নারীর শ্লীলতা-সম্ভ্রম কী তার শরীরে?

Sheuly
শামীম আরা শিউলী

শামীম আরা শিউলী: পহেলা বৈশাখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারীদের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা বা তাদের ওপর শারীরিক হামলার কোন প্রমাণ পায়নি পুলিশ। সিসিটিভির ফুটেজে নারীদের ধাক্কাধাক্কি খাওয়ার কিছু চিত্র অবশ্য তারা পেয়েছে। লিটন নন্দী বা তার সঙ্গীদের সাক্ষ্য যথেষ্ট নয়। যেহেতু ভুক্তভোগীরা কেউ অভিযোগ দায়ের করেনি, তাই এমন কোন ঘটনা ঘটেনি বলেই আমাদের মেনে নিতে হবে। ভুলে যেতে হবে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার যা কালিমা লিপ্ত করেছে আমাদের সার্বজনিন প্রাণের উৎসবকে।

কিন্তু কে মুখ খুলবেন? এর আগে এমন ঘটনায় যারা মুখ খুলেছিলেন, অভিযোগ দায়ের করেছিলেন,তারা কী বিচার পেয়েছেন? পাননি। এজন্য যতটা না আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা দায়ী, আন্তরিকতার অভাব দায়ী, যতটা না বিচার প্রক্রিয়া দায়ী, তার চেয়েও বেশী দায়ী আমাদের মন-মানসিকতা।

আমাদের এক অসুস্থ চিন্তাধারা, যা শেষপর্যন্ত তাদের লড়াই করতে দেয়নি। কারণ প্রথমে আমরা তাদের চরিত্র নিয়ে টানাটানি তো করেছি, এরপর বলে দিয়েছি তাদের শ্লীলতাহানী করা হয়েছে বা সম্ভ্রমহানি হয়েছে। ভু্ক্তভোগী নারী এসব শব্দে তখন কুঁকড়ে গেছেন। কারণ সমাজ তাকে আলাদা করে দেবে, অসম্মানের চোখে দেখবে। তাই অভিযোগ নিয়ে সে আর শক্ত থাকতে পারেনি। সে আর বিচার চাইতে আসেনি। হারিয়ে গেছে নীরবে। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে টিএসসিতে আক্রান্ত বাঁধন এভাবেই নীরব হয়ে গেছেন।

গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত গত কয়েকদিনের সংবাদগুলো পর্যালোচনা করে যা পেলাম, হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া্ সবগুলোতেই ঘটনার বর্ণনায় বার বার ‘শ্লীলতাহানি’ ‘সম্ভ্রমহানি’ ‘যৌন হয়রানি’ ‘যৌন নিপীড়ন’ ‘লাঞ্ছিত’ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। কেন আমরা এসব শব্দ ব্যবহার করি, বিশেষ করে ‘শ্লীলতাহানি’ ‘সম্ভ্রমহানি’র মতো শব্দ?এভাবেই কী ভুক্তভোগীদের বিচার চাওয়ার পথটা রুদ্ধ করে দিচ্ছি না? আমার অবশ্য ‘যৌন হয়রানি’ বা ‘যৌন নিপীড়ণ’ শব্দের ব্যবহারেও আপত্তি আছে।

নারীর উপর শারীরিক হামলায় কেন নারীর শ্লীলতাহানি হবে? কেন তার ‘সম্ভ্রমহানি’ ঘটবে? একইভাবে ধর্ষণের  শিকার নারীর কেন ‘সর্বস্ব লুন্ঠন হবে’?  কেন তার ‘ইজ্জত নষ্ট’ হবে? নারীর ‘শ্লীলতা’, ‘সম্ভ্রম’, ‘ইজ্জত’ কী নারীর শরীরে থাকে? পুরুষের সম্ভ্রম বা ইজ্জত তাহলে কই থাকে?

যুগ যুগ ধরে আমরা যে অসুস্থ দৃষ্টিভঙ্গী ধারণ করে আসছি, তাতে তথাকথিত ‘সতীত্ব’ ‘সম্ভ্রম’ বা ‘শ্লীলতা’ হলো নারীর অমূল্য সম্পদ, যা থাকে তার যৌনাঙ্গে এবং সেখানে হামলা হলে, নারী তার সেই অমূল্য সম্পদ ‘ইজ্জত’ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু হামলাকারী পুরুষের ইজ্জতের কোন হানি হয় না। উল্টো ভুক্তভোগী নারীর আর সমাজে সম্মানজনক কোন স্থান থাকে না। কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা অসহায় নারীর মৃত্যু উৎসাহিত করি। একজন মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হয় তখন সমাজ বলে যে, সব তার সর্বস্ব হারিয়েছে। তার শিক্ষা, মেধা, পেশাগত অর্জন, সৃজনশীলতার কোনো অর্থই আর থাকে না।আমাদের সাহিত্যে, নাটকে, চলচ্চিত্রে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ। এগুলোতো আমাদের সমাজেরই ছবি।

বাংলা সিনেমা বা নাটকে, অথবা আমাদের পাশের দেশ ভারতে হিন্দি সিরিয়াল বা সিনেমায় অহরহ ধর্ষণের যে দৃশ্য থাকে, সবসময় দেখা যায় ধর্ষণের শিকার মেয়েটি বলছে, “তার সব শেষ হয়ে গেছে” (হিন্দিতে ‘বরবাদ’ হয়ে গেছে) কাজেই তার আর বেঁচে থেকে লাভ নেই। এরপর হয় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা, নয়তো নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু।

খুব ছোটবেলায় দেখা যে বাংলা যে চলচ্চিত্রটি মনে খুব দাগ কেটেছিল ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সেখানেও এমন একটি মৃত্যুর ঘটনা ছিল। নব্বইয়ের দশকে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল হিন্দি চলচ্চিত্র, ‘অঙ্কুশে’। আক্রান্ত নারীকে আইনী লড়াই করতে দেখি, কিন্তু অপমানের গ্লানি সইতে না পেরে শেষে আত্মহত্যারই পথ বেছে নেয়।

গল্প-উপন্যাসেও একই অবস্থা। এভাবেই চলচ্চিত্র, গল্প, নাটক বা গণমাধ্যমের সংবাদ দিয়ে আমরা এই অসুস্থ দৃষ্টিভঙ্গীকে টিকিয়ে রাখি। আর এ ক্ষেত্রে কোন শ্রেণীবৈষম্য নেই। প্রান্তিক দরিদ্র নারীটির ক্ষেত্রেও যে গ্লানি, উচ্চবিত্ত নারীরও সে অপমান। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রান্তিক দরিদ্র নারীটি বিচার চাইতে পারে, কিন্তু উচ্চবিত্ত নারীর পক্ষে তা সম্ভব হয় না।

এই ধারণার কারণেই নারী ছুরিকাঘাতের শিকার হলে সে বিচার চাইতে পারে। তার ক্ষতও সেরে যায়। কিন্তু ধর্ষণের শিকার হলে তার শারীরিক ক্ষত সেরে গেলেও, মনের ক্ষত সারে না। কারণ শৈশব থেকে সমাজ তাকে শিখিয়েছে, এতে তার শ্লীলতাহানি ঘটেছে, তার সব শেষ হয়ে গেছে।

মানুষ তাকে আঙ্গুল দিয়ে আলাদা করে দেখিয়ে দেয়। কোন অপরাধ না করেও তাকে আমরা লজ্জিত করে রাখি। অপমানের গ্লানি নিয়ে সে বিচার চাইবে কেমন করে?

মনে পড়ে,আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী, রোকেয়া হলে গেছি এক বান্ধবীর কাছে, হঠাৎ আমার বান্ধবীটি একটি মেয়েকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, চিনেছিস? সে মেয়েটার নাম বললো, আমি চিনতে পারলাম। মেয়েটি একটি বিভাগীয় শহরে কলেজে পড়ার সময় গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল। অপরাধীদের একজন সাবেক মেয়রের ভাইপো, খুব প্রভাবশালী পক্ষ। মেয়েটি খুব সাহসের সঙ্গে লড়েছিল। দেশজুড়ে এই ঘটনা তোলপাড় করেছিল এবং অপরাধীদের শাস্তি হয়েছিল। আমার বান্ধবী ওকে খারাপ ভেবে দেখিয়ে দেয়নি। কিন্তু বাস্তবতা হলো অতীতকে পেছনে ফেলে মেয়েটি সামনে এগিয়ে এসেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, কিন্তু আমরা তাকে আলাদা করে দেখেছি।

মেয়েটিকে কেউ ছুরিকাঘাত করলে বা তাকে মারধর করলে কিন্তু আমারা তাকে মনে রাখতাম না।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কয়েক লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, আমরা কী বলতে পারিনি তাদের উপর ভয়াবহ শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার হয়েছিল? এতে কী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অপরাধের মাত্রা কমে যায়? কেন আমরা বলি তাদের সম্ভ্রমহানি ঘটেছে? এভাবেই কী আমরা তাদের আলাদা করে দেইনি? বন্ধ করে দেইনি স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথটি? চার দশক আগে না হয় আমাদের চিন্তার এত উন্নতি হয়নি। এখন তো হয়েছে। এখন কী আমরা আমাদের ভুল শোধরাতে পারি না?

পুরুষরা যখন এই বার্তাটি পাবে তখন আর ধর্ষণ করে বা শারীরিক নির্যাতন করে নারীকে অপমানিত করতে পারবে না। তখনই তারা এ ধরনের হামলা বন্ধ করবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পুরুষ একজন নারীকে ধর্ষণ বা নির্যাতন বা হয়রানি করে সেক্সের জন্য না। তারা নারীকে অপমান করতে চায়, খাটো করতে চায় বলেই এই অপরাধগুলো ঘটায়।

এই ভুল ভাঙতে সমাজ ও রাষ্ট্র যন্ত্রের সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ব্যবহার করতে হবে যোগাযোগের সবগুলো হাতিয়ার।

সংবাদে, কবিতা, গানে, গল্পে, চলচ্চিত্রে একই সঙ্গে বারবার বলতে হবে। ‘শ্লীলতা’ নারীর শরীরে থাকে না, থাকে না তার পোশাকেও , যেমনটি থাকে না পুরুষের জন্যও। ধর্ষণ নারীর উপর ভয়াবহ শারীরিক হামলা। এর সঙ্গে তার ইজ্জতের কোন সম্পর্ক নেই। একজন পুরুষের উপর শারীরিক হামলা হলে সে যেমন পরে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, আক্রান্ত নারীও তেমনই স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে।

এখন অনেক গণমাধ্যম ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগীর নাম ও ছবি প্রকাশ করেন না। শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তারা সাবধানতা অবলম্বন করতে পারেন। গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের বিকল্প শব্দ বের করতে হবে যেগুলো ব্যবহার করলে নারীদের অপমান বা অসম্মান হবে না, তাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেবে না। চলচ্চিত্রে নারীর উপর শারীরিক হামলা বা ধর্ষণকে কীভাবে দেথানো হবে সে বিষয়ে সরকারের সুনির্দ্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা দরকার এবং ছাড়পত্র দেয়ার সময় তা নজরদারি করতে হবে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়ার সময়ে এবিষয়ে শব্দচয়নে সতর্ক থাকতে হবে।

নারী যখন এই ধরনের হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারবে কোনরকম লজ্জা বা আতংক ছাড়াই, তখনই রাষ্ট্র শাস্তি দেবে অপরাধীদের। এভাবেই একসময় এই অপরাধের মাত্রা কমতে বাধ্য।

যেদিন থেকে আমাদের বোধোদয় ঘটবে যে যৌন হামলায় নারীর শ্লীলতাহানি ঘটে না, সেদিন থেকেই নারী সব মানসিক বাধা কাটিয়ে উঠতে পারবে। সে আর ভয় পাবে না অভিযোগ দায়ের করতে। দুর্বল হবে না আইনী লড়াইয়ে। হামলাকারী নরপিশাচরাও আর সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে পার পেয়ে যেতে পারবে না। হয়তো যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে তাদের নারীদের ধর্ষণের কৌশল ব্যবহারও বন্ধ হয়ে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক ও উন্নয়ন অ্যাক্টিভিস্ট

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.