শিল্পী জলি:
আমার এক আমেরিকান কলিগ ছিল মাত্র তেইশ বছরের। এক মেয়ে সহ তার সেপারেশন ঘটে । যদিও সে সেপারেশনে রাজী ছিল না তথাপি বর চাওয়ায় তাকে বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয় বিষয়টি।
সে নিজে কাজ করছিল, মেয়েকে মানুষ করছিল। তবে আলাদা হয়েও সেপারেশনকে মেনে নিতে পারছিল না দীর্ঘ সময় লক্ষ্য। এভাবেই কয়েক বছর কেঁটে যায় তার। তেমনই দিনে এক কলিগ তার প্রতি আকৃষ্ট হয় যে সিঙ্গেল, সুদর্শণ, এবং মানুষ হিসেবেও যথেষ্ট উওম।
যখন জানলাম ছেলেটির প্রস্তাব সে ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন ফিরিয়ে দিলে ওর প্রস্তাব, ওতো অনেক ভালো মানুষ। সে উত্তর দিয়েছিল, আমারতো একটি বাচ্চা মেয়ে আছে তাই সহসা কোন ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারি না যদি আবার মেয়েকে…! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ছিলাম তার দিকে এই বয়সেই কতটা সচেতন সে সন্তানের নিরাপওা নিয়ে যেখানে সন্তানদেরই আলাদা করে শেখানো হয় কী করে বাবামায়ের মারকে রুখতে হয়, কোনটি সেক্সসুয়াল এ্যাবিউজ এবং রোধের উপায় কী।
সম্প্রতি, প্রিয়তী এবং সীমন্তি মিটু আন্দোলনে শরিক হয়ে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলেছেন জনাব রফিকুল ইসলাম এবং জনাব প্রণব সাহার বিরুদ্ধে। তাদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেয়েদের মতামত দেখে আমি রীতিমতো অবাক। অনেকেরই ভাবখানা এমন যেনো দেশে এই ঘটনা দুটোই প্রথম এবং দ্বিতীয় যৌন হেনস্থার ঘটনা এবং যথেষ্ট অবাক হবার মত।
যে দেশে ঘরে ঘরে কাজের মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়, যে দেশে ভীড়ে হাঁটতে গেলেই পুরুষের হাত মেয়েদের শরীরের কোথা দিয়ে যে কোথায় চলে যাবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই, সেই দেশে বসবাস করেও এটা কী এতোটাই অবাক হবার মতো কোনো বিষয়?
তবে অবশ্যই সীমন্তির বিষয়টিতে আমি অবাক হয়েছি। অপ্রাপ্তবয়স্ক যে কোনো মেয়ের সেফটি নিশ্চিত করা তার বাবা-মায়ের প্রধান দায়িত্ব এবং সেটুকু প্রজ্ঞা প্রতিটি অভিভাবকেরই থাকা উচিত যেনো সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। মায়ের বর বা প্রেমিক হলেই যে সন্তান তার কাছে নিরাপদ এমন কোনো নিশ্চয়তাও নেই।
যাই হোক, প্রিয়তী সেদিন সুবিধাজনক সময়ে সেক্স হবে প্রতিশ্রুতি দেবার মাধ্যমে যেভাবে ধর্ষণ থেকে বেঁচেছিল, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে আরও উত্তম পন্হা ছিল যখনই তার সাথীকে ঘর থেকে বের হতে বলা হয় পার্সোনাল কথার অজুহাত দিয়ে, তখনই বলা যেতো আমি চাই আলোচনায় সেও থাকুক। কাজ পাবার হলে সেটা এমনিতেই জোটে, সব শর্তে রাজী হবার দরকার পড়ে না।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে MeToo আন্দোলন কতটা প্রভাব ফেলবে? বলতে বাধা নেই দেশীয় অধিকাংশ ছেলেই মেয়েদের রেসপেক্ট করতে শেখেনি। এমনকি যৌন হেনস্থাকেও এখনও অনেকে মনে করে ফানি বিষয়। অথচ এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সেই সাথে আছে মেয়েদের পিছিয়ে থাকা চিন্তাচেতনা। অনেকেই মেয়েরা যৌন হেনস্থার শিকার হলে ভাবে, জীবন শেষ, তার জীবন এবং চরিত্রে আর কিছু বাকি নেই। সেইসাথে প্রেম বা বিয়েশাদিতেও মেয়েদের মূল্যায়ণ করা হয় তার যৌনাঙ্গের অস্পর্শতা এবং ভার্জিনিটি দিয়ে। আজীবন ভার্জিনিটি সুরক্ষাই যেনো মেয়েদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আর কোনো কাজ নেই এই জীবনে। সেই ভার্জিনিটি যদি হাত ছাড়া হয়, তাহলে আর সেই জীবনের মূল্য কী? অথচ যৌনাঙ্গ শরীরেরই একটি পার্ট মাত্র। নারীকে হাতের মুঠোয় রেখে ইচ্ছেমতো খেলাতে যৌনাঙ্গের উপর এতো গুরুত্ব আরোপ নারীকে কন্ট্রোলেরই একটি কৌশল।
পুরুষের হাতেই নারী যৌন হেনস্থার শিকার হয় আবার সেই পুরুষ সমাজই তাকে চরিত্রহীনতার খেতাব দিয়ে সিল লাগিয়ে দেয় যেনো সহসা আর ঘাড় সোজা করে দাঁড়াতে না পারে। নারীও হয়তো সেভাবেই চিন্তা করে, আমি শেষ, আমার জীবন শেষ, জীবন যেনো একটি ডিসপোসেবল গ্লাস। একবার ব্যবহারেই গার্বেজযোগ্য। অথচ যৌন হেনস্থার শিকার পুরুষও হয়। তারাও তখন মানসিক এবং শারীরিকভাবে আহত বোধ করে। কিন্তু তাদের উপর সামাজিক সম্মানহানি এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবার চাপ থাকে না। যেটা নারীদের ক্ষেত্রেও ঘটার কথা ছিল।
কিন্তু আমরা এখনও ততোটা সচেতন হতে শিখেছি কই! আর ওটাই এখনও নারীকে দমনের বড় অস্ত্র পুরুষের হাতে। নারীই ধর্ষণের শিকার হবে, আবার এর বদনাম এবং সার্বিক ক্ষতিও তারই। যেখানে আজও সেক্সের এস উচ্চারণেই নারীর চরিত্রের ধ্স নেমে আসে, সেখানে নারী কী করে ধর্ষণ ঠেকাতে ‘সেক্সে রাজী নই’ বলে চিৎকার করে উঠবে হঠাৎ করে? অথচ মিটু আন্দোলনের চেয়ে ধর্ষণ প্রতিরোধই উত্তম। যার জন্যে দরকার নিজের মনোভাব স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশের স্বাধীনতা। মনই যদি সামাজিক দাাসত্বের শিকার হয় তাহলে কী আর সেই মুুখে ভাষা থাকে?
শুধুমাত্র দু’জন প্রিয়তী বা সীমন্তিই নয়, বাংলাদের অধিকাংশ মেয়েই কোন না কোনভাবে যৌন হেনস্থার শিকার। কখনও পথে, কখনও কর্মক্ষেত্রে,কখনওবা নিজ ঘরে– এটা পুরুষরাও যেমন জানে, নারীরাও। তাই অভিযোগকারীর বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা প্রশ্নবিদ্ধ সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে এই আন্দোলনে শরিক নারীর সেফটি, অর্থনৈতিক অবস্হা, আইনী লড়াই, প্রমাণাদি এবং চাপ সইবার ক্ষমতায়।