পিতৃতন্ত্র একটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, যেই দুর্যোগে পড়ে আছেন আপনি

ফাহমি ইলা:

ব্যাংকের একাউন্ট খুলতে ব্যাংকে গেছি সকাল ১০ টায়। একেক অর্গানাইজেশনের স্যালারি একাউন্ট একেক ব্যাংকে হয় বলে নতুন করে আবার একাউন্ট খুলতে হচ্ছে। ব্যাংকে ঢুকে দেখি কাস্টমার আর কমর্চারি মিলিয়ে গোটা দশেক মানুষ। সকাল সকাল গিয়েছিলাম যেনো ভিড় কম হয়, কাজ তাড়াতাড়ি করে চলে আসবো।

একটা টেবিলে বসবার পর কর্মকর্তা পুরুষটি কাগজ সব উল্টেপাল্টে গভীর মনোযোগে দেখলেন, পাসপোর্টে মেইলিং এড্রেস গোপালগঞ্জ দেয়া কেনো, আমি গোপালগঞ্জ থেকে আসছি কিনা, বাপের বাড়ি কই, সব খুটিয়ে খুটিয়ে জেনে নিলেন।। গেল বছর বিদেশ যাবার কিছু ব্যাপারে পাসপোর্টে মেইলিং এড্রেস গোপালগঞ্জ দেবারও কারণ ছিলো।

ডাটা এন্ট্রি দেয়ার সময় তিনি বললেন- ‘আপনার পার্মানেন্ট এড্রেস তো এখন চেইঞ্জ হবে।‘
জিজ্ঞেস করলাম- ‘কেনো?’
তিনি কেনোর উত্তর না দিয়ে বললেন-‘পার্মানেন্ট এড্রেসে স্বামীর বাড়ির ঠিকানা বসিয়ে দিচ্ছি।‘
অত্যন্ত নম্রস্বরে বললাম-‘কেনো! আমার বার্থ সার্টিফিকেট, ন্যাশনাল আইডি, পাসপোর্ট সব জায়গায় পার্মানেন্ট এড্রেস এক দেয়া আছে। এখন চেইঞ্জ করতে হবে কেনো!’
তিনি বললেন-‘আমি যতদূর জানি, বিয়ের পর মেয়েদের এড্রেস চেইঞ্জ হয়।‘
এবারও নম্রস্বরে বললাম-‘আমার পার্মানেন্ট এড্রেস যেটা দেয়া আছে, ওটাই দিন।‘

তিনি আবারো তার কথার পুনরাবৃত্তি করলেন এবং জুড়ে দিলেন আরো একটি লাইন-‘স্বামী না দিলে কি এতো দূরে চাকরি করতে পারতেন?’
আমি বোধহয় আজ পর্যন্ত অফিশিয়াল টাইমে এতটা রেগে কখনোই যাইনি। নম্র ভাষাকে শীতলকন্ঠে বললাম-‘আপনি কি আপনার স্ত্রীর মগজ দিয়ে কাজ করেন?’
তিনি প্রথমবার বুঝতে পারলেন না।
দ্বিতীয়বার বললাম-‘আপনি কি আপনার স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে এখানে কাজ করতে আসছেন?’

এবার তিনি বুঝতে পারলেন এবং রাগে লাল হয়ে গেলেন। সব কাজ বন্ধ করে তিনি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, এবং এমন ভাব ধরলেন যেন তিনি আমার কাজ আর করবেন না।
আমি অত্যন্ত ভদ্রস্বরে বললাম-‘আমার কাজটা তাড়াতাড়ি করে দিন, সময়ের দাম আছে।‘ এরপরেও যখন কাজে হাত না দিয়ে তাকিয়েই রইলেন, তখন উঁচু স্কেলে কথা বলতে বাধ্য হলাম এবং বুঝলাম রেগে গেলে আমিও রাহাতের (আমার পার্টনার) মতো ইংরেজি ব্যাকরণসহ ভালো বলি! এমনিতে খুব একটা ভালো বলি না, আটকায়ে যাই।

কথার সারমর্ম ছিলো এরকম- ‘আমি আমার হাত-পা দিয়ে কাজ করি, আমার স্বামীর না। আপনি আমাকে রেসপেক্ট করতে বাধ্য আমার পরিচয়ে, আমার স্বামীর পরিচয়ে না। আর আমি ওমুক অর্গানাইজেশনে ওমুক পদে আছি। আপনি আগামী দশ মিনিটে আমার কাজ শেষ না করে দিলে আমি আপনার নামে কমপ্লেইন করতে বাধ্য হবো।‘

কোথাকার কে কে ছুটে এলো। আশপাশে সাত-আটজনের ভিড়, তাকিয়ে আছি তার চোখ বরাবর। শেষে বললাম- ‘আপনার স্ত্রীর অনুমতি নেন কিনা এটা শুনে আপনার ঠিক যতটা অপমান হয়েছে, আমার স্বামীর অনুমতি নিতে আমি বাধ্য, এটা শুনে আমার ঠিক ততটাই অপমান লেগেছে।‘

তিনি চোখ নামিয়ে কাজ শুরু করলেন। রিকোভারি দিতে আসা আরেক কর্মকর্তা ডেকে নিলেন তার রুমে। বললেন-‘উনি আসলে বুঝতে পারেনি আপনি ওমুক অর্গানাইজেশন থেকে এসেছেন।‘
বললাম-‘সাফাই গাইবেন না প্লিজ। কে কোথা থেকে এসেছে তার ওপর ডিপেন্ড করে আপনারা কাস্টমারের সাথে বিহেইভ করেন নাকি!’

এ ঘটনার পর পাক্কা ত্রিশ মিনিট পরেও যখন তিনি কাজ শেষ করে দিলেন না, এবং ইচ্ছাকৃত দেরি করলেন, তখন কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে হেড অফিসে কমপ্লেইন করতে বাধ্য হলাম। অনেকে বলতে পারেন-‘আহা কমপ্লেইন করার কী দরকার ছিলো? ওনার চাকরি খেয়ে আপনার কী লাভ? ওনার কি এসব ব্যাপারে ওরিয়েন্টেশন আছে নাকি! আপনারা নারীবাদীরা এতো মাথা গরম করেন কেনো?’ (যেহেতু এসকল কথা ইতিপূর্বেও শোনা)।

শোনেন, গরীব-ধনী বুঝি না, উত্তর-দক্ষিণ বুঝি না, আপনাদের ইনফেরিওর কমপ্লেক্সিটির কারণে কুড়কুড় করে বেরিয়ে আসা ‘নারীবাদও’ বুঝি না, শুধু বুঝি সব জায়গায় পুরুষতন্ত্রের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হই আমরা। আজকের ঘটনা কারো কারো লাঞ্ছনার অভিজ্ঞতার কাছে একদমই ছোট। আপনারা ধনী-গরীব বুঝেন, কিন্তু সেখানেও ধনী নারী-ধনী পুরুষ, গরীব নারী-গরীব পুরুষের যে ভাগ আছে, আর সেই ভাগে ভাগে যে কতো পিতৃতান্ত্রিক শোষণের ক্যাটাগরি আছে, সেটা দেখবার বেলায় চোখে টিনের চশমা পরে থাকেন। এটা আপনাদের সমস্যা, আমার না একদমই!

শোনেন হে সমাজ, আগেও বলেছি আবার বলি- পিতৃতন্ত্র একটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, যেই দুর্যোগে পড়ে আছেন হাজার বছর ধরে। পড়ে থাকতে থাকতে এটাই হয়ে গেছে স্বাভাবিক, পুরুষের কাছে শোষণ করা স্বাভাবিক, আর নারীর কাছে শোষিত হওয়াই নিয়তি! যেখানে নারী হচ্ছে পুরো সমাজের ভোগ্যবস্তু। সেই নারী যেই অবস্থানেই থাকুক।
আর পুরুষ হবার কারণে একজন দিনমজুরও (কাউকে খাটো করছি না) মাথায় কাপড় নেই বলে আমাকে দেখে যে স্ল্যাং ইউজ করতে পারে, সেটা পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার ব্যবহার। সেই ক্ষমতা পুরুষ যেকোন অবস্থানে থেকেই চর্চা করতে সদা প্রস্তুত। সো, নারীর হাতে ক্ষমতা আসলে ওরকম অপব্যবহার না করলেও ব্যবহার করতে হবে।

‘ব্যবহারেই আসল পরিচয়, সে আচার-ব্যবহারই হোক, হাত-পা-মুখের ব্যবহারই হোক আর ক্ষমতার ব্যবহারই হোক।‘

শেয়ার করুন: