মুকুল-কাণ্ডে ফের প্রশ্নবিদ্ধ পেশাদারি সাংবাদিকতা

Demo 3বিপ্লব শাহরিয়ার: শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই নাকি অনেক সংবাদকর্মি ধাক্কা খেয়েছেন। সাংবাদিক রকিবুল ইসলাম মুকুলের মতো এমন পরিচ্ছন্ন (?) ইমেজের একজন সাংবাদিক স্ত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এটা অনেককেই ধাক্কা দিতে পারে। কিন্তু ঘটনাটি যারা আগাগোড়া কিংবা খানিকটা জানতেন তাদেরকে অবশ্য খবরটি ধাক্কা দিতে পারেনি।

এই সাংবাদিক দম্পতির সন্তান চন্দ্রমুখী’র মৃত্যুর পর যে সহানুভূতি পেয়েছিলেন তারা, তা কাঙ্খিতই ছিলো। কিন্তু তারপর? একের পর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে কিংবা কবিতায়, কখনো বা অনুলিখনে নিজের যে ইমেজ মুকুল তৈরি করে নেন তা সহজে মেলে না। এমন ইমেজ আমি, আমরা কিংবা আমাদের মতো অনেকেই কামনা করেন। কিন্তু ধারে-কাছেও যেতে পারেন না।

একদিন যারা মুকুলের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম সেই আমরাই মুকুলের গ্রেপ্তারের পর থেকে মুকুলের উপর থেকে সহানুভূতি তুলে নিয়েছি। খবরপাড়ায় শনিবার দিনভরই সমালোচনা করেছি মুকুলের। কখনো তা সীমার মধ্যে, কখনো সীমা ছাড়িয়ে। তবে ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রতিবাদ কিংবা সমালোচনার ক্ষেত্রে স্পষ্ট একটা চরিত্র ঠিকই খুঁজে পেয়েছেন সাংবাদিক সুপ্রীতি ধর। সেটাই তিনি লিখেছিলেন নিজের স্ট্যাটাসে।

‘…আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, গাজী টিভির ‘নিউজ এডিটর’ রকিবুল ইসলাম মুকুলকে স্ত্রী নির্যাতনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হ্ওয়ার নিউজগুলো আমরা মেয়েরাই কেবল শেয়ার দিচ্ছি। আমাদের ‘পুরুষ’ সাংবাদিক, সহকর্মীরা এ নিয়ে সোচ্চার নয়। দিলে আঘাত পেয়েছেন আপনারা?’

Biplob Shahriar
বিপ্লব শাহরিয়ার

পুরুষ সাংবাদিক কিংবা পুরুষ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা যে একেবারেই কিছু লেখেননি তা কিন্তু নয়। তবে সেই সংখ্যা এতোটাই কম যে রীতিমতো দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য দরকার ছিলো। এই যেমন আমিও কিছু লিখিনি। আমার পরিচিত অনেক পুরুষই লেখেননি। বিশেষ করে যারা কিছু ঘটলেই স্ট্যাটাস আর কমেন্টের বন্যা বইয়ে দেন, তারাও না।

নানা কারণেই আমরা পুরুষরা মুকুল-কাণ্ডে ফেসবুকে কিছু লেখা থেকে বিরত ছিলাম হয়তো। কেউ হয়তো লজ্জায় লিখিনি, কেউ হয়তো বা দিদি’র আশঙ্কা অনুযায়ী ‘দিলে আঘাত’ পেয়ে লিখিনি। দিদি’র স্ট্যাটাসের বিপরীত কমেন্টস-এ আমি সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম।

লিখেছিলাম, ‘না দিদি, দিলে আঘাত পাইনি। আমার যারা বিভিন্ন ঘটনায় অসংখ্য লাইকবহুল স্ট্যাটাস দেই, এই ঘটনাটিতে কিছু লেখার কিংবা শেয়ার করার আগে হয়তো নিজেকে আয়নায় দেখতে পাচ্ছি। তাই শরমে-মরমে আজ ফেসবুকে নিজস্ব ব্ল্যাকআউট আরোপ করেছি।’

অপর সাংবাদিক সুলতানা রহমান যখন স্ট্যাটাসটি দিয়েছেন তার প্রায় ১০ ঘন্টা পর সেটি আমার নিউজ ফিডে দেখিয়েছে।

জেষ্ঠ্য এই টিভি সাংবাদিক তার স্ট্যাটাসের শুরুতেই লিখেছেন, ‘কাক কাকের মাংস খায়না’-কোনো সাংবাদিক যখন কোনো অপরাধ করে, অন্যায় করে-সেই খবর প্রচার, প্রকাশের সময় বেশির ভাগ গণমাধ্যম এবং নীতি নির্ধারকেরা এমন এক ভয়ঙ্কর সেল্ফ সেন্সরশিপ করেন।

যেকোনো সহকর্মীর সঙ্গে ‘ফেলো ফিলিং’ থাকাটা যেমন জরুরী তেমনি একজন অপরাধীর সঙ্গে ‘ফেলো ফিলিং’ দেখানো অপরাধের ভাগীদার হওয়া। সাংবাদিক আর সেনাবাহিনী-এই দুই পেশার কেউ অপরাধি বা অভিযুক্ত হলে সেন্সরশিপ চরমে ওঠে। এতে অপরাধ করেও এই পেশার অনেকে নিজেকে ধরা ছোয়ার বাইরে মনে করে।’

বলার অপেক্ষা রাখে না, মুকুলকে গ্রেপ্তারের খবরটি গণমাধ্যমগুলোতে সেইভাবে প্রচার না হওয়ায় ক্ষোভ নিয়েই এমন নির্মম একটি সত্য তুলে ধরেছেন সুলতানা রহমান। তার অভিযোগে মূলত কাঠগড়ায় গণমাধ্যমের পেশাদারিত্ব। কিন্তু কিছুটা দ্বিমত করতে চাই আমি।

মুকুল-কাণ্ডে সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সবাই কি তাদের দায়িত্বে অবহেলা করেছে? প্রথম থেকেই কিন্তু প্রথম সারির অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং দৈনিকগুলোর অনলাইন সংস্করণে এই সংবাদটি প্রকাশ করা হয়েছে। সংবাদটিতে গুরুত্ব কম দেয়া কিংবা এটি kill করার দায়টা বরং টেলিভিশনগুলোকেই নিতে হবে।

সুপ্রীতি ধরের স্ট্যাটাসে একজন কমেন্ট লিখেছেন, ‘…. নিউজ স্ক্রলে দিয়েছে।’ মোটা দাগে শনিবার এটাই তো করেছে টেলিভিশনগুলো। স্ক্রল ছাড়া কয়টা টেলিভিশনের বুলেটিনে মুকুলের গ্রেপ্তার এবং পরবর্তীতে একদিনের রিমান্ডের সংবাদটি ঠাঁই পেয়েছে! শুধুমাত্র একাত্তর জার্নালেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো রকিবুলের স্ত্রী, সাংবাদিক নাজনীন আখতার তন্বীকে। এমনকি একাত্তরের বুলেটিনেও সংবাদটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এই পেশাদারিত্ব আর কোন টেলিভিশন দেখিয়েছে শনিবার? নিঃসন্দেহে বলা চলে, সব কাক এক না। অন্তত মুকুল-কাণ্ডে বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলোর অপেশাদারিত্ব ফুটে উঠেছে ভিষণভাবে। অনলাইন আর পত্রিকাগুলোতেও অপেশাদারিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে। সেটা ভিন্ন বিতর্ক। কথা হচ্ছে মুকুল-কাণ্ড নিয়ে। যেখানে ব্যর্থ বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলো।

এবার আসি সুলতানা রহমানের স্ট্যাটাসের দ্বিতীয় অংশে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘গাজী টেলিভিশনের নিউজ এডিটর রকিবুল ইসলাম মুকুল দীর্ঘদিন ধরে তার স্ত্রী জনকন্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার নাজনীন আখতার তন্বীর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছিল। সাংবাদিক নেতা থেকে শুরু করে কমিউনিটির অনেকেই বিষয়টি অবহিত ছিলেন। কেউ মুকুলের টিকিটিও ধরতে পারেনি। ‘কাক কাকের মাংস খায়না’বলে যারা নিজেদেরকে কাক গোত্রের মনে করেন, তারা কাকের মতোই চোখ বন্ধ করে থেকেছে আর হয়তো ভেবেছে কেউ কিছু জানে না, তারা এর সমাধানের তেমন জোরালো কোনো চেষ্টা করেছে বলে শুনিনি। নির্যাতন আর সহ্য করতে না পেরে আজ যখন তন্বী মামলা করেছে মুকুলের বিরুদ্ধে, এবং মুকুলকে এরেস্ট করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তখন অনেক গণমাধ্যমেই খবরটি যথাযথ ভাবে স্থান পায়নি ‘কাক কাকের মাংস খায়না’ বলে। আসলে এ দিয়ে তারা কি আড়ালে করতে চায়? সাংবাদিকের ভাবমূর্তি রক্ষা? এভাবে কি ভাবমূর্তি রক্ষা করা যায়? যায় না। খবরটি যথাযথ ভাবে স্থান না দিয়ে আসলে কাকের মতোই চোখ বন্ধ রেখে ভেবেছে কেউ দেখেনি! ভাবমূর্তি যদি সত্যিই রক্ষা করতে হয় তাহলে দরকার শুদ্ধি অভিযান, ন্যায় বিচার। মুকুলকে আড়াল না করে তন্বীকে ন্যায় বিচার পেতে সহযোগিতা করার মধ্য দিয়েই শুরু হোক শুদ্ধতার চর্চা।’

সাংবাদিকতা পেশার উৎকর্ষের পাশাপাশি সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষা কিংবা তাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কোন প্ল্যাটফর্মটি ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশে? বিভিন্ন ফোরামে যারা নেতা হয়ে বসে আছেন তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতেই সবচেয়ে বেশি অনিয়ম খুঁজে পাওয়া যায়। তাদের প্রতিষ্ঠানেই তো বিনা কারণে চাকরি হারায় সাংবাদিকরা। বেতন বন্ধ থাকে মাসের পর মাস। কিন্তু ওই নেতারা ঠিকই ঠিকই গাড়ি হাঁকাচ্ছেন, বিদেশ সফর করছেন।

খোঁজ নিলে দেখা যাবে, একাধিক প্লট-ফ্ল্যাটের মালিকও তারা। এরা চোখ বন্ধ করে থাকবে- এটাই তো স্বাভাবিক। যেমনটা ছিলো অতীতের প্রায় সব ঘটনায়। যে দেশে সাংবাদিক ইউনিয়নের দু’টি গ্রুপ, ফেডারেল ইউনিয়নের দু’টি গ্রুপ, সবশেষ জাতীয় প্রেসক্লাবেও স্পষ্ট বিভক্তি- সেই দেশে সাংবাদিকের সুরক্ষা দেবেন সাংবাদিক নেতারা? এতটা আশা করা কি বোকামি হবে না? বরং তথাকথিত ওইসব নেতাদের কেউ কেউ যে মুকুলকে বাঁচাতে আড়ালে কাজ করবেন- সেটা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

সুলতানা রহমানের স্ট্যাটাসের শেষ অংশের সঙ্গেও আমি কিছুটা দ্বিমত প্রকাশ করতে চাই। শুদ্ধতার চর্চার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সেই চর্চার শুরুটা তিনি করতে বলেছেন মুকুলকে আড়াল না করে তন্বীকে ন্যায়বিচার পেতে সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে।

এই সহযোগিতার আহ্বানে আমার কোনো দ্বিমত নেই।

আমার প্রশ্ন শুদ্ধতার এই চর্চা আমরা কেন সাগর-রুনির ক্ষেত্রে শুরু করতে পারলাম না। অথবা শুরু করলেও তা ধরে রাখা গেলো না কেন? কার স্বার্থে? অথবা কার ইশারায়? সেখানেও কি সেই ‘কাক’ আর ‘মাংস’ তত্ত্বই কাজ করেছে? শুদ্ধতার চর্চা শুরু করতে এই প্রশ্নগুলোর জবাব বের করা জরুরী সবার আগে। নয়তো এই অশুদ্ধ রীতি, এই অপেশাদারিত্ব, এই আড়াল করার সংস্কৃতি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে চলতেই থাকবে।

বার্তা সম্পাদক, এসএটিভি

[email protected]

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.