করে তখন এমন অমনোযোগী হবেন না প্লিজ।
– জি ভাই

ডাইনিং টেবিলে ল্যাপটপের স্পিকার অন করে অনলাইন মিটিং চলছে। সামনে বড়ছেলে দুজন হোয়াটসআপ এ পাঠানো স্কুলের ওয়ার্কশিটগুলো করছে, কোলে তিন বছরের মেয়েটাকে নাস্তা খাওয়ানোর জন্য যুদ্ধ চলছে, সেইসাথে মিটিং সারছে, ভাগ্যিস ভিডিও ক্যামেরা বন্ধ রাখা যায়। নিজের নাস্তার প্লেটটা সামনেই পড়ে আছে, খাওয়ার সময়ই পায়নি। ১১ টা বেজে গেছে। আবার দুপুরের রান্না চড়াতে হবে।

তমালের মায়ের কথা মনে পড়ে। পাঁচ ভাইবোনের সংসার, বাবা সাধারণ চাকুরীজীবী। মা নিজেই সারাদিন সংসারের যাবতীয় কাজ করতেন, তবুও কোনদিন মেয়েদেরকে সংসারের কাজে হাত দিতে দেননি। তাদের ছোট ক্লাসের পড়াশোনাও তিনিই দেখতেন। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সেলাই নিয়ে বসতেন। মায়ের হাতের কাজ এতো সুক্ষ আর নিখুঁত ছিল! ওর মনে হতো মা হলো দূর্গার মতো দশ হাতে কাজ করে। হঠাৎ তমালের চোখ ভিজে ওঠে, বীথিটাও একা হাতে কতকিছু সামলাচ্ছে!

সে বীথির কোল থেকে স্নেহাকে নিয়ে পাশের চেয়ারে বসে নাস্তা খাওয়ানোর চেষ্টা করে। বীথি কিছুটা অবাক হয়ে তমালের দিকে তাকায়, তমাল ইশারায় আশ্বস্ত করে – সে স্নেহাকে দেখছে, ও যেন মিটিংয়ে মনোযোগ দেয়। বীথির চোখে-মুখে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়, এতো অল্পতেও সুখী হয়!

লেখক: উন্নয়নকর্মী

শেয়ার করুন: