উন্মুক্ততায় রুচিশীলতার পরিচয়

girls 3ফারজানা নীলা: মাঝে মাঝে কিছু খবর চোখে পড়ে, যেমন পর্ণ সাইট দেখার ক্ষেত্রে অমুক দেশ শীর্ষে। এসব খবরে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে কোন উন্নত দেশ পর্ণ সাইট দেখার ক্ষেত্রে শীর্ষে  অবস্থান করে না। অবস্থান করে অবরুদ্ধ দেশ। যেমন পাকিস্তান। অথবা অন্যকোন ধর্মীয় দেশ। ব্যাপারটিতে  আমরা অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করি, অবাক হয়ে বলি, এই দেশ এতো রক্ষণশীল হয়ে কীভাবে এসবে শীর্ষ স্থানে অবস্থান করে। উত্তরটি আমাদের বিস্ময় প্রকাশের মধ্যেই আছে। রক্ষণশীল বলেই এসব দেশ নিষিদ্ধ বা গোপনীয় জিনিশের প্রতি আগ্রহ দেখায় বেশি। ব্যাপারটি মোটেও হাস্যকর বা অযৌক্তিক বা লজ্জাজনক নয়।
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে পশ্চিমা দেশে এসব পর্ণ সাইটের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায় না। কারণ পশ্চিমা দেশে শারীরিক সম্পর্ক কোন গোপনীয় বা নিষিদ্ধ জিনিস না। সেখানে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেওয়া হয় না যে বিয়ে   ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক করা যাবে না। পশ্চিমা দেশের সামাজিক সংস্কৃতি এভাবেই গড়ে উঠেছে যে সেখানে ছেলেমেয়েদের মধ্যে মেলামেশার ক্ষেত্রে কোন রকমের বাধা নেই। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় অফিস কর্মস্থলে সর্বত্র নারী পুরুষ বিনা বাধায়, বিনা কোন নিয়ম রীতিতে মেলামেশা করছে। সেই সব দেশে একজন ছেলের সাথে ছেলের মেলামেশা যেমন স্বাভাবিক তেমন ছেলের সাথে মেয়ের মেলামেশা স্বাভাবিক।
জন্ম থেকে একজন পশ্চিমা শিশু দেখে আসছে , শিখে আসছে নারী পুরুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ  নেই, সে নিত্য দেখছে তাঁর বাবা মা একে অপরকে চুমু খাচ্ছে, জড়িয়ে ধরছে প্রকাশ্যে, ঘরের বাইরে ছেলে মেয়ে মিশছে, ভালবাসছে এবং  সময় হলে তারা ডেট ও করতে যাচ্ছে। যেটা সম্পূর্ণ প্রকাশ্যে, কোন রকম লুকোচুরি ছাড়া। ছেলে মেয়ে যদি  সজ্ঞানে রাজি হয় শারীরিক ভাবে মিলিত হয়   তবে সেখানে সেটাও বাধাহীন। অর্থাৎ নারী পুরুষ মেলামেশার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বা সামাজিক কোন রকম বাধা  সেই দেশে নেই। সেসব দেশে এটাই স্বাভাবিক। তাই তারা পর্ণ সাইটের প্রতি আগ্রহী হয় না। কারণ লুকিয়ে দেখা বা করার মত কোন পরিবেশ সেই দেশে তৈরি হয় নি। সেখানে চাইলে ছেলেমেয়ে একে অপরকে ভালবাসতে পারে, চাইলে মিলিত হতে পারে। বিনোদনের জন্য অজস্র জায়গা আছে সেখানে। বন্ধু বান্ধব নিয়ে হইচই উল্লাস উপভোগ করার মত  জায়গা সেখানে অগণিত। কারণ সেই দেশের সামাজিক সংস্কৃতিতে এটা প্রাধান্য যে বিনোদনের জন্য জায়গা থাকতে হবে।
একটা বয়সের পর ছেলেমেয়ে মিশতে চাইবে একে অপরের সাথে, কোথায় গিয়ে  আনন্দ ফুর্তি করতে চাইবে, যেটা করতে চাওয়া একজন স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন মানুষের জন্য মৌলিক চাহিদা। সুতরাং সেখানে বিনোদন কেন্দ্রে সপ্তাহ শেষে উপচে পড়া ভিড় থাকে। পশ্চিমা দেশের সংস্কৃতি মানুষের জৈবিক চাহিদাকে স্বাভাবিক চাহিদা বলে গণ্য করে। একে লুকিয়ে রাখতে হবে, গোপনে রাখতে হবে, কাউকে বলা যাবে না, নারীর সাথে পুরুষ মিশতে পারবে না, এক সাথে কোথাও যেতে পারবে না, বিয়ে ছাড়া প্রেম করতে পারবে না, এসব রীতিকে তারা হাস্যকর বা অবাস্তব বলে গণ্য করে।
পশ্চিমা দেশ বিশ্বাস করে নারী পুরুষের মেলা মেশায় কোন অশুচিতা নেই, কোন অপবিত্রতা নেই।  নারীপুরুষ সম্পর্ক সেখানে উন্মুক্ত অবাধ স্বাধীন। তাই সেখানে লুকিয়ে  পর্ণ দেখার প্রয়োজনীয়তা রক্ষণশীল দেশের চাইতে অনেক হারে কম।
পশ্চিমা দেশের সম্পূর্ণ বিপরীত হল বাংলাদেশ পাকিস্তানের মত আরও অনেক ধর্মীয় রক্ষণশীল দেশ। বাংলাদেশকে নিয়ে আগে অনেক আশা ছিল কিন্তু দিনদিন এ অন্যান্য দেশের মত ধর্মীয় রক্ষণশীল দেশে পরিণত হচ্ছে। আমাদের দেশে যখন  নারীপুরুষকে প্রেম করার অপরাধে পুলিশ ধরে নিয়ে হাজতে ঢুকায় এবং সেটি ফলাও করে বুক ফুলিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকারও করে তখন সে দেশকে প্রগতিশীল দেশ বলার কোন কারণ থাকতে পারে না। বরং একে রক্ষণশীল দেশ বলে আখ্যা দেওয়া যায়। একজন নারী এবং একজন পুরুষ যদি স্বেচ্ছায় একে অপরকে পছন্দ করে একসাথে কিছু সময় কাটাতে চায় তবে সেটি কিসের ভিত্তিতে অপরাধ হয় যার জন্য তাদের জেলে ঢুকাতে হয় তা একজন বোধ সম্পন্ন মানুষের কাছে বোধগম্য নয়।
পাকিস্তান সহ অন্যান্য ধর্মীয় রক্ষণশীল দেশে নারীপুরুষের মেলামেশা অনেকটা হারামের কাতারে পড়ে। এখানে নারীপুরুষের মেলামেশা ধর্মীয় বিধিনিষেধ দিয়ে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছে। এখানে জন্ম থেকে একজন শিশুকে শেখান হয় ছেলে মেয়ে একসাথে মেলামেশা করা ঠিক না, বন্ধুত্ব করা ঠিক না, বিয়ের আগে  ভালোবাসা খুবই গর্হিত কাজ। এখানে সন্তানরা কখনও দেখে না বাবা মা একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে, গালে চুমু খাচ্ছে, প্রকাশ্যে ভালোবাসা প্রকাশ করছে। নিজের ঘর থেকে দেখে আসে বাবা মা’র মধ্যে  যোজন যোজন দূরত্ব । ঘর পরিবার থেকে সন্তানরা শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে কোন শিক্ষা পায় না।
একটা বয়সের পর শরীরে যে ছেলেমেয়েদের পরিবর্তন আসে, তাদের মধ্যে অনেক অজানাকে জানার আগ্রহ জন্মায় তা আমাদের মত ধর্মীয় রক্ষণশীল সমাজ মানতে চায় না।  এখানে ছেলে মেয়েরা বেড়ে উঠে অবদমিত যৌন চাহিদা নিয়ে।  বাবা মা সন্তানদের সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলাকে লজ্জার বিষয় মনে করে। অথচ তারা এটা মনে করে না যে লজ্জার অজুহাতে সন্তানদের থেকে এসব শিক্ষা গোপন করে রাখলে সন্তানরা তাদের জানার আগ্রহ মিটাবে কিসের মাধ্যমে। 
ধর্মীয় শৃঙ্খলতা নারী পুরুষ মেলামেশার ক্ষেত্রে নিয়ম আরোপ করেছে , বলেছে কোনরূপ বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক করা যাবে না; কিন্তু এটা শিক্ষা দেয় নি, সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে যখন নারী পুরুষ  উভয় শরীরে পরিবর্তন আসবে, নতুন কিছু সম্পর্কে জানতে চাইবে, শরীরের এই পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে চাইবে, অথবা জৈবিক চাহিদা যখন জাগবে তখন একজন মানুষ কীভাবে সেটিকে পূরণ করবে? রক্ষণশীল সমাজে এর কোন উত্তর নেই। কেউ যদি বলে থাকে বিয়েই এর উত্তর তবে সে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ।
বিয়ে একটি সামাজিক প্রথা। একজন মানুষের স্বাবলম্বী হতে ন্যূনতম ২৫ থেকে ২৬ বছর লেগে যায়। ক্ষেত্র বিশেষে আরও বেশিও লাগে। সেখানে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ জৈবিক চাহিদা কীভাবে পূরণ করবে? অবদমন করে কতদিন রাখ যায়? এক সময় চাহিদা কোন অবদমন মানে না, সে ঝুঁকে পড়ে পর্ণ সাইটের উপর। সেসব থেকে সে শিক্ষা নেয় যৌন মিলন কি কীভাবে হয়, এবং সেসব দেখে দেখে সে নিজেকে প্রশমিত করে।  যেটা খুবই অস্বাস্থ্যকর একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু এভাবেই চলে আসছে। যার ফল স্বরূপ প্রতি বছর পর্ণ সাইটে শীর্ষে থাকে ধর্মীয় রক্ষণশীল দেশ।
নারীপুরুষ সম্পর্ক কোন ভাবে অবদমিত করা রাখার মত বিষয় হতে পারে না। এই সম্পর্ক খুবই চমৎকার সুন্দর উপভোগ্য এবং শাশ্বত। ভালবেসে কারও হাত ধরা জড়িয়ে ধরা চুমু খাওয়া মানুষের অনুভূতিকে  সর্বোচ্চ আনন্দ দেয়। সেই আনন্দ কখনও খারাপ হতে পারে না। বরং এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত রাখা অপরাধ। নারী পুরুষের সম্পর্ক আরোপিত হতে পারে না।  মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির একটি অংশ। অন্যান্য জীবে যেমন চাহিদা জন্মে তেমনই মানুষ নামক জীবেরও চাহিদা জন্মে। এই চাহিদা যদি সে কাউকে ভালবেসে সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় পূরণ করতে চায় তবে সেটা অপরাধ নয়। কোন ধর্মীয় বিধিনিষেধ  যদি একজন স্বাভাবিক পূর্ণ বয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক চাহিদাকেই কুণ্ঠিত করে রাখে তবে সেই নিয়ম  মানুষের কল্যাণে কীভাবে হল?
 পরিবার থেকে শিক্ষা দেওয়া উচিত নারী পুরুষের মেলামেশা কোনভাবে খারাপ কিছু নয়। কেউ যদি কোন ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে, তবে সে একজন মেয়ের সাথেও বন্ধুত্ব করতে পারে। অথচ আমাদের পরিবার শিক্ষা দেয় সম্পূর্ণ বিপরীত। যুগের পর যুগ ধরে আমাদের মানসিকতায় ধর্মীয় বিধিনিষেধ আর রক্ষণশীলতার চূড়ান্ত এবং সর্বোচ্চ প্রভাব বিরাজমান। আমাদের সমাজের নিয়মকানুন তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে ধর্মীয় রীতিনীতি এবং  রক্ষণশীলতার উপর ভিত্তি করে।
যে রীতিনীতি গুলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে মূল্যায়ন করে না একেবারেই। অথচ রীতিনীতি গড়া উঠা উচিত মানুষের স্বাভাবিক চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে। কিন্তু এগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার চেয়ে আমরা লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করি বেশি।  আমরা ভুলে যাই লুকায়িত বা নিষিদ্ধ জিনিশের প্রতিই মানুষের আকর্ষণ সর্বদা বেশি থাকবে। অজানাকে জানার জানার ইচ্ছে কোন বিধিনিষেধ  নিয়ম  শৃঙ্খলা দিয়ে আটকে রাখা যাবে না। বা কেউ আটকে রাখতে পারেও নি।  যে জিনিসে যত বেশি নিয়ম সেই জিনিসের  চর্চা গোপনে তত বেশি।
একমাত্র  উন্মুক্ত জিনিসে কোন খারাপ ফল বয়ে আনে না।  আর যে অনুভূতি- চাহিদা- ইচ্ছে মানুষের সহজাত; তার উপর অযৌক্তিক নিয়ম আরোপ মানেই হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতিকে বিকৃত করা।  অনুভূতি যত অবরুদ্ধ হবে মানুষের রুচিবোধ ততই নিচুতে নামবে, ততই সে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আগ্রহী হবে, ততই সে একজন পরাধীন অসুস্থ বিকৃতি মানুষে পরিণত হবে।
শেয়ার করুন: