“Me too“ আর না!

তাসলিমা শাম্মী:

ফাতেমা বুয়ার আট বছর বয়সী মেয়েটার উপর নাকি কিছুর বাতাস লেগেছে! ফাতেমার মতে, খারাপ কিছুর বাতাস! সে মানুষ দেখলেই ভয় পায়! মেয়ের সারা গায়ে নাকি জ্বিনের নখের আঁচড়, কারণ সে সারাদিন কারো সাথে মিশে না বা খেলে না, তাহলে গায়ে আঁচড় দেয় কে? ফাতেমার মতে, খারাপ জ্বিন। যেদিন মেয়েটাকে নিয়ে ফাতেমা আমার বাসায় এসে উঠে, সেদিন আমি লক্ষ্য করলাম মেয়েটা বেশ মিষ্টি চেহেরার, কিন্তু ভীষণ নোংরা হাত-পা। মেয়েটা সারাদিন রান্নাঘরের এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকে।

আমি একদিন কয়েকটা ফুল পাতা প্রিন্টের জামা এনে ফাতেমাকে বললাম,
“ভালো মতন গোসল করিয়ে জামা পডরিয়ে তোমার মেয়েকে আমার রুমে নিয়ে আসো”। লক্ষ্য করলাম, আমার কথা শুনে মেয়েটার কচি মুখ একেবারে কালো হয়ে গেল! আমি ওর মুখ হাত দিয়ে ছুঁয়ে বললাম, “কী মিষ্টি একটা মেয়ে, এতো নোংরা থাকলে হবে? এখুনি ভালো করে সাবান ডলে গোসল করে, নতুন জামা পডরে আমার রুমে আয়। আমি তোকে একটা নতুন জিনিস দেখাবো”।

অবাক হয়ে দেখি আমার কথা শুনে ওর চোখে পানি জমছে!
ফাতেমা আমাকে নিচু গলায় বলে, “বলছিলাম না আপা, পরীর উপ্রে খারাপ বাতাস আছে। সে কারো আদর মহব্বত সহ্য করতে পারে না। এখন দেখবেন চিক্কুর দিয়ে শুরু করবে কান্দন”।

আমি খুব বিরক্ত গলায় ধমক দিয়ে ফাতেমাকে বলি, “এখুনি ওকে গোসল করাও। সাবান শ্যাম্পু সব দিয়ে গোসল করাও। জামা জুতা পরাও, তারপর আমার রুমে আসো। আমি বাতাস দূর করে দেবো”।
আমার ধমক খেয়ে ফাতেমা মেয়েকে গোসল করাতে নিয়ে গেল। মেয়েটা গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। আমার খুবই বিরক্ত লাগে মেয়েটার কান্না দেখে, কিছুটা অবাকও লাগে।

অনেকক্ষণ কাঁদার পর ফাতেমা পরীকে নিয়ে আমার রুমে আসে। পরী তখনো ফোঁপাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার গলা ভেঙ্গে গেছে, চোখ লাল হয়ে আছে রক্তের মতো। আমি পরীকে কাছে টেনে বলি, “এভাবে কাঁদার কী আছে বোকা মেয়ে!” পরী আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

ওর চোখে কেমন জানি ভয়, ঘৃণা আর অবিশ্বাস মিশানো। আমার মাথায় ভয়ংকর কিছু চিন্তা আসলো। আমি ফাতেমাকে বলি, “ফাতেমা, ও কাঁদুক, তুমি ওর কাপড় খুলো আমার সামনে”। পরী প্রচণ্ড ভয়ের চোখে আমাকে আর ওর মাকে দেখছে। ফাতেমা আর আমি জোর করে পরীর জামা খুলি। দেখি ওর সারা গায়ে চিকন নখের আঁচড় কাঁটা, কিছু আঁচড় শুকিয়ে রক্ত কালো হয়ে আছে!

পরী চিৎকার করে কাঁদছে। আমার মাথায় খুন চেপে গেছে। আমি ফাতেমাকে বলি, “ওর প্যান্ট খুলো দেখি”। প্যান্ট খুলেও দেখা যায় একই রকম আঁচড়ের দাগ! পরী কাঁদছে। ফাতেমা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “হুজুরের ফুঁ দেয়া পানি খাইয়েও কাজ হয়নি আপা। বদ জ্বীনের আছর”।

ফাতেমাকে জিজ্ঞেস করি, “আগে যে বাসায় কাজ করতা, সেখানে কে কে ছিল”?
ফাতেমা জানায়, সেই বাসায় খালু, খালাম্মা আর তাদের দুই ছেলে ছিল। খালু আর খালাম্মা ফেরেশতার মতোন মানুষ, সারাদিন বাসায় থাকে। আর উনাদের দুই ছেলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। রুম থেকে বেরই হয় না বাসায় থাকলে। খুবই ভালো একটা পরিবার, কিন্তু এই মেয়ের উপ্রে হঠাৎ করে বাতাস লাগাতে উনাদের বাসা ছাড়তে হয়।

আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফাতেমাকে বললাম, পরীর উপর তোমার ফেরেশতার মতন খালু আর উনার দুই শিক্ষিত পুত্রের বদ বাতাস লেগেছে। এই বাতাস বদ জ্বীনের বাতাসের চেয়েও খারাপ। আর পরীর গায়ের সব আঁচড় ওর নিজের নখের। সে নিজের কোমল শরীরকে নিজের শত্রু ভাবতে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। পরী নিজের শরীর আঁচড়ে, নোংরা করে নিজেকে অন্যের বদ নজর থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে।

তাসলিমা শাম্মী

উপরের গল্পটি কিন্তু কাল্পনিক নয়। এটি আমার গত বছরের ট্রেনিং পিরিয়ডের একটা কেস। আমি শুধু আমাদের আশেপাশের পরিবেশের সাথে মিশিয়ে উপস্থাপন করলাম।

* আচ্ছা, আপনি কি কখনো লক্ষ্য করে দেখেছেন আপনার বাচ্চাটা পরিবারের বা কাছের কাউকে একটু বেশি লজ্জা বা ভয় পাচ্ছে কিনা?
* তিন বছরের পর থেকে ছেলে অথবা মেয়ে যা-ই হোক না কেন, বাচ্চাকে কখনোই অন্যের সামনে আনড্রেস করবেন না। এমনকি ওর বাবার সামনেও না। গোসল বা টয়লেটে তার সাথে আপনি গেলে দরজা বন্ধ করে দিবেন। তাহলে সে নিজে থেকেই শিখতে পারবে তার প্রাইভেসি সম্পর্কে, মুখে বলে বুঝাতে হবে না।

* বাবাদের উচিৎ, আপনি আপনার মেয়েদেরকে শিখাবেন প্রাইভেসি জিনিসটা কী। আপনি নিজেই বলবেন, মূল্যবান জিনিস নিরাপদে রাখা মানেই অন্যরা চোর নয়, আর সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে আমাদের প্রাইভেসি। মেয়েরা আপনাকে আরো বেশি শ্রদ্ধা করবে, বিশ্বাস করবে। বাবা পরম নির্ভরতার একটা জায়গা, কিন্তু কখনো এই নির্ভরতার জায়গা থেকেও আঘাত আসতে পারে!

* কাছের দূরের কাউকেই এলাও করবেন না গাল টেনে আদর করতে, বাচ্চার সামনেই নিষেধ করবেন। এতে সেই মানুষটাও মনে কষ্ট আনবে না, আবার আপনার বাচ্চাও নিজে থেকে শিখে যাবে এটা করা যাবে না, করলে সে নিজেই আপনাকে জানাবে।
* আপনি কি জানেন, আপনার বাচ্চার সামনে কাজের মানুষকে বকাঝকা করা, স্বামী-স্ত্রী তর্ক করা চাইল্ড এবিউজ!
* উন্নত দেশে রাত দশটার পর থেকে টিভিতে বড়দের অনুষ্ঠান দেখানো হয়। সেটা হতে পারে রোমান্টিক ড্রামা বা ক্রাইম প্রোগ্রাম, যা স্ট্রং ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে কোড করে রাখা। আর আপনি সারা দিনরাত যদি রোমান্টিক ফিল্ম বা গান শোনেন, আপনার ঘরের বাচ্চাটা আপনার অজান্তেই সেক্সচুয়াল এবিউজের শিকার হচ্ছে!
হ্যাঁ, সেক্সচুয়াল এবিউজ খিস্তি গালি বা দুই জন এডাল্টের কথার মাঝখানে পরেও বাচ্চারা হয়! সেক্সচুয়াল এবিউজ আমরা যখন নিউজে ধর্ষণের খবর দেখি, তখনো পাশে বসে খেলতে থাকা বাচ্চাটা হয়! আমরা কয়জন তার খেয়াল রাখি!

সব রোমান্টিক দৃশ্যের ব্যাখ্যা বাচ্চারা নিজের মনে নিতে পারে না। বয়সের কারণে মনে এক ধরনের ফ্যান্টাসি আসে। এখানে বাচ্চারা প্রশ্ন করে, মম ড্যাড একসাথে ঘুমালে কেন বেবি হয়? ওদের উত্তর দেয়া হয়, মম ড্যাড এক সাথে বেবির জন্য উইশ করে। তাই ভোট বেশি হলেই গড বেবি দেয়!!

সবশেষে একটা কথা বলি, আপনি কি আপনার বাচ্চার শোবার রুমটা ওর বয়সের দিকে খেয়াল রেখে সাজিয়েছেন? সেটা কিন্তু হতে হবে ফুল পাখি প্রজাপতির মতো নিষ্পাপ কিছু ছবি দেয়া, সেটা হতে হবে বড়দের কঠিন কঠিন জটিল সব চিন্তা ভাবনা থেকে একদম ভিন্ন। শোবার বিছানার চাদরটাও, বালিশও হতে হবে নরম কোমল কল্পনার মতো।

আপনার এই ছোট্ট একটু খেয়াল রাখা বাচ্চাটাকে ” মি টু ” এর মতো মানসিক কষ্ট বয়ে বড় হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। আমরা চাই না আমাদের একটু বেখেয়ালের কারণে আমার বাচ্চাটা প্রিয়তী কিংবা সীমন্তির মতো মানসিক যন্ত্রণা বয়ে দিন কাটাক।

শেয়ার করুন: