সরিতা আহমেদ:
হাল্লারানীর রাজত্বে নাকি সেদিন কে ‘ম্যাও’ ডেকেছে। এই নিয়ে রানী তার উদোমুখো, হুঁকোমুখো ও ল্যাদারুদের সভায় এনকোয়ারি কমিশন বসালেন।
কী ব্যাপার ?
না, হাল্লা সাম্রাজ্যের বিশ্বাস ‘টিকটিকি গায়ে হাগলে/পড়লে তা বেজায় অলুক্ষুণে।’
এতে কারু কোনো দ্বিমত নেই। দিব্যি সবাই টিকটিকিকে ভয়ভক্তি করে, মান্যিগণ্যি করে চলে। এরই মাঝে ‘ম্যাও’ ডাক — ” টিকটিকি গায়ে পড়লে যদি এতই অকল্যাণ হয়, তবে দেশ থেকে টিকটিকি সরিয়ে ফেললেই হয়।”
ব্যস! হাল্লারানীসহ সব্বাই চটে গেল।
‘উদোমুখো কোতোয়াল’ খবর নিল, ওটা ‘ম্যাও’ ছিল না, ছিল ‘হালুম’। একদল বাঘের বাচ্চা ‘টিকটিকি তত্ত্বে’ বিশ্বাস রাখে না তাই বেজায় মাথা খাটিয়ে প্রচলিত ‘কেতাব’ কে প্রশ্নটশ্ন করে তারা আজব আজব তত্ত্বের অবতারণা করেছে এবং দেখিয়েছে, টিকটিকি না থাকলে প্রজাদের ভাত-কাপড়ের অভাব তো হবেই না, উলটে সব্বাই নির্ভয়ে জীবন কাটাতে পারবে।
এতো ভারি আজব কথা! এদ্দিন দেশে কেউ এভাবে ভাবেনি। সব্বাই ধূপ ধুনো দেখিয়ে টিকটিকি’র প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি দেখিয়ে এসেছে, আর এখন এরা এমন ‘হালুম’ ডাকলো, যে না শুনে পারাও যাচ্ছে না। ফলে দলে দলে কিছুজন সাহস দেখিয়ে বাঘ নাকি বিড়ালের সভায় যেতে টেতে লাগল, বুঝতে লাগলো।
হাল্লারাজ্যে অলক্ষ্যেই একটা ঢেউ উঠলো, মাথা খাটানোর ঢেউ। সত্যিই তো, অমঙ্গল যদি টিকটিকির কারণে হয় তাহলে গা বাঁচিয়ে না থেকে টিকটিকি তাড়ালেই মিটে যায়।
কিন্তু এমনভাবে মাথার ব্যায়ামের চর্চা দেখ, হুঁকোমুখো জল্লাদরা কি বসে থাকবে? এদ্দিনের মান্যিগণ্যির ব্যবসা সামান্য ম্যাও ডাকে লাটে উঠতে দেওয়া তো যায় না।
ব্যস, ‘ল্যাদারু-দপ্তরে’ খবর গেল ম্যাও না হালুম যাই হোক তাদের সভায় যোগ দিয়ে গোপন খবর নিয়ে এসো। এরা দলে দলে হুকুম তামিল করতে ছুটলো এবং অনলাইন রাজ্য নামক আজবদেশ থেকে খবর আনলো চশমা আঁটা পণ্ডিত পণ্ডিত বাঘের বাচ্চারা প্রমাণ করে টিকটিকি তত্ত্বের বারোটা বাজাচ্ছে। দেশে আর টিকটিকি মেলাই দুস্কর হবে যদি ম্যাও ডাক ছড়িয়ে পড়ে।
এই শুনে জল্লাদের দল চিল্লে উঠলো, “যারা যারা টিকটিকিতে বিশ্বাস করবে না তাদের গর্দান যাবে।”
হাল্লারানীও সায় দিয়ে বললে, ‘হতে পারে ওরা বাঘের বাচ্চা, তাই বলে টিকটিকি কি ফেলনা নাকি! রাজ্যে যখন ‘টিকটিকি তত্ত্ব’ আছে, তখন সবাইকে মানতে হবে।’
এই রায়কে সায় দিয়ে ‘হুক্কাহুয়া-কাজী’র দলও বললো, ‘ টিকটিকিকে রাজ্যে খুবই প্রয়োজন । রাজ্যে বাঘ না থাকলেও চলবে , কিন্তু টিকটিকি না থাকলে রাজ্য রসাতলে যাবে । জল্লাদদের আমরা ঠেকাতে পারব না । কারণ জল্লাদরা মনপ্রাণ দিয়ে টিকটিকির রক্ষা করে এসেছে এতকাল , তাই তো আমাদের কারু গায়ে টিকটিকি হাগে নি ও অমঙ্গল হয় নি । সুতরাং সমাজে জল্লাদ আর টিকটিকি থাকা খুবই দরকার ।বাঘ না বিড়াল নিজের রাস্তা নিজেরা মাপুক ।’
হালুম বাহিনী পাত্তাই দিল না; ফলে দলের বেশ কিছুজনের গর্দান গেল ।
এই নিয়ে পাশের রাজ্য ও তার পাশের রাজ্য সবেতেই একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হল , সত্যি তো , দেশে কার বেশি প্রয়োজন ?
টিকটিকি , জল্লাদ, ল্যাদারু নাকি বাঘ !
ব্যাপার হল, কেউই বুঝে উঠতে পারল না , যাকে নিয়ে এত হৈচৈ , যার সুরক্ষার জন্য এত হুকুম তামিল সেই টিকটিকি স্বয়ং কই ?
টিকটিকি তত্ত্বের জনক রক্তচোষাকে পাওয়া গেছে ।
কিন্তু… রক্তচোষার বিচার তো হতে দেওয়া যায় না ।
‘হুঁকোমুখো জল্লাদ’ বাহীনি ‘রক্তচোষা’ -ব্রাঞ্চের হুকুম তামিল করে মাত্র ,
তাদের হুকুম তামিল করে ‘উদোমুখো কোতোয়াল’ ,
তার হুকুম তামিল করে ‘হুক্কাহুয়া কাজী’র দল
তারা আবার পরামর্শ দেয় মহান ‘হাল্লারানী’কে ।
সেইজন্য এদের সবার কথা মেনে তবে রাজ্যপাট চালাতে হয় রানীকে ।
এটা একটা ‘চুইঁয়ে পড়া নীতি’ মানা সাম্রাজ্য । যেখানে টিকটিকি কে কেউ না দেখলেও তার জনক রক্তচোষাকে আলবাত দেখেছে । তার ক্ষমতা নিয়ে কারু কোনো প্রশ্ন নেই ।
আরো বড় ব্যাপার হল রক্তচোষা ব্রাঞ্চের সাথে জল্লাদ বাহীনি ও সাঙ্গপাঙ্গদের আঁতাত সেই পুরাকাল থেকে । শুধু তাই না , এরা দলগত ভাবে ভীষন বলিষ্ঠ ও সঙ্ঘবদ্ধ । ফলে কেউ যদি এদের না মেনে একলা স্বাধীন শিকারি বাঘ নাকি বেড়াল কে মান্যি করে তবে মূর্খ্যটা কে ?
আশপাশের রাজ্যগুলোতেও তাই হুক্কাহুয়া কাজীর থেকে নোটিশ গেল , —
” ‘টিকটিকি তত্ত্বে’র গ্রহণযোগ্যতা কতদূর অটুট আছে তা সরজমিনে দেখতে ‘হুঁকোমুখোজল্লাদ’ রা ইনভেস্টিগেশনে যাচ্ছে । তাদের আটকাতে যেহেতু আমরা পারিনি ও আপনারাও পারবেন না তাই এতদ্বারা ম্যাও-ডাকা বাহীনির মুখে সেলোটেপ বা কন্ডোম পরাতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে ।
যদিও ম্যাও বাহীনির প্রসব রেট রক্তচোষার রেটের চেয়ে বেশি নয়, তবু যাতে তাদের গর্দান সালামত থাকে তাই এই কন্ডোম তত্বের নোটিশ । আপনারা এরম ‘ম্যাও’ ডাক শুনলেই জল্লাদ বাহীনিকে খবর দিন , নয়তো নিজ হাতে বেড়ালডাকা বাঘ বন্দী করুন ও টিকটিকি রক্ষা করুন ।”
নোটিশে সই করলেন স্বয়ং হাল্লারানী এবং তার উদোমুখো -হুঁকোমুখো -ল্যাদারু সামন্তরা ।
এই ভাল …
হয় , স্বাধীনচেতা বাঘের একলা বাঁচার সুযোগ নিয়ে জল্লাদবাহীনি একযোগে ঝাঁপিয়ে গর্দান নি ,
অথবা, বাঘ স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় বিদেশে পাচার হোক ।
যাই হোক না কেন টিকটিকিকে বাঁচাতে হবে ম্যাও বাহীনির থেকে ।
আর কে না জানে, রাজতন্ত্রে সকলের তরে সকলে আমরা …
সুতরাং ‘টিকটিকির জয়’ গাইতেই হবে ।
নোটিশ ছড়াতেই আশপাশ থেকে তুমুল রবে হাল্লারাজ্যের জাতীয় সঙ্গীত শোনা গেল … ‘ক্যায়া হুয়া … হুক্কা হুয়া …’
বহিরাগত আমি ল্যালাকান্ত এতক্ষণ এই রাজসভায় আড়ি পেতেছিলাম ।
কে জানে দেওয়ালের কান আছে বলেই হয়তো, এদের বিজাতীয় সঙ্গীতকে একবার শুনলাম ‘ নারায়ে তকবির …’ তো পরক্ষণেই ” জয় শ্রী রাম !”
এসব পাঁচমেশালি ধ্বনির সাথে আমার কর্নপটহে খুব জোরে ভেসে এল টিকটিকির হাঁচি … ঠিক ঠিক ঠিক ! ল্যালাকান্তের কানের আর কি বা দোষ !
পুনশ্চ : — তারপর নাকি কেটে গেছে বছর দশেক। অত:পর জানা গেল, হাল্লারাজ্য এখন টিকটিকির রক্ষাকর্তাতে ভরে গেছে, বাঘসুমারি এখন বন্ধ তাই ম্যাও ডাক শোনা যায় কিনা কেউ জানে না।
আর টিকটিকি?
সে আদৌ কারু গায়ে এখনো অবধি হাগল কিনা সেটাও কেউ স্বীকার করে না। সবাই এখন সেদেশে ফিসফিস স্বরে টিকটিকির নাকি সাপের ভাষায় কথা বলে।
————————————————-
( বিধিমত সতর্কিকরণ : উক্ত ঘটনার সাথে হালফিলের ‘সিক্কুলারিজমে’র কোনো আঁতাত নেই । সুতরাং বাদুরিয়া, বসিরহাট, বাংলাদেশ অথবা আশেপাশের অধিবাসীগণ চিন্তামুক্ত থাকুন । মেলা ব্রেন খাটিয়ে ‘ম্যাও’ ডাকবেন না যেন ! টিকটিকির জয় হোউক । )