ফাতেমা জোহরা:
বলে যাও মেয়ে, না শুনুক ক্ষতি নেই। তুমি থেমো না, বলে যাও তোমার কথা। আজ নয়, কাল নয়, পরশু থমকে দাঁড়াবে, কান পাতবে, একদিন জড়ো হবে সুনিশ্চিত। তোমার বলাটুকু তুমি বলে যাও, দেখবে প্রতিক্রিয়া একদিন আসবেই। এই প্রতিক্রিয়াশীল পথ তোমাকে নিয়ে যাবে ইপ্সিত সেই লক্ষ্যে, যার দ্বারে করাঘাত করে তোমার সময়টা গড়িয়েছে অনেকদূর। শুনছি আমি মুগ্ধ হয়ে।
৬/৮ বছরের ছোট্ট মেয়েটি মায়ের হাত ধরে এ বাড়ি, সে বাড়ি পার হয়ে অনেকটা পথ হেঁটে যেত মায়ের কর্মস্থলে। একদিন বললাম – দাদী, ওকে আমাদের এখানে রেখে যান, যাবার সময় নিয়ে যাবেন বাড়িতে। টুকটাক কাজ করবে, টিভি দেখবে। মেয়েও রাজী। সেই যে এলো, এক্কেবারে অভিযোজন ক্ষমতা নিয়েই এলো। আমরা আর কিছুই ভাবতে পারি না তাকে ছাড়া।
পারভীন এটা দাও, পারভীন এটা খেতে ইচ্ছে করছে। আমাদের কথা, চাল – চলন সব এডাপ্ট করতে লাগলো। সে এখন আমাদের একজন। প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণীর বই সব শেষ করলো গভীর আগ্রহে। যদিও স্কুল পাঠানো সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যত ভেবে সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করে দেওয়া হলো।
বড় হয়েছে, এবার পাত্রস্থ করতে হয়। দেখে-শুনে বিয়ে দেওয়া হলো ধুমধাম করে। এতোদিন মেয়েটির মনে কোনো দ্বিধা ছিলো না নিজের পরিচয় নিয়ে। নতুন পরিবেশে দেখা দিল পরিচয় সংকট। শ্বশুর বাড়িতে কাজের মেয়ে পরিচয়টা অসম্মানজনকভাবে ব্যবহার হতে লাগল। ভয় পেলো না মেয়েটি। আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়তা দিয়ে সে প্রতিদিন মোকাবিলা করতো গ্রাম্য নোংরামি।
সুখের ঘরে মাঝে মাঝে অভাব দেখা দেয়। স্বামী ছিল কিছু আলসে টাইপের। তার ভাষ্যমতে, সকালে বের হওয়ার সময় তাকে চালের কথা বলা হয়, যদিও লক্ষীর ভাণ্ডার কখনও শূন্য থাকে না। কিন্তু শূন্যহাতে স্বামী ফিরে এলে তার অমলিন মুখটায় ছায়া পড়ে, সেটা নেহাত লোক দেখানো। সে জানতো, এমনি হবে। তাই বাচ্চা নিয়ে নিজে আগে খেয়ে নিত। স্বামীকে বলতো, আজ রান্না করিনি, মায়ের কাছে গিয়ে খেয়ে আসো তুমি। বউ-বাচ্চা উপোস রেখে কোনো পুরুষ পারে মায়ের কাছে ভাত চাইতে? মেয়েটা জানতো, অকারণ মায়া দেখালে সেটা প্রশ্রয় হয়ে দাঁড়াবে। তাই মনটাকে শক্ত রেখে এভাবেই স্বামীকে কাজের দিকে ঠেলে দিতো।
সেলাই, হ্যান্ড-ব্যাগ, মোড়া বানানো, বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানে রান্না করা বা অনুষ্ঠান সামলানো, সবার কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, এসব করতে করতে ধীরে ধীরে নিজের একটা অবস্থান করে নিল সে। স্বাবলম্বি হওয়ার প্রক্রিয়ায় ইন্সুরেন্স কোম্পানি, গ্রাম আনসার, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে শুরু করে সে আজ ঐ এলাকার মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য। আমি মন্ত্রবৎ শুনে যাচ্ছি তার পথচলার গল্প।
আমি জানি সে আওয়ামী ভাবনা পোষণ করে না, প্রশ্নটা ছিলো আমার সেখানেই। তার সোজাসাপ্টা উত্তর – ভবিষ্যত। ভিজিএফ কার্ড, ন্যায্যমূল্যের রসদ, সমবায় সমিতি ইত্যাদি সুবিধা। ক্ষমতায়নের রাজনীতিতে একজন দৃঢ়, উচ্চকণ্ঠ নারীর প্রয়োজন। প্রয়োজনটা দুপক্ষের, তাই এগিয়ে যাওয়া। হাল ধরে থাকলে বাও বুঝে পালটা তুলে দিতে হয়।
আহা! যাকে অ, আ, ক, খ এর পাঠ দিলাম, তার কাছে পাঠ নিচ্ছি পাল তোলার। কী চমৎকার গুরুদক্ষিণা! বুকটা সত্যিই ভরে গেল।
মেয়েটির স্বপ্ন ছিল একদিন তার ঘরটা পাকা দালান হবে, সেখানে থাকবে টাইলসের বাথরুম। স্বপ্ন তার পূরণ হয়েছে। সেদিন ফোন করে বললো, কবে আসবেন আমার নতুন বাড়িতে?