নারীকে যখন মানুষরূপে ভাবি

Draupodi 2রওশন আরা বেগম: নারী কখনো জননী, কখনো কন্যা অথবা স্ত্রী। এই সবই নারীর অবস্থান। এই অবস্থান বেধে নারী এক এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। জননী হিসাবে নারী সন্তান পালনে প্রধান ভুমিকা পালন করলেও ঐ সন্তানের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন অধিকার জননীকে দেওয়া হয় না। পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক অবকাঠামোয় নারীকে নানাভাবেই ছোট করে রাখা হয়েছে। স্ত্রী হিসাবেও নারীর অধিকার অনেক ক্ষেত্রেই রক্ষিত হয় না। শাশুড়ী, জা দেবর, ভাশুর এই সম্পর্কের মধ্যেও নারীর প্রতি একটা পীড়নের আভাস রয়েছে।

এই নারী একেক সময়ে এক এক জায়গায় স্থান পায়। বিয়ের আগে বাবা কিংবা বড় ভাইয়ের অধীনে কন্যার অবস্থান হয়। বিয়ের পর সেই কন্যা স্বামীর প্রত্যক্ষ অধীনে চলে আসে। সেই সাথে স্বামীর পরিবারের বাবা, মা ও ভাই বোনেরও পরোক্ষ অধীনতায় চলে আসে ঐ নারী। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলের সংসারে জায়গা পায়। এই ভাবেই নারী একেক জায়গায় ঘুরতে থাকে। কোনটাই কিন্তু তার নিজের জায়গা নয়। এই সামাজিক কাঠামোয় নারীর কোন স্বাধীন অস্তিত্ব বলে কিছু থাকে না, যা থাকে তাহলো পরনির্ভরতা, বঞ্চনা আর আত্মগ্লানি। সময়ের সাথে সাথে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু নারীর প্রতি নির্যাতন আজও বন্ধ হয়নি। বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি, ছেলের বাড়ি, কিন্তু নিজের বাড়ি আর হয় না।

”নারীর বুকফাটে তো মুখ ফোটে না”  এই কথাটা আমরা নারীর ক্ষেত্রে বলে থাকি। এই কথাটির মধ্যে রয়েছে নারীর প্রকৃত অবস্থা। পরিবারের কন্যা থাকাকালীন মুখ বন্ধ করে রাখার শিক্ষা চলে। প্রতিবাদ নারীর ক্ষেত্রে একেবারেই মানায় না। প্রতিবাদ করলে স্বামীর ঘর হবে না, সংসার হবে না। কন্যা সন্তানের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার হনন করা হয় সেই শিশুকাল থেকেই। তাই নারী থেকে যায় নীরব অব্যক্ত, বুক ফাটা বেদনার নীরব সাক্ষী।

আদম হাওয়া কিসসায় নারীর অবস্থান পরিস্কার উল্লেখ রয়েছে। নারী হাওয়া স্বল্প বুদ্ধি, সহজে প্রলুব্ধা, তাই শয়তানের খপ্পরে পড়ে স্বর্গচ্যুতা হয়। এই কিসসার প্রভাবে আরবে বলা হয় ”নারী জাহান্নামের দ্বার”। গ্রীক সমাজেও নারীকে মানুষ ভাবা হতো না। নারী আর দাসদের মধ্যে আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে নারীকে অনেক নিচে নামিয়ে দিয়েছে। কাবিন হলো নারী ও পুরুষের বৈবাহিক চুক্তির দলিল যা এক ধরনের আর্থিক মূল্যের দলিল বটে। সম্ভোগের দাম স্বরূপ এই কাবিন নামার লক্ষ লক্ষ টাকা দাম ওঠে।

বাংলার নারীরা কাবিননামা যে আত্ম বিক্রয়ের অবমাননাকর দলিলমাত্র, তা আজও মনে করে না। ইসলাম ধর্মানুসারে নারীকে পুরুষ ভোগ্য প্রাণীতে পরিণত করেছে। তাই এক পুরুষের একাধিক স্ত্রী রাখা অনুমোদিত। এটা নারীর জন্য চরম অবমাননাকর। অন্যান্য সকল ধর্মেই নারীকে অনেক নিচে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে নারীর সতীত্ব নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করা হয়েছে।

স্বামী মারা গেলে বিধবা নারীর বাঁচার অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এই সতীদাহ প্রথা ভারতীয় সমাজে বহুদিন যাবত প্রচলন ছিল। রাজা রাম মোহন রায় বৃটিশ সাহায্যে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করে হিন্দু ধর্মের সংস্কার করেন। এখনো বিধবা হলেই সেই নারীকে সাদা কাপড় পরিয়ে নিরামিষ ভোজী রাখার প্রচলন রয়েছে। হিন্দু ধর্মে বিধবা বিয়ে চালু করেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। কিন্তু এখনো বিধবা নারীর উপর নানা যৌন নির্যাতন গোপনে চলে, দুর্ঘটনাক্রমে তা মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়ে যায়।

বাল্য বিয়ে তো সব সমাজেই প্রচলন ছিল, আজো রয়েছে। আট -নয়-বারো বছরের মধ্যে কন্যার বিয়ে না হলে মা বাবার নরক বাস নিশ্চিত তা ধর্মে গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। এই ভাবেই নারীরা যুগে যুগে আসমানী কিতাবের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে পুরুষের কঠিন জালে আবদ্ধ হয়ে নির্যাতিত ও নিঃষ্পেষিত হয়ে চার দেওয়ালে মধ্যে বন্দি হয়েছে। এর থেকে মুক্তি আজও মেলেনি।

সকল আসমানী কিতাবনুসারে ১) নারী পুরুষের চরণাশ্রিতা,২) নারী জমি স্বরূপ আর পুরুষ চাষী স্বরূপ। তাই সেই ফসলের মালিক কৃষক। ৩) নারী স্বামী নিষ্ঠ থাকা আবশ্যিক। এই ভাবেই যুগে যুগে সকল ধর্মই নারীকে পদানত করে অত্যাচারিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দিয়েছে।

সময়ের সাথে সাথে নারী নির্যাতনের ধরন পরিবর্তিত হয়েছে। আজকের নারীরা লেখাপড়ায় অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই লেখাপড়া জানা শিক্ষিত নারীরাও নিজেকে মুক্ত করতে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। স্বামীর ঘরে গিয়ে অতীতের লেখাপড়ার জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দৃষ্টিহীন মূর্খ নারী হিসাবে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়। এই ধরনের নারীর সংখ্যা আমাদের সমাজে অনেক।

ছেলের বউ ডাক্তার, তবে এই ডাক্তারী বিদ্যা কোনদিন মানুষের কাজে লাগেনি। কারণ এই ডাক্তার পদবী পরিবারের সম্মান আভিজাত্য বাড়িয়েছে, কিন্তু মানুষের কোন উপকারে আসেনি। এটাই আমাদের অভিজাত সমাজের নারী শিক্ষা। এর পিছনে দায়ী স্বামী। স্বামী চান না, তাই ঐ নারীর শিক্ষা চার দেওয়ালে বন্দি হয়েছে। আবার বিয়ের পর যে নারীর সাফল্য এসেছে, তা ঐ স্বামীর সাহায্যেই হতে পেরেছে।

বেগম রোকেয়া প্রথমে ভাইদের সাহায্যেই লেখা পড়া শুরু করেছিলেন। পরবর্তিতে স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের সাহায্যেই সমুদ্র পাড়ি দিতে সক্ষম হন। এই ভাবেই নিজের চেষ্টা আর পরিবারের সাহায্যে বেগম রোকেয়া হয়ে ওঠে নারী শিক্ষার আলোকবর্তিকা। কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীর শিক্ষা বন্ধ করে দেয়, চাকরি করতে বাধা দেয়, এই অবস্থায় ঐ নারীর উচিত তার গন্তব্যকে উপেক্ষা না করে বরং স্বামীকে ত্যাগ করা। কিন্তু বাস্তবে অনেক নারী তা করতে ব্যর্থ হয়। নিজের সমস্ত কিছুকে বিসর্জন দিয়ে সংসার-সন্তানের জন্য পড়ে থাকে। এটা নারীর এক ধরনের পরাজয় বটে।

বিয়ে নারীর একমাত্র গন্তব্য নয়। আমাদের সমাজে বিয়েকে নারীর প্রধান গন্তব্য বলে ধরা হয় যা নারী নির্যাতনের অন্যতম প্রধান কারণ। লেখাপড়া জানা অনেক নারী দেখেছি একটা ভাল বিয়ের জন্য বসে থাকে। পড়াশোনার উদ্দেশ্য যেন ভাল পাত্র পাওয়া। এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে নারী বড় ডিগ্রী ধারণ করার চেষ্টা চালায়। আর এটাই হলো নারীর নিজস্ব ব্যর্থতা। এই অবস্থার থেকে নারীকে বেরিয়ে আসতে হবে।

নারীর যোগ্যতা তার নিজস্ব শিক্ষা দীক্ষা আর মননশীলতা। এখনো আমাদের সমাজে দেখেছি যে নারীর বিয়ে হয়নি, তাকে নিন্দা ও কটাক্ষ করা হয় সবার সামনেই। নারী হয়ে আরেক নারীকে এই ভাবে অপদস্থ করে থাকি। শাশুড়ী সারা জীবন এক প্রকার নির্যাতনের মধ্যেই জীবনটা কাটিয়ে দেয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এক সময় এসে সে হয়ে যায় অত্যাচারী নারী, যা সে প্রয়োগ করে আরেক নিরীহ নারীর উপর, যে নারী তারই পুত্র বধূ। এভাবেই যুগের পর যুগ চলতে থাকে অত্যাচারের একটা সার্কেল। মনোতাস্তিক কারণেই হয় তো এই ধারণা নারী মনে একেবারেই বসে গেছে নারী হয়েছি বলেই সকল অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করা যেন সফল নারীর হবার যোগ্যতা। এটা নারীর আরেক ব্যর্থতা। ফলে অত্যাচারিত পুরুষতান্ত্রিকের বিরুদ্ধে সে কখনো দাঁড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করতে পারে না।

বাল্য বিয়ে নারী নির্যাতনের অন্যতম প্রধান কারণ। দরিদ্র পরিবারে এই বাল্যবিয়ে বেশী দেখা যায়। দরিদ্র পিতা কন্যা সন্তানকে আগেই বিদায় করে দারিদ্রতা থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করে থেকে। এতে হিতে বিপরীত হয়ে থাকে। ঐ বাচ্চার না থাকে কোন শিক্ষা-দীক্ষা, না থাকে কোন শারীরিক ক্ষমতা। পরবর্তিতে ঐ বাচ্চা মেয়ে সন্তানসহ স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে আবারও সেই বাবার সংসারে এসে আশ্রয় নেয়। সুতরাং অভাব আসলে বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ হতে পারে না।

যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজে অনেক আগে থেকে প্রচলিত। বিয়ের সময় মেয়ের বাবাকে হবু জামায়ের জন্য নানা উপঢৌকন দেওয়া লাগে। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারে এটিকে যৌতুক না বলে উপঢৌকন বা গিফট বলে চালানো হয়। নিম্নবিত্ত পরিবারে যৌতুক ছাড়া বিয়েই হয় না, অনেক সময় বিয়ে ভেঙ্গেও যায়। অথবা চলে অমানষিক নির্যাতন। অত্যাচার সইতে না পেরে অনেক নারী আত্মহত্যা করে থাকে। নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হলে যৌতুক প্রথা সমাজ থেকে একেবারেই উঠিয়ে দিতে হবে। অথবা এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

শুধুমাত্র রূপ-সৌন্দর্য্য প্রদর্শনের মাধ্যমে একটা অনুগত শ্রেণী বা রূপমুগ্ধ শ্রেণী তৈরী করা নারীর ক্ষমতায়নের ভুল পথ। এই পথের শেষ হয় রূপমুগ্ধদের রূপের উৎস গ্রাসের মাধ্যমে। অর্থাত রূপমুগ্ধরা রূপসীকে খেলার পুতুল বানিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু যে নারী অন্যের চিন্তার উপরে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বহু মত-পথের মানুষের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে সে আসলে কারও পুতুল হয় না। চিন্তার মাধ্যমে সে যে পথের সৃষ্টি করে তার আবেদন কখনও শেষ হয় না। এই কারণে আমারা জিন অস্টিনকে নিয়ে আজো ভাবি। রূপসী অড্রে হেপবার্নকে স্মরণ করি রূপের পাশাপাশি প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার কারণে। বর্তমান সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে মানবিকতার উপর। নারীর উপর হিংস্র রূপ বজায় রেখে কোন সভ্যতা এগিয়ে যেতে পারে না। পশ্চিমা বিশ্বে শিল্পবিপ্লবের পাশাপাশি নারীরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল এবং উৎপাদনের অংশিদারিত্ব নিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি এনেছিল। বাংলাদেশের নারীরা উৎপাদনের অংশিদারিত্ব নিয়েও অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে পারছে না। শিল্প মালিকের শোষণ নীতিতে তারা আজ নিষ্পেষিত। নারী ও পুরুষের মজুরীর বৈষম্য রয়ে গেছে। দরিদ্র দেশগুলোর থেকে প্রতিদিন অস্ংখ্য নারী ও শিশু বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে যৌন দাসী হিসাবে। এই সবই মানবতার অপমান।

মানুষ আস্তে আস্তে অনেক জটিল হয়ে যাচ্ছে। সেই জটিলতা ভেদ করে মানুষের সহজ সরল রূপটি আর দেখতে পাই না। নারীরাও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। নারী তার রূপের বাহারটির বাজনা বাজিয়ে মিথ্যা আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যায়। এটি একটি ব্যর্থতা। তার পরেও সেই মানুষকেই পড়তে চাই। কোনকালে দেখা নারীর অকৃত্রিম সহজ সরল রূপ খুব কাছে টানে। খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে তবুও সেই আশায় কাছে যাই, ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি নিজের কাছে। মনে মনে সান্তনা আসে সেই রূপে আমি নিজেই একা সেজে বসে আছি নিজের মধ্যে।

কাকে খুঁজি, কেন খুঁজি, সেতো আমি নিজেই। আমি সেই নারী যে নারীর মধ্যে আমি দেখতে পাই মুক্তির আকুতি, যে নারীর মধ্যে আমি দেখতে পাই সহজ সরল জীবন বোধ। নারী মুক্তি মানে মানবতার মুক্তি। নারীকে পদদলিত করে মানবতার কোন ডাকই আমার এই কানে আসে না। কারণ আমি নারী। নারী হয়ে আমি সেই নারীকেই খুঁজি যে নারীর নীরব কান্না আমাকে ক্লান্ত করে, আমাকে বাকরুদ্ধ করে, আমার চলার পথকে বন্ধ করে দেয়।

(কৃতজ্ঞতা স্বীকার– আহমদ শরীফ বই ‘স্বনির্বাচিত প্রবন্ধ’)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.