সুরাইয়া আবেদীন: আমাদের সমাজে বিয়ে হয়ে গেছে এমন একটা মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন- তোমার জীবনের সবচে ভয়াবহ, অপমানজনক অভিজ্ঞতা কী? মেয়েদের খুব বড় একটা অংশ উত্তর দিবে ‘ছেলে পক্ষের সামনে বসা’।
‘ছেলে পক্ষের সামনে বসা… ‘ একটু গুনি এক-দুই-তিন-চার।
হু!! চার শব্দের এই বাক্যখানা দেখতে খুব নিরীহ, কিন্তু এই নিরীহ চার শব্দের মধ্যে যে কী পরিমাণ অপমান, অসম্মান আর কান্না লুকিয়ে থাকে তা এর শিকার মেয়েরাই জানে…

আমার বন্ধু সার্কেল বেশ বড়, বেশকিছু ঘটনা দেখা হয়েছে পাত্রী পক্ষের একজন হয়ে। ছেলে পক্ষের হয়ে আমি কখনই মেয়ে দেখতে যাই না, বলা চলে আমাকে নেন না মুরুব্বিরা।
কারণ গায়ের রঙ এর চাইতে আমি মেয়ের মেধা, মনন, রুচি, আত্মসম্মান এর রঙ কতখানি ‘ফর্সা’ তা দেখতে ও জানতেই আগ্রহী থাকি বেশি।
একবার এক মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ”বই পড়ার অভ্যাস আছে কিনা… ”
ছেলের মা আমাকে কিছুক্ষণ পর দূরে নিয়ে গিয়ে বললেন ‘এসব কী করতেছিস!! এখানে কী আমি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের জন্য মেম্বার খুঁজতে আসছি? তোকে আনাই ভুল হইসে…”
মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে এমন সব ঘটনা দেখেছি যে তার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে মন গ্লানিতে ছেয়ে গেছে… এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি এসব ঘটনার শিকারি এবং ভিকটিম উভয়ই থাকেন নারী…
একদল নারী সদস্য, যে তারই স্বজাতির একজনকে কী প্রচণ্ডভাবে যে অপমানিত করার ক্ষমতা রাখেন- তা দেখে বিস্মিত হতে হয়!
এসব নারীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, কিন্তু মানসিকভাবে এরা আবার চরম অশিক্ষিত। এই ‘মানসিক অশিক্ষিত’রা দল বেঁধে আসে, নির্লজ্জের মতো ‘আত্মসম্মান’ বিসর্জন দিয়ে কন্যা পক্ষের আপ্যায়ন উপভোগ করে এবং শেষকালে প্রস্তাব নাকচের এমন সব কারণ দাঁড় করায়, যে মনে হয়, আমাজনের গহীনে থাকা কোন আদিম জংলি কথা বলছে…
প্রথম ঘটনার পাত্রী এনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্রী এনি শেষের কবিতার ‘লাবণ্য’ যেমন, তেমন, যার দিন কাটছিল এক অমিতের অপেক্ষায়…
অপেক্ষার প্রহরে বাধা পড়লো যখন এনি শুনলো, আগামী শুক্রবার তাকে দেখতে আসবে।
উচ্চ মধ্যবিত্ত এনির বাবা নিজের সাধ্যমতো আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। কথা ছিল উভয় পক্ষের গার্জিয়ান প্রাথমিক আলাপে বসবে এনিদেরই বাসায়।
ওমা একী! মেয়ে দেখতে এলো গুনে গুনে ১০ জন! ছেলের মা-খালারা সবাই এসেছে…. যদিও এমন কোনো কথাই ছিল না।
ছেলের বাবা এলেও তিনি পুরাই নীরব দর্শক!
হাসি মুখে ছেলের মা-খালারা এনিকে আপাদমস্তক দেখে, খাবার দাবার প্রায় শেষ করে চলে গেল।
দুই দিন পর জানাল ছেলে পক্ষের পছন্দ হয়েছে।
আংটি পরানোর দিন ঠিক করতে আবার একদিন মুরুব্বিরা বসবে এনিদেরই বাসায়।
ওহ আচ্ছা একটু বলে রাখি-ছেলে নিজে ব্যাংকার, ছেলেমেয়ে উভয়ের মা-খালারা উচ্চ শিক্ষিত। ছেলের ধবধবে ফর্সা এক খালা তো প্রথমদিনই তার ভয়াবহ ব্যস্ততার কথা, বিজনেস কিভাবে সামলান, ঢাকার এক নামকরা লেডিস ক্লাবের উন্নতিতে তার ভূমিকা নিয়ে কতকিছু যে বললেন!!
তো এঙ্গেজমেন্ট এর আলাপে ছেলে পক্ষের মুরুব্বিরা আসবে, স্বাভাবিকভাবেই মেয়ের বাসায় সবাই খুশি। মেয়ের খালারা এসেছে এবার। আগের দেখায় মেয়ের খালারা ছিলেন না।
মেয়ের বাবা এবারো আপ্যায়নের কমতি করলেন না… ছেলেপক্ষ এলো এবার আরও বেশি! স্কুলে পড়া কাজিনসহ ১৫ জন।
এনির পাশে ছেলে… এনির থেকে সে চোখই সরাতে পারছে না…
যাই হোক, সেদিন ছেলে পক্ষের এঙ্গেজমেন্টের ডেট দেবার কথা, কিন্তু তারা সে দিকে যাচ্ছেই না। হাসি, ঠাট্টায় ছেলে-মেয়ের পরিবার পুরা মশগুল… এর মাঝে দুই বার চা পানের পর যখন ঘড়ির কাঁটা ১১ টা ছুঁই ছুঁই, তখন ছেলের বড় ভাই বললেন, আমরা বাসায় যাই, নিজেরা আলাপ করি, তারিখ আমার খালা জানিয়ে দিবে।
মেয়ের পরিবার বিস্মিত হলেও হাসিমুখে বিদায় দিল ছেলেপক্ষকে।
ওমা একদিন যায়, দুই দিন যায়! সাত দিনেও কোন ফোন না। মেয়ের বাবা শেষে সেই মহাব্যস্ত খালাকে ফোন দিলেন। খালা প্রথমে মেয়ের বাবাকে চিনতেই পারেন না।
(অথচ সেদিন কী এক খাবার খেয়ে তিনি এতোই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, বলছিলেন, এই পরিবারের কথা তিনি ভুলতেই পারবেন না… !!! )
যাই হোক অনেক কষ্টে চেনার পর বললেন, ”মেয়ে পছন্দ হয়েছে। কিন্তু মেয়ের খালাদের পছন্দ হয় নাই। মেয়ের গায়ের রং মেনে নিলেও, মেয়ের খালাদের গায়ের রঙ দেখে তাদের মনে হয়েছে এখানে বিয়ে হলে বিয়ের পর বাচ্চা হলে সে বাচ্চা কালো হবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে মেয়ের খালাদের গায়ের রঙের উপর ভিত্তি করে তারা পারিবারিকভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এখানে তার ভাগ্নেকে তিনি বিয়ে করাবেন না… আর ভাগ্নে তার কথার বাইরে যাবে না, তার কথাই সব।
‘আচ্ছা রাখি ভাইসাহেব, আমার এখন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে… আমেরিকান ক্লায়েন্ট, আমি অনেক ব্যস্ত… ভালো থাকবেন।
আমার দেখা নির্লজ্জতম ঘটনা এটা। একজন শিক্ষিত নারী কিভাবে এই ধরনের অস্বাভাবিক লেভেলের স্টুপিড হোন, আজও বুঝি না। স্টুপিডিটিরও তো একটা লিমিট থাকে।
যাই হোক এনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে যা করার কথা, তাই করেছিল। একদমই মন খারাপ করে নাই। বরং এই ‘অসুস্থ’ পরিবারে সে বউ হয়ে যায় নাই, তার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে বার বার।
দ্বিতীয় ঘটনার পাত্রী লিমা। ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ছবি দেখার পর ছেলে মেয়ে উভয়ই একে অন্যকে পছন্দ করেছে।
ছেলে লিমাকে দেখল সামনাসামনি, আলাপকালে জানালো তার পছন্দই শেষ কথা, সে যাকে পছন্দ করবে, তাতে তার মায়ের আপত্তি নেই… লিমাকে তার পছন্দ হয়েছে।
তবে ছেলের একটাই শর্ত! চাকরি করা যাবে না। ছেলের মাসিক আয় কয়েক লাখ… টোনাটুনির সংসারে এর চেয়ে বেশি লাগে?
এই এক শর্তে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চমৎকার রেজাল্ট করে সদ্য বের হওয়া লিমা পরে গেল মহা চিন্তায়!
এরই মধ্যে সে অলরেডি এক প্রাইভেট ব্যাংকে ইন্টারভিউ দিয়ে এসছে, এবং লিমাকে জানানো হয়েছে জয়েনিং এর ডেট। এমন সময়ই এই ছেলের প্রস্তাব আসে।
কী করবে লিমা!
বিয়ের বাজারে এমন পাত্র! ছেলে সুদর্শন…পরিবারও ভালো…আর সবচে বড় কথা দুজনের মনের মিল হয়েছে যেখানে, সেখানে দ্বিতীয় কোনো কথা থাকতে পারে!!
বুদ্ধিমতি (!!) লিমা সরল মনে ভেবেই নিল এখানেই তার বিয়ে কনফার্ম, যেহেতু ছেলে বলেছে লিমাকে তার পছন্দ হয়েছে এবং তার পছন্দই তার মায়ের পছন্দ, কাজেই ধরে নেয়া যায় এখানেই লিমার বিয়ে হবে,
লিমা ব্যাংকে জয়েন করলো না।
এর মাঝে ছেলের মা এসে মেয়ে দেখে গেল…লিমার ব্যবসায়ী পিতা আয়োজনের কমতি করলেন না…
ছেলের বাবা নেই। অভিভাবক বলতে মা। আপ্যায়ন পর্বে ছেলের মায়ের মুখে হাসির কমতি নেই। সব পদ চেয়ে চেয়ে খেলেন…
লিমাকে জিজ্ঞেস করলেন কী কী রাঁধতে পারে… সংসারে তিনি আর রান্না ঘরে যেতে চান না… ছেলের বউকেই পুরা বাসার দায়িত্ব নিতে হবে। লিমা পারবে কীনা তা জিজ্ঞেস করতেই লিমার লাজুক হাসি দেখে তিনি খুবই তৃপ্তি পেয়েছেন এমন অভিব্যক্তি দিয়ে খেতে শুরু করলেন।
সবশেষে যাবার কালে ছেলের মা জানালেন, বাসায় যেয়ে তিনি কনফার্ম করবেন।
দুই দিন পর ছেলের নাম্বার থেকে লিমাকে মেসেজে জানানো হলো- তার মায়ের লিমাকে পছন্দ হয় নাই। লিমাকে তিনি ছেলের বউ করবেন না। ছেলের পক্ষে এই বিয়ে করা সম্ভব না… এবং তারপর থেকে সেই নাম্বার বন্ধ!
হতভম্ব লিমা কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতেই পারলো না। এই ছেলের কারণে সে ব্যাংকেও জয়েন করে নাই! কী হলো এটা! ছেলের মোবাইল সেই যে বন্ধ হয়েছে, আজও খোলেনি।
কী ভয়ঙ্কর ভুল করলো লিমা ব্যাংকে জয়েন না করে… এ ঘটনা থেকে আমি সব মেয়েকে শিখতে বলি। এমন ভুল আর কোনো মেয়ে যেন না করে।
এই অভিজ্ঞতা পুরাই অন্যরকম। তবে শিক্ষণীয়।
এই ঘটনার পাত্রী নাদিয়া! নাদিয়ার জন্য অনেকদিন থেকেই ছেলে খুঁজছিল ওর গার্জিয়ান। অনার্সের তৃতীয় বর্ষের নাদিয়া জানলো, তার খালাতো ভাইয়ের এক বন্ধু আমেরিকা থেকে দেশে এসেছে বিয়ে করতে। এমন ছেলে নাকি লাখে একটা!
এখানে একটু বলে নেই। নাদিয়া হলো বাবা-মায়ের খুবই বাধ্য সন্তান। নাদিয়ার কাছে বাবা মায়ের কথাই শেষ কথা।
তো, নাদিয়ার ছবি দেখে ছেলেরা পছন্দ করেছে। ছেলেকে মেয়ের বাবা নিজ অফিসে আসতে বললেন, আলাপ করার পর ছেলেকে তার পছন্দ হলো।
এবার পাত্রীকে ছেলের মা-বাবা দেখবে…এক সন্ধ্যায় দুই পরিবারের ছয়জন এক রেস্টুরেন্টে বসলো। বিদায় কালে দুই পরিবার তাদের গাড়িতে উঠবে, এমন সময় আচমকা ছেলের বাবা মেয়ের বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললেন-
‘আমি এখানেই আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে চাই… আজ থেকে আপনি আমার বেয়াই… মেয়ে আমাদের খুবই পছন্দ হয়েছে… আমি এ সপ্তাহের মধ্যে কাবিন করে ফেলতে চাই… এক মুহূর্ত সময় অপচয় করতে চাই না…Officers’ Club এ অনুষ্ঠান হবে, খালি পাবো কীনা কে জানে… এক মাস আগে থেকে বুকিং দিতে হয়… মামনিকে আমি স্বর্ণে মোড়ায়ে আমার বাসায় নিয়ে আসবো…”
নাদিয়ার বাবা-মা দুজনেই খুশি। এমন পরিবারে মেয়ে যাবে, ভাবতেই তারা আনন্দিত! ঘোরের মধ্যে নাদিয়া গাড়িতে উঠলো এবং বাসায় আসলো…
ঐযে মনে আছে নাদিয়ার কাজিনের কথা? যে এই প্রস্তাব এনেছিল? তো, সব যখন এতো অল্প সময়েই হয়ে গেল, তখন সেই কাজিন নাদিয়াকে ফোন দিল।
বড় ভাই সুলভ দুষ্টুমির পর বললো- নাদিয়া তুই একবার অন্তত কথা বল ছেলের সাথে।
নাদিয়া: ভাইয়া, তার কী দরকার! সবার পছন্দ হয়েছে! আমারও খারাপ লাগে নাই, আর আঙ্কেল তো আমাকে সেদিন রাতের পর থেকে ফোন দিয়ে কী বলেছে জানো? বলেছে, মা, তোমার কাবিনের শাড়ি, গহনা সব কিনে ফেলছি…… আমি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে চাই না…।”
নাদিয়ার কাজিন: তাও একবার নিজেরা আলাপ কর। আমার কাছে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে। বিয়ের আগে পছন্দ-অপছন্দ দুইজনেরটা দুইজন জানবি না?? তোর ভাবীকে বিয়ের আগে আমি তার সাথে কয়বার আলাপে বসছি জানিস? লক্ষ্মী বোন, আমি ওর সাথে আলাপ করে তোদের কথা বলার ব্যবস্থা করে দেই…বিয়ের আগে অন্তত একবার কথা বলে না… কথা না বলে বিয়ে করা বোকামি।
ঘটনার টুইস্ট শুরু…
সেদিন হাল্কা কাজল, টিপ আর মেরুন শাড়িতে নাদিয়ার থেকে চোখ সরানো যাচ্ছিল না, এক রাশ ভালোলাগা নিয়ে নাদিয়া গেল ছেলের সাথে আলাপ করতে…
ছেলে- কী খবর! ভাল আছেন? (নাদিয়াকে দেখে ছেলের চোখে কোন মুগ্ধতা নাই… )
নাদিয়া – জ্বী ভালো আছি… আপনি?
ছেলে- ইয়াপ, আ’ম ফাইন। তানভীর বললো কী নাকি আলাপ করবেন, তাই আসলাম… বলেন কী জানতে চান…।
নাদিয়া – (মনে মনে অবাক হলো… মানে কী? তার কি কিছু জানার নাই?) হাসি মুখে বললো- বিয়ের আগে একবার তো আলাপ করতেই হয় একে অপরকে জানার জন্য। আমরা তো কেউ কারো সম্পর্কে কিছুই জানি না।
ছেলে- কী জানতে চান…
নাদিয়া — কী প্রশ্ন করবে ভাবতে ভাবতে…জিজ্ঞেস করলো, আপনার অবসর কাটে কীভাবে?
ছেলে- ঘুমাই। আমি খুব ব্যস্ত থাকি। আমার প্রফেশন পুরা সময় নিয়ে নেয়। বাকি যেটুকু পাই, ঘুমাই।
নাদিয়া – আপনার ফ্যামিলির সাথে আপনার রিলেশন কেমন? খুব চুপচাপ দেখলাম সেদিন…
ছেলে- আমি ছোটবেলা থেকেই একা। আমার ছোট বোন এনএসইউ’তে পড়ে, আমার সাথে ওর কোনো কিছু নাই। ভাই-বোন থাকে না? আমাদের ওরকম কিছু নাই। বিয়ের পর আমি আলাদাই থাকবো।
নাদিয়া – (ঘোর একটু একটু কাটছে…) do you like kids?
ছেলে- না। বাচ্চা ভাল লাগে না। আমি চাইও না বিয়ের সাথে সাথেই বাচ্চা নিতে, তবে আপনি চাইলে অবশ্যই হবে। কিন্তু ঝামেলা না… অন্তত ৩/৪ বছর তো এই ঝামেলা চাই-ই না…
নাদিয়া – (ঘোর কেটে গেছে) গান শোনেন?
ছেলে- খুব কম…
নাদিয়া – বৃষ্টি ভালবাসেন? জ্যোৎস্না? ঝড়? গাছ? সবুজ? বন?
ছেলে – না। আমার শীত পছন্দ… গাছ-পালা? নারে ভাই…
নাদিয়া – বই পড়েন? বই পড়তে পড়তে ঘুমানোর অভ্যাস আছে? আমার কাছে এটা খুব কিউট একটা ব্যাপার লাগে। আমার খুবই শখ আমার হাবি বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাবে, আর আমি খুব সাবধানে বইটা তার হাত থেকে নেব, যাতে তার ঘুম না ভেঙ্গে যায়…
ছেলে- হা হা হা… আপনি খুব ইমম্যাচিউর… না, বই পড়ি না। অফিস থেকে বাসায় এসে সোজা ঘুম… Anything else you wanna know immature gal?
নাদিয়া – (অনেক কষ্টে কান্না চেপে) না, আমার যা জানার ছিল আমি জেনে গেছি। আপনি কি কিছু জানতে চান?
ছেলে- আমার কিছু জানার নাই। i just want a gal…
বাসায় ফিরে নাদিয়া কান্নায় ভেঙ্গে পরে, মাকে জানায়, এ ছেলেকে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না…
নাদিয়ার মা অথৈ সাগরে পড়লেও ওর কান্না দেখে সাথে সাথে বিয়ের উৎসব বন্ধ করে দিলেন। মেয়ে যেখানে রাজি না সেখানে তিনি কিছুতেই মেয়ের বিয়ে দেবেন না, নাদিয়ার বাবারও একই কথা।
শেষমেষ এ বিয়ে হয় নাই। ছেলের বাবা বহুবার জানতে চেয়েছে কী এমন এক আলাপ হলো যে সব উলটে গেল। এবং বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন তার ছেলেকে কেউ কেন পছন্দ করে না…
আমার জীবনের দেখা অন্যতম ইন্টারেস্টিং ঘটনা এটা।
নাদিয়া একবারও এই ছেলের সাথে বিয়ের আগে আলাপে বসতে চায় নাই। ও ভেবেই নিয়েছিল, বাবা মায়ের পছন্দ মানেই ওর জন্য বেস্ট। অথচ ওর কাজিনের বুদ্ধিদীপ্ত উদ্যোগের কারনে ওর জীবনটাই বেঁচে গেল।
অনেক মেয়ে এই ভুলটা করে। এবং সারা জীবন পস্তায়। বিয়ের আগে মিনিমাম তিনবার আলাপ করা উচিত ছেলেমেয়ে উভয়ের। একে অন্যকে জানার জন্য বিয়ের আগের এই আলাপ খুব জরুরি।
আর আমি নাদিয়ার বাবা মায়ের মতো হতে বলি সব বাবা-মাকে। উনারা চাইলেই কিন্তু ধমক দিয়ে বিয়েতে রাজি করাতে পারতেন নাদিয়াকে। বলার মতো ফ্যামিলি, ছেলেকে হাত ছাড়া করে? তাছাড়া ততক্ষণে আত্মীয়দের বলা হয়ে গিয়েছিল… সমাজ কী বলবে,আত্মীয়রা কে কী ভাববে- এটা তাদের মনে এলেও পাত্তা পায় নাই মেয়ের চোখের পানির কাছে। তারা মেয়ের সুখের কথা ভেবেছেন।
কয়জন বাবা-মা এমন করে? ভাল ছেলে, ভাল পরিবার শুনলেই তো মেয়ের মনের অবস্থা বিচার না করেই তারা বিয়ে দিয়ে দেন। মেয়ের আবার মতামত কী- এমন ভাবনা থেকে বের হতে পারেন না। তাদের জন্য নাদিয়ার বাবা-মা আদর্শ হোক।
সব শেষে বলতে চাই পাত্রী দেখার কালচার আমাদের সমাজ থেকে দূর হোক।
নারীকে পণ্য হিসেবে দেখার, অপমান করার এ পদ্ধতি নারীরাই আঁকড়ে রেখেছে, টিকিয়ে রেখেছে…
সমাজের সকল নারী অভিভাবক এ প্রথা বিলুপ্ত করণে অগ্রণী ভূমিকা রাখুক- এটাই প্রত্যাশা করি।
সুন্দর আবেদন। কিন্তু সমস্যা হইল, এখানে বিয়া নামক ব্যাপারটাই এমন। এই সমাজে ছেলেরা বিয়া করে, আর মেয়েদের বিয়ে হয়! সাধারণত ছেলেরা বিয়া করতে চায় দেখতে সুন্দর ( মানে গায়ের চামড়া সাদা ) একটা মেয়েকে। কারন তার প্রধান উদ্দেশ্য একটি সুন্দর উত্তরাধিকার উৎপাদন করা। মজার ব্যাপার হইল, এখানে সে নিজে কেমন দেখতে বা তার বয়স কত এই প্রশ্নটা সে নিজেকে একবারও করে না, তার পরিবারও না। আর মেয়ে পক্ষও না। একজন ৩০ বছরের ছেলে খুঁজে ২০-২২ বছরের মেয়ে!!! আর এই অসমতা উভয় পক্ষই খুশী মনেই মেনে নেয়। প্রবাদ আছে – “২০ তে বুড়ি”। এখানে “বুড়া” কেন বলা হইল না? সে প্রশ্ন মেয়েরা করে না।
নারী বিয়ের বাজারে পন্য হবার আগে অন্য কোথাও পন্য হয়। কোথায় এবং কেন হয় সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব নারীর।
একদল নারী সদস্য, যে তারই স্বজাতির একজনকে কী প্রচণ্ডভাবে যে অপমানিত করার ক্ষমতা রাখেন- তা দেখে বিস্মিত হতে হয়! আমার আরো বিস্মিত হতে নারীর হাতেই অপর নারীকে নির্যাতিত হতে দেখে। আজকের ছেলেরাতো বিয়ের আগেই নারীকে পন্য বানিয়ে ভোগ করে চলেছে। এসব নিয়েও জোড়ালো কথা বলার প্রয়োজন।