সাংকৃত্যায়ন: পোশাক নির্ভর করে একটি দেশের আবহওয়া ও সংস্কৃতির ওপর। আরব অঞ্চলে ধূলাবালি-সূর্যতাপের কারণে সেখানকার মানুষ নিজেদের বাঁচাতে সম্পূর্ণ শরীর কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে। সাদা কাপড় সূর্যের তাপ কম লাগে, তাই সেখানকার পুরুষরা সাদা পাঞ্জাবীর মত কোর্তা পরে। কিন্তু প্রথা’টি ডগমেটিক রূপ পাওয়ায় আমাদের সমাজে শুধুমাত্র নারীদের পর্দা প্রথাটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট না জেনে জোর করেই গেলানো হয়।
ভারত উপমহাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ নারীদের ক্ষেত্রে মাথায় সিঁদুর, হাতে চুড়ি খুবই সাধারণ একটি বিষয়। তবে ইতিহাস বলে, শাঁখা-সিঁদুর নারীর জন্য সর্বোচ্চ অপমানের। তখনকার দিনে নারীদের জোর করে রক্ষিতা-যৌনদাসী বানানো হতো। সেখান থেকেই ধর্ম’মতে নারীদের চুড়ি ইঙ্গিত করে হাতের শিকল- লোহার খাড়ু, এবং মাথার সিঁদুর ইঙ্গিত করে মাথা ফেটে দেওয়া আঘাতের চিহ্ন।
পুরুষের কুদৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচার জন্য নারী তার স্বাভাবিক কাপড়ের উপর আরেকটি বিশাল কালো কাপড়ের আড়ালে থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই কমনসেন্সযুক্ত পুরুষ প্রচণ্ড অপমানবোধ করে। আমার নিজেরও বলতে ইচ্ছে হয় “আমরা পুরুষ, হাঙ্গর-তিমি-পিরানহা নই!”
গোলাম মুরশিদ তার হাজার বছরের বাঙলা সংস্কৃতি বইতে দেখিয়েছেন, কয়েক শতাব্দী আগে, বাংলার নারী পরতো শুধুই শাড়ি, কোন ব্লাউজ-পেটিকোট থাকতো না; বুকের ডান পাশ স্পষ্ট দেখা যেতো। পুরুষরা পরতো ধুতি। মুসলমান-হিন্দু সবাই ধুতি পরতো। এরপর বার্মা থেকে লুঙ্গি, ইউরোপ থেকে গেঞ্জি, আঠারো শতকে শেষের দিকে আসলো জুতা। অন্যদিকে ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে নারীরা পেলো নিজেদের রক্ষা কবজ পর্দা। একসময় হিন্দু শিক্ষিত পরিবারেও কঠিন পর্দাপ্রথা ছিল।
জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে কঠিন পর্দা প্রথা ছিল, রবীন্দ্রনাথের মা গঙ্গা স্নান করতে চাইলে তাকে পাল্কিসুদ্ধ গঙ্গার পানিতে চুবানো হতো। তবুও পাল্কি থেকে বের হতো না।
দীনবন্ধু মিত্রের লেখাতে দেখা যায়, হিন্দু সামজে নারীদের দিনের বেলা পুরুষ তো দূরের কথা, নিজের স্বামীর সাথেও দেখা করাতেও নিষেধ ছিল। বাঙালি সমাজে থ্রি-পিস এসেছে মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে, দিল্লী থেকে। বাংলার পোশাকের ইতিহাস পড়তে গিয়ে পেয়েছি, প্রতি শতকে একবার করে বাঙালি পুরুষের পোশাকে পরিবর্তন এসেছে। বাঙালি পুরুষ শিক্ষিত হওয়ায় ইউরোপ সংস্কৃতির প্যান্ট-শার্ট ধার নিলো। আর বাঙালি নারী প্রতি শতাব্দীতে কামদেবী হয়েই পরে রইল; নিজেদের বাঁচাতে তাদেরকে কাপড়ের উপর কাপড় পরানো হল।
বস্তুত পোশাকই ইঙ্গিত করে বাঙালি (বাংলাদেশী) পুরুষের কাছে নারী যৌনতার প্রতীক, যৌন পুতুল- তাই বাঙলার নারীদের ওড়নার আড়ালে থাকতে হয়।
হুমায়ূন আজাদ তার ‘নারী’ বইতে যথার্থ বলেছেন, “যুগে যুগে পুরুষ এমন এক সভ্যতা গড়ে তুলেছে, যা নারীকে সম্পূর্ণ বন্দি করতে না পারলেও ধ্বংস হয়ে যাবে বলে পুরুষের ভয় রয়েছে; যার নাম পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতা। পুরুষ নারীকে গৃহে বন্দী করেছে, তাকে সতীত্ব শিখিয়েছে, সতীত্বকে নারীর জীবনের মুকুট করে তুলেছে, যদিও লাম্পট্যকেই করে তুলেছে নিজের গৌরব।
বাংলায় যারা নারীদের কল্যাণ চান, নারীর কল্যাণ শুভবিবাহে, সুখী গৃহে; স্বামীর একটি মাংসল পুতুল হওয়াকেই তাঁরা মনে করেন নারী জীবনের সার্থকতা।”
আমি ভারতে ছয় মাস ছিলাম- তার মধ্যে কলকাতায় চার মাস। কলকাতার নারীরা সালোয়ার কামিজের সাথে ওড়না পরে না। মেয়েরা বিশেষত পরে টি-শার্ট- গ্রাম শহর সব জায়গায় একই চিত্র। কিন্তু ওখানে নারীদের পর্দা নিয়ে কিছু বললে, মেরে হাড়মাংস এক করে দিবে।
মূল বিষয় হল, সুশীলতা আর মৌলবাদ যাই হোক, যতদিন সবার চোখ ঠিক হবে না নারী ইস্পাতের আড়ালেও ধর্ষিত হবে। পাঁচ বছরের শিশু যখন ধর্ষিত হয় তখন সে কাপড়ের জন্য ধর্ষিত হয় না। মাদ্রাসার ছাত্রী যখন ধর্ষিত হয় তখনই সে মেয়েটি কাপড়ের জন্য ধর্ষিত হয় না। সাউথ আফ্রিকায় পুরুষ ধর্ষিত হয়, সেই ধর্ষণ কি কাপড়ের জন্য হয়? প্রায় মাস তিনেক পর পর মাদ্রাসার ছাত্র (ছাত্রী নয়) ধর্ষণের খবর পত্রিকায় থাকে, সেই ধর্ষণও কি কাপড়ের জন্য হয়? সব কিছু দৃষ্টিভঙ্গির উপরেই নির্ভর করে।
ভারতে সার্বিক ধর্ষণের রিপোর্টের সংখ্যা বাংলাদেশ থেকে বেশি। এর কারণ দুটি, ভারতে নারীর গায়ে হাত দিলেও ধর্ষণের মামলা করে দেওয়া হয়, অন্যদিকে বাংলাদেশে ধর্ষিত হওয়ার পরেও পুলিশে রিপোর্ট করা হয় না। এবং দ্বিতীয় কারণ ভারতে অনেক প্রদেশ, যেমন বিহার-উত্তর প্রদেশে ধর্ষণ করা গর্বের বিষয়। অন্যদিকে সৌদি-আরবে ধর্ষণের সংখ্যা কম, কারণ আরবে ধর্ষকের চেয়ে ধর্ষিতার শাস্তি হওয়ার ইতিহাস বেশি।
শরিয়া আইন মতে ধর্ষিত হচ্ছে ওই সময়কার দর্শকদের সাক্ষ্য নিতে না পারলে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। উল্টা ধর্ষিতার শাস্তি হবে। কিন্তু আমি কলকাতায় দেখেছি নারীরা টিশার্ট-জিন্স প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বুকে কোনো ওড়না নেই- অথচ কোন পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে না।
ছয় মাসে অনেক বন্ধু হয়েছিল- কারো মাঝেই নারী ওড়না নিয়ে কুদৃষ্টি দেখিনি। এর মাঝেও দিল্লী- মুম্বাই-কলকাতাতে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলে সাড়া প্রদেশে আগুন লেগে যায়। মেয়েরা টিশার্ট পরার বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। নারীকে ওড়না ছাড়া তাদের কাছেই অস্বাভাবিক যারা মৌলবাদী এবং প্রতিক্রিয়াশীল। বাংলাদেশে প্রতিদিন, প্রতিমাসে ধর্ষণ এবং ইভটিজিং এর এত বেশি খবর পত্রিকায় থাকে, তা দিয়ে মাসিক “ধর্ষণের খবর” নামে ট্যাবলেট পত্রিকা বের করা যাবে।
মনে হয় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অনলাইনে নারীর কাপড় নিয়ে তিনটি বড় প্রগতিশীল ঝড় গিয়েছে- প্রথমটি ছিল ইউ-ল্যাবের সামনে একটি যৌন হয়রানীর ঘটনা থেকে, যা সামু ব্লগের একটি ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে আন্দোলন ছড়িয়ে পরে। দ্বিতীয়টি শফি হুজুর নারীদের তেঁতুল বলার ভিডিও ছড়িয়ে পরার পর। এবং তৃতীয়টি, গত কয়েকদিন আগে টিএসসিতে তরুণী লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা থেকে।
এর মধ্যে টিএসসির ঘটনাটি বেশ লজ্জার হলেও গত কয়েকদিনের নারীর পোশাক পরিবর্তনের বিষয়ে ভার্চুয়াল ঝড় থেকেই বোঝাই যাচ্ছে সমাজের দৃষ্টিতে বেশ পরিবর্তন এসেছে। ভার্চুয়াল জগতে যারা প্রগতিশীলতার কথা বলে এতদিন নানাভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছে তাদের জন্য বিষয়টি বেশ আশার।
আমরা চাই আরও পরিবর্তন আসুক। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, বাঙলার পুরুষের পোশাকে প্রতি শতাব্দীতে পরিবর্তন এসেছে। চাই নারীদের পোশাকেও পরিবর্তন আসুক। পোশাক হয়ে উঠুক আধুনিক। কলকাতার মতো বা১লার নারীরা মুক্ত ঘুরে বেড়াক টিশার্ট-ফতুয়া পরে। এই যুদ্ধে নারীদের মুক্ত করতে না পারলে এ’সমাজ মৌলবাদীদের দখলেই থাকবে। তাই নারী মুক্তির আন্দোলনে নারীর পোশাকি মুক্তি সবার আগে প্রয়োজন।
(একান্তই লেখকের ব্যক্তিগত মতামত। উইমেন চ্যাপ্টার এজন্য দায়ী নয়)