সালমা লুনা:
২০১৭ সালের অক্টোবরে আমেরিকান অভিনেত্রী এলিসো মিলানো প্রভাবশালী ফিল্ম প্রযোজক হার্ভি ওয়েনস্টেইন এর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন। ওই অভিনেত্রী #MeToo লিখে টুইটারে হার্ভি ওয়েনস্টেইন এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পরপরই আরো প্রায় ৮০ জন নারীও এ প্রযোজকের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুললে হলিউড নড়েচড়ে বসে। ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে #MeToo একটা আন্দোলন হিসেবে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।
এ ঢেউ ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং নারীরা মুখ খুলতে শুরু করে। শুধু মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আসতে থাকে। তার জের ধরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাইকেল ফেলন, কেবিনেট মন্ত্রী ডেমিয়েন গ্রীন পদত্যাগে বাধ্য হন।
এরপর #Me Too নিয়ে সারাবছর টুকটাক কিছু শোনা গেলেও আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে এই আন্দোলনের ঢেউ তেমন করে এসে লাগেনি। সম্প্রতি মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নায়িকা তনুশ্রী দত্ত অভিনেতা নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলার পর থেকে আমরা দেখছিলাম অভিযোগ উঠা শুরু করেছে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব সুভাষ ঘাই, সাংবাদিক এম জে আকবর, সুরকার অনু মালিক, অভিনেতা রজত কাপুর, কৈলাশ খের এবং ক্লিন ইমেজের ‘বাবা’ অলোক নাথসহ অনেকের বিরুদ্ধে। বলিউড এই ধাক্কায় কিছুটা নিশ্চুপ থাকলেও এখন এর পক্ষে সরব হয়েছেন জুহি চাওলা, ক্যাটরিনা কাইফ, প্রিয়াংকার মতো হেভিওয়েট সেলেবরা। তারা এখন #MeToo আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা কানাকানি, ফিসফাস অনুমানকৃত ঘটনার বিভৎস সত্যরূপ।

এতোকিছু যখন চলছে পাশের দেশে তখনো চুপচাপ ছিলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মিডিয়া বা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নারীরা একেবারেই চুপচাপ ছিলেন।
কেন চুপচাপ বাংলাদেশের নারীরা?
তাহলে আমাদের দেশ এই বাংলাদেশে কি এইরকম ঘটনা নেই একেবারেই? পুরুষরা ‘সকলেই’ কি ভেতরে বাইরে একইরকম? লোভ লালসাহীন, সচ্চরিত্র, পরোপকারী। নারীকে শ্রদ্ধা-ভক্তি সম্মান করে সকলেই!
একথাও যে সম্পূর্ণ সত্য নয়, আমরা তা খুব জানি। #Me too এর ট্যাগ না দিয়েও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে কখনো কোন নারী তার সাথে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে মাঝেমধ্যেই মুখ খোলেন। কিন্তু সেই মুখ খোলার পর কী ঘটে?
আমরা দেখেছি ফারিয়া মুখ খুলেছিলেন। মুখ খুলেছেন বাঁধন। অতি সম্প্রতি মুখ খুলেছেন প্রিয়তী। ওই ঘটনাগুলোর একটা প্যাটার্ন আছে। ওই ঘটনাগুলোর সাথে কাজ পাইয়ে দেয়ার, বা কর্মক্ষেত্রে সুবিধাদি দেয়ার মতো কিছু বিষয় জড়িয়ে থাকলেও ওই নারীরা কিন্তু প্রতিকূল স্রোতেই সাহস করে বলে চলেছেন। এই সাহস তাদের সেই তথাকথিত জয় এনে দেয়নি, অপরাধীকে আইনগত বা সামাজিকভাবে শাস্তি দিতে পারেনি। বরং হেনস্থা সহ্য করতে হয়েছে। হেনস্থা করতে পুরুষের সাথে নারীরাও পিছপা হয়নি।
ফলাফল, অন্য অনেক নারীই এসব দেখে পিছিয়ে গেছেন। তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনাটি নিয়ে আর মুখ খোলার সাহস করেননি।
সদ্যই আরেকটি ঘটনা প্রকাশ করেছে শুচিস্মিতা সীমন্তি নামের এক তরুণী, যা এসব থেকে আলাদা। সীমন্তি অনলাইন পোর্টাল উইমেন চ্যাপ্টারের ইংরেজি ভার্সনের সম্পাদক। সিনিয়র সুপরিচিত সাংবাদিক সুপ্রীতি ধরের কন্যা।
সীমন্তির কৈশোরের ওই ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে হতবাক করেছে। কারণ সীমন্তি যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তিনি একজন সুপরিচিত মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব। সেই ব্যক্তিটি একেবারেই পারিবারিক আবহে, মায়ের বন্ধু সেজে থেকে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক একটি কিশোরী মেয়েকে যৌন হেনস্থা করেছেন।
কিশোরী সীমন্তি ঘটনাটি কাউকে বলতে না পেরে মানসিক কষ্টে জর্জরিত হয়েছেন। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে এসেও ওই বেদনা আর ঘৃণা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে অবশেষে উগড়ে দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এত বছর পর।
সেমন্তী কোন সুবিধা চাননি। কোন প্রতিশোধ নিতে চাননি। এমনকি অপরাধীর নামটি পর্যন্ত নেননি। বেদনায় মুষড়ে পড়তে পড়তে ভাবি কেন শুচিস্মিতা সীমন্তি সেই অপরাধীর নামটি নিতে পারলেন না। কেন শুধু ওই ঘৃণ্য মানুষটির নামের অাদ্যাক্ষরটুকু জানালেন সবাইকে।
আমরা নিশ্চয়ই জানি কেন।
জানি সীমন্তি কেন তার কোন বিচার দাবি করেননি। এইরকম হেনস্থার বিচার চাইলে এদেশে যা ঘটে তাও আমরা জানি।
এ দেশে স্বাধীনভাবে চলে ফিরে কাজ করে উপার্জন করা নারীদের কী চোখে দেখা হয় তাও জানি।
ফলে ওই হঠাৎ মুখ খুলে ফেলা নারীটি নানা কারণে আঙ্গুল উঁচিয়ে অনেক সময় অপরাধীকে দেখাতে পারে না। তার নামটাও স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতে পারে না। সেই অপরাধীটি যদি প্রভাবশালী হয়, তবে তো কথাই নেই।
সীমন্তি যেমন তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন দলা দলা ঘৃণার থুতু।
সীমন্তির সাথে এই ঘৃণার থুতু আমরাও ছিটাই। থুতু ছিটাই ওইরকম সকল পুরুষদের দিকে যারা পরিবারের আত্মীয় হয়ে কিংবা বন্ধু সেজে ঢুকে শিশু বা কিশোর কিশোরীদের দিকে তার যৌনলালসাভরা ঘিনঘিনে হাত বাড়ায়। তাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় একটা অধ্যায়কে ভরে দেয় অবর্ণনীয় কষ্টে।
আমাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেলো এখন। আমাদের উচিত তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে উঠা অভিযোগকে আমলে নেয়া, অপরাধীকে প্রকাশ্যে আনা যাতে অন্তত আরেকটি শিশু বা কিশোর কিশোরী বেঁচে যায় সম্ভাব্য যন্ত্রণা থেকে। যাতে এইরকম অপরাধীরা তাদের ঘিনঘিনে হাতটি গুটিয়ে নেয় ভয়ে লজ্জায়।
সীমন্তির সাথে তাল মিলিয়ে আরো বলতে চাই, প্রতিটি পরিবার প্রতিটি পিতামাতা তার শিশু-কিশোর বয়সী সন্তানদের প্রতি সচেতন থাকবেন, তাদের দিকে লক্ষ্য রাখবেন। শুধু তাই না, যৌন বিষয়ে ন্যুনতম শিক্ষা দিন। তাদের ভালো আদর, মন্দ আদর, ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ সম্পর্কে শেখান। তাদের সাথে নিয়মিত এইসব বিষয়ে আলাপ করুন, কাউন্সেলিং করুন, যেন এইরকম কোন ঘটনা ঘটলে তারা ভয় পেয়ে বা লজ্জায় চেপে না যায়। বরং কীভাবে এসবের প্রতিবাদ করবে তা শেখান। সবাই মিলেই শিখি প্রতিবাদের ভাষা।
আমাদের আত্মজ-আত্মজা তথা উত্তরাধিকারকেও শেখাই সেই প্রতিবাদের ভাষা। যে প্রতিবাদ তাদের সুরক্ষা দেবে একজন যৌন নির্যাতকের কবল থেকে।