আমি কি আমার হতে পেরেছি কখনো?

Leena 2
লীনা

লীনা পারভীন: জন্মের পর থেকে মন কি হতে চেয়েছিলো বা কি করতে চেয়েছিলো তা ঠিক জানা সম্ভব না। বাবা সরকারি ব্যাংকে চাকরি সূত্রে থেকেছেন ঢাকায় আর আমরা মায়ের শাসনে বড় হয়েছি কুমিল্লাতে। আর্থিক দিক দিয়ে ছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবা্রে যেমন থাকে তেমন। অভাব বুঝিনি কখনো।

যৌথ পরিবার হওয়ার কারণে কখনই আমার বাবা-মা আমাদের ভাই-বোনদের জন্য আলাদা করে কিছু আয়োজন করতে পারেননি বা করেননি আর আমাদেরকেও শিখিয়েছেন যৌথতার শিক্ষা। আমার মা নিজে খুব বেশি পড়াশোনা না করতে পারলেও চিন্তার দিক থেকে ছিলেন আধুনিক একজন মানুষ।

যাই হোক ছোটবেলা থেকেই আমার মা আমাদের তিন বোনকে যা বলতেন তা ছিলো “আর যাই করো নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখো। নইলে আমার মত স্বামীর মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হবে। আমাদের না হয় সুযোগ ছিলো না, তোমাদের সুযোগ আছে তা কাজে লাগাও।“

আম্মার নিজের অপূর্ণ সাধগুলি আমাদের মাঝে পূরণ করতে চেয়েছিলেন।

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম একটু নিজের মত করে থাকা টাইপের। শুনেছিলাম আমি নাকি ছিলাম এক্সিডেন্টাল সন্তান (মানে ছেলের আশায় আমি হয়েছিলাম)। বাড়তি চাহিদা ছিল না বললেই চলে। কোনদিন বাবা মাকে নিজের কোন কিছুর জন্য জেদ ধরিনি। তাই যা পেতাম তাই নিয়েই শান্ত থাকতাম। পরবর্তীতে ভাইয়ের আদরে বেড়ে উঠা। আমার ভাই ছিলো পড়ুয়া ছেলে, ভালো ছাত্র বলে পরিচিত।

আমিও একসময় ভালো ছাত্র হয়ে উঠতে শুরু করলাম। স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম সারির একজন হয়ে উঠলাম। পড়াশোনা করেছি কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী ফয়জুন্নেসা সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে। এসএসসি এর রেজাল্ট এলো, আমি মেধাতালিকায় এক কোনে স্থান করে নিলাম। বাড়ীতে আমার কদর বেড়ে গেল। পত্রিকায় আমার সাক্ষাতকার বেরুলো, ছবি বেরুলো।

ততদিনে বড় ভাই আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বাম রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে এবং আমি তার একজন অন্ধ অনুসারী হিসাবে তার দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকলাম অল্পতেই। এস এস সি শেষ করার পর ভর্তি হলাম বিখ্যাত ভিকারুন নিসা নুন কলেজে। পরিবারের স্বপ্ন আমি আবার ভালো রেজাল্ট করবো, বড় বড় ডিগ্রি নেবো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো।

কিন্তু ততদিনে আমি ভাইয়ের হাত ধরে পার্টি অফিসে আসা যাওয়া শুরু করলাম লুকিয়ে লুকিয়ে। ওরিয়ানা ফালাসি পড়ে আমার জীবনের লক্ষ্য ছিলো সাংবাদিক হবার। কিসের কি?? আমি তখন মিছিলের একজন সামনের মানুষ হয়ে পড়েছি। এইচএসসি’র রেজাল্ট বেরুলো, আমি ৫ নম্বরের জন্য মেধাতালিকা মিস করলাম।

স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, পার্টি নেতা বললেন, আমাকে অর্থনীতি পড়তে হবে, পার্টির একজন বুদ্ধিজীবী হতে হবে। স্বপ্নের বিষয় জার্নালিজমে পড়ার স্বপ্ন ছেড়ে দিলাম। কিন্তু অর্থনীতি পেলাম না, কারণ আমার একজন আগেই আসন সংখ্যা শেষ। ভাবলাম আচ্ছা দেখি আমার স্বপ্ন পূরণ হয় কিনা। না স্বপ্নের সাবজেক্ট পেলাম না ইংরেজীতে ১ বা ২ মার্কস কম পেয়েছিলাম বলে। বিপ্লবী রাজনীতি করবে যারা, তাদের আবার নির্দিষ্ট সাবজেক্ট কি? একটা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলেই হলো। তাই সামনে যেটা পেলাম সেটাই নিয়ে ভর্তি হলাম। জীবনের একটা স্বপ্ন এখানেই মিস!!।

তবে বিপ্লবের তাড়নায় আমি উজ্জীবিত। পরিবার ততদিনে জেনে গেছে আমি ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে নিজের জীবন ধ্বংসের (তাদের ভাষায়) লাইনে ঢুকে গেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, হলে থাকতে হবে নাইলে জীবনের কিছুই হবে না। বাসায় থাকলে বাবা-মা স্বাধীনভাবে চলতে ফিরতে দিবে না, মিছিল মিটিং এ যাওয়া যাবে না। জোর করে, বাবার রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে হল কর্তৃপক্ষকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে রোকেয়া হলে সিট নিলাম। শুরু হলো আরেক লীনার পথ চলা।

আমি হয়ে উঠলাম মধুর ক্যান্টিনের একজন পরিচিত মুখ। সারাদিন মিছিল মিটিং, পরনে পাঞ্জাবী আর দুই বেণীর লীনাকে সবাই চিনতো মধুর ক্যান্টিনের উচ্চহাসির সেই মানুষ যে মিছিল শ্লোগান ধরে নিয়মিত। গলা উঁচিয়ে বক্তৃতা করে। ক্যাম্পাসের চানাচুরওয়ালা থেকে ভিসি পর্যন্ত তখন আমার পরিচিতি আমার শ্লোগানের জন্য। একধরনের হিরোইজম কাজ করে তখন।

বিপ্লব কালই চলে আসবে এমন এক ভাব আমাদের তখন। ক্লাশে শিক্ষকরা বলতেন, তোমার কি হবে? খালি মিছিল মিটিং করলেই হবে? পাশ করতে হবে না? বন্ধুরা দেখতো একটু অন্যরকম চোখে (অবশ্যই শ্রদ্ধার চোখে)। সবসময় মনে করতো, এই মেয়ে আর দশটা মেয়ের মত নয়। আমাকে ছেলে বন্ধুরা কখনোই মেয়ে বলে গণ্য করতো না। তবে ক্লাশে আমি ইরেগুলার। কখনো যাই, যাই না। প্রাধান্য তখন বিপ্লব। এদিকে আমার বাবা স্বপ্ন দেখছেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে তাঁর মুখ উজ্জ্বল করবো। ধীরে ধীরে তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে শুরু করলো।

একই ঘটনা ঘটেছিলো আমার বড় ভাইয়ের বেলাতেও। বাসা থেকে আমার খোরপোষ বন্ধ হয়ে গেলো। তাতে কি? টিউশনি নিলাম, নিজের চলার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে। ডিপেন্ডেন্ট হওয়া যাবে না। ততদিনে আমি সার্বক্ষণিক বিপ্লবী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। নিজের চালচলন, চিন্তাচেতনা তখন যৌথতার চর্চা গড়ে তোলার চেষ্টা।

জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার মতো আরেকটা ঘটনা ঘটে গেলো আমার মাস্টার্স এ পড়াকালীন। হঠাত করেই ভালো লেগে গেলো আমারই আরেক কমরেডকে। সর্বনাশ!!!! বিপ্লবীদের প্রেম ও বিয়ে একপ্রকার শত্রু বলেই শিক্ষা পেয়েছি। পার্টিতে নেতারা আপসেট, আমাকে দিয়ে আর কিছু হবে না। এক ধরনের অপরাধবোধ আমাদের মনে। মনে হলো আমরা তখন শ্রেণী শত্রু, আমাদের সাথে মিশলেই অন্যদের বিপ্লবী চরিত্রে কালি লেগে যাবে, তাই আমাদের সাথে আর স্বাভাবিকবাবে কেউ কথা বলে না। নিজেদেরকে আবিষ্কার করলাম পার্টি থেকে অনেক দূরের মানুষ হিসাবে।

মনে তখন প্রশ্ন আসলো প্রেম করলেই একজন মানুষ নষ্ট, এটা কেমন ধারণা? প্রেম তো সুন্দর, প্রেম করেও তো বিপ্লব করা যায়। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আমি আর মিছিলের রেগুলার অংশ নাই। স্বাভাবিকভাবে যেসব পরিবর্তন আসার কথা তাই আসতে থাকলো। পড়াশোনা শেষ। কোনরকম সেকেন্ড ক্লাশ নিয়ে পাশ করলাম। বিপ্লবের স্বপ্ন এবং বিপ্লবী লীনার ওখানেই সমাপ্তি।

পার্টির সাথে বিভিন্ন মতপার্থক্যে দূরত্ব বাড়তে থাকলো। বিপ্লব নাই, এখন তো জীবনের প্রয়োজনে চাকরি করতে হবে। কি করবো আমি? কোনদিন বাবা-মার বাধ্য মেয়ে ছিলাম না। বাবা মা বললেন, অনেক করছো এবার আরো পড়াশুনা করো। উচচতর ডিগ্রি নাও, প্রয়োজনে বাইরে চলে যাও।

বিপ্লব মরে গেলেও বিপ্লবী চরিত্র তো মরে যায় নাই। তখন মনে হলো, আবার পড়াশোনা! ধুর এত পড়াশোনা করে কি হবে? কোনরকম একটা চাকরি পেলেই হবে, বিয়ে শাদি করে বাবা-মার নাগাল থেকে বেরিয়ে নিজের মত করে স্বাধীন জীবনযাপন করবো।

বাবা-মা ডেস্ক জব ছাড়া করতে দিবে না, ফিল্ডে যেতে হয় সেরকম চাকরিতে দিবে না, তা নাহলে সেই সময় অনেক বড় বড় এনজিওতে সুযোগ ছিলো কাজ করার। কি আর করা, বাপ-মায়ের এত শর্ত মেনেতো আর কেউ আমাকে আমার পছন্দের কাজ দিবেনা। তাই সামনে যে অফার পেলাম তাতেই ঢুকে গেলাম। বিপ্লবী লীনা ঢুকে গেলো সংসারে,  বিয়ের এক বছরের মাথায় জমজ দুটি ছেলের মা। সেই যে একটা চক্রে আমি ঢুকে গেলাম তার রেশ এখনো টেনে চলেছি আমি। এখন আমি জীবনের ঘানি টানতে টানতে মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। পরিবার সন্তানের জন্য জীবনের সোনালী সময়ে ক্যারিয়ারের দিকে তাকাইনি। তাই যা হতে চেয়েছিলাম বা যা হতে পারতাম সে দিকে মনোযোগ দিতে পারিনি।

জীবনের আজ এই মাঝ প্রান্তে এসে ভাবি, আমি আসোলে কে? কি হতে চেয়েছিলাম? কি হবার কথা ছিলো? কখনো কি পেয়েছি আমার সেই লীনাকে? হতে কি পেরেছি আমার মনের লীনা?তবে হাল ছেড়ে দেইনি। আমি মনে করি জীবনের কোন সময়ই নষ্ট হয়না। সবটা পর্যায়ই কিছু না কিছু শিক্ষা দিয়ে যায়। আমিতো এখনো ফুরিইয়ে যাইনি, তাহলে কেনো এ ভাবনা? শুরু করো লীনা, তোমার তুমি হবার, তোমার লীনা হবার স্বপ্ন পূরনে এগিয়ে যাও। আজ এখুনি, এই মুহূর্তে। জয় হোক সকল স্বপ্ন ভাংগা নারীর।

শেয়ার করুন: