সাহেরা বেগমের জীবনযুদ্ধ

shera 1উইমেন চ্যাপ্টার: ৫২ বছর বয়সেও নয় সদস্যের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সাহেরা বেগম। লেখাপড়া বলতে কেবলমাত্র নিজের নামটা সই করা পর্যন্তই। আর পরিবারের আয়ের উৎস একমাত্র কৃষিকাজ।

তিনি বলছিলেন, “আমি কৃষিকাজে একসময় আমার স্বামীকে সহযোগিতা করতাম। আমার স্বামীর মৃত্যুর পরে নিজেকে কৃষিকাজের সাথে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করি। বর্তমানে স্বামীর রেখে যাওয়া ৪০ শতাংশ জমি ও ৬০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে সারা বছর কৃষিকাজ করি। দরিদ্র পরিবারে আমার স্বামী যখন জীবিত ছিলেন তখন আমি বাড়ির আঙ্গিনা এবং পতিত জমিতে সব্জিচাষ করতাম এবং এই সব্জি চাষ থেকে পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি কিছু টাকা সব্জি বিক্রি করে আয়ও করতাম, যা পরিবারের ছোট খাট কাজে ব্যয় করতে পারতাম ।

শুধু যে কৃষিকাজ করতেন তাই না, একজন কৃষকের স্ত্রী হিসাবে বীজ সংরক্ষণ ও ফসল প্রক্রিয়াজাত করা ও খাদ্যশস্য সংরক্ষণের কাজও নিজেই বাড়িতে করতেন। কিন্তু স্বামীর মৃত্যু পুরো অবস্থাটা পাল্টে দেয়। তিনিই হয়ে যান একমাত্র নির্ভরশীল কৃষক। চার ছেলে-মেয়ের সবাই তখন ছোট। আর্থিক ক্ষতির মুখে যাতে পড়তে না হয়, সেজন্য নিজেই নেমে পড়েন ক্ষেতে চারা রোপণ করতে । এভাবেই শুরু হলো তার নতুন জীবন।

সাহেরা বেগমের ভাষায়, ‘ আমাকে ক্ষেতে কাজ করতে দেখে তখন শুধু পুরুষ সমাজই নয়, নারী সমাজও আমাকে বিদ্রুপ করত, আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত; কিন্তু কোন কিছুই আমাকে দমাতে পারেনি । আমি সবজি বিক্রয় করতে গিয়ে নানা রকম অসুবিধার সম্মুখীন হই । আমার পরিবারে কেউ ছিল না  যে সবজি বাজারে  নিয়ে বিক্রি করে দিবে। বাড়ির আশেপাশে লোকজনের কাছে সবজি বিক্রি করলে কখনই সঠিক মূল্য পাওয়া যেত না। তাই  প্রথমদিকে আমি নিজেই মাথায় করে শস্য নিয়ে যেতাম বাজারে বিক্রি করতে কেননা খুচরা বিক্রি করলে বাজার মূল্য একটু বেশি পাওয়া যেত।

saheraবর্তমানে তিনি বাড়ির পাশে নিজের ৪০ শতাংশ জমিতে সারাবছরই সব্জিচাষ এবং বর্গা নেওয়া জমিতে ফসলের আবাদ করেন। নিজের কষ্টার্জিত সব্জিচাষের মুনাফা সম্পূর্ণটাই নিজে ভোগ করতে পারি কিন্তু বর্গা নেওয়া জমির উৎপাদনের অর্ধেকটা জমির মালিককে দিতে হয়। কৃষিকাজের পাশাপাশি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করেন, যা দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচের কিছু অংশ এবং বাকি কিছু অংশ পরিবারের অন্য কাজে ব্যয় করেন।

প্রথম দিকে তিনবার গ্রামীন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলাম কিন্তু বেশ কিছু বছর ধরে আমি আর কোন ঋণ ছাড়াই চলছে। এরই মাঝে বড় ছেলেকে বিয়ে করালেও দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ে না। গাছ থেকে পড়ে গিয়ে তার কোমর ভেঙে যায়, ছেলের বউ ও নাতী-নাতনী রয়েছে যাদের ভরণপোষণও তাকেই করতে হচ্ছে।

বড় মেয়েকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন। পরের ছোট দুই ছেলে-মেয়ে বর্তমানে কলেজে ও স্কুলে পড়ছে। মা হিসেবে তাঁর আফসোস, বড় ছেলেকে বেশি পড়ালেখা শেখাতে পারেননি সংসারের অভাবের কারণে। আর এই ছেলেই ছোটবেলা থেকে কৃষিকাজে সহযোগিতা করেছে সবসময় । বর্তমানেও বাড়ির সব্জি ক্ষেতে বড় ছেলে একটু সহযোগিতা করে থাকে, তবে কোমর ব্যাথার কারণে বেশিক্ষণ কাজ করতে পারে না। তবে ছেলের বউ ও অন্য সন্তানেরা মায়ের পাশেই আছে।

সাহেরা বলছিলেন, কৃষিকাজের পিছনে যে খরচটুকু হয়, তার হিসাব এবং সমন্বয় নিজেই করেন। এখন দিন বদলেছে। কৃষি পণ্য এখন অনেক সময় বাড়ি থেকেই এসে নিয়ে যান পাইকাররা। আবার অনেক সময়ে মেজ ছেলের সহযোগিতায় ভ্যানে করে সব্জি পাইকারী বাজারে নিয়ে যান, তুলনামূলক একটু বেশী দাম পাওয়ার আশায় ।

শস্য ও সব্জির বীজ তিনি নিজেই সংরক্ষণ করেন এবং অনেক সময় উন্নত মানের বীজ ও সব্জির চারা বাজার থেকে কিনে আনার পর বীজতলা নিজেই তৈরী করেন। এজন্য অবশ্য ইউনিয়ন কৃষি দপ্তরের সহযোগিতায় বেশ কিছু প্রশিক্ষণে তিনি অংশ নিয়েছেন, এবং সেইসূত্রে বেশ কয়েকবার উন্নত শস্য ও সব্জির বীজ পেয়েছেন।

সাহেরা জানান, ইউনিয়ন কৃষি দপ্তরের কর্মকর্তারা সবসময় তার সব্জি ক্ষেত পরিদর্শনে এসে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কোন শস্য কিংবা সব্জি ক্ষেতে কোন প্রকার সমস্যা হলে তিনি নিজেও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কৃষি দপ্তরের কর্মকর্তার সাথে পরামর্শ করে থাকেন । তবে এটাও সত্য যে, সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোন কৃষি সরঞ্জাম বা কোন উপকরণ বা তেমন কোন প্রণোদনামূলক সহযোগিতা তিনি পাননি। সম্পত্তির মালিকানা, দেখাশুনা ও জমি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে তিনি এখন পর্যন্ত কোন বাধার সম্মুখীন না হলেও, চাষাবাদের ক্ষেত্রে অনেক বাধার মুখে পড়েছেন।

যেমন – শুকনো মৌসুমে ক্ষেতে সেচ দেওয়া, নারী হওয়ার কারণে সরকারী বীজ, সার ইত্যাদি পেতে বৈষম্যের শিকার হওয়া ইত্যাদি। পারিবারিকভাবে সব সিদ্ধান্ত তিনি একাই নেন। তার মতে, বর্তমানে একজন সফল অনুকরণীয় নারী কৃষক হিসাবে সমাজে তার সম্মান বেড়েছে। গ্রামের বিভিন্ন আলোচনায় তিনি আজকাল অংশ নেন, বিশেষ করে কৃষিসংক্রান্ত সভাগুলোতে। পরামর্শ দেন কেউ চাইলে। অনেক নারী এখন তার দেখাদেখি সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন, সাহেরার পরামর্শ নিচ্ছেন এক্ষেত্রে।

সাহেরার বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের পরিমাণ ৯০,০০০ – ১০০,০০০ টাকা যা আমি পুরোটাই সমন্বিত কৃষিকাজের মাধ্যমে যোগান দেন। মাসিক কিছু পরিমাণে টাকা ডিপিএস-এ ব্যাংকে সঞ্চয় করেন।

কৃষিতে নারীর ভূমিকাকে কিভাবে দেখেন জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখেন। তিনি চান, গ্রামীণ পর্যায়ের সকল নারীই যেন অন্তত বসতভিটায় সব্জি চাষ করে এবং কৃষিতে নারীর সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন প্রণোদনা মূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে নারীরা অনেক আগ্রহী হবেন। আরেকটা চাওয়া আছে তার, কৃষাণী হিসাবে সকল নারী কৃষকের স্বীকৃতি। ছোট দুই ছেলে মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা কৃষিকাজের পাশাপাশি সাহেরার এখন একমাত্র স্বপ্ন।

শেয়ার করুন: