ক্রিকেট হোক নির্মল, বিশুদ্ধ এক প্রতিযোগিতা

BD Cricলীনা পারভিন: বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের পর থেকে আমি ফেসবুকে লগ ইন করিনি, করার মত মানসিক ইচ্ছা ও শক্তি কোনটাই পাইনি। কোন এক জানা-অজানা কষ্টবোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো।

আমি নিশ্চিত যদি রোকেয়া হলে থাকতে এই ঘটনা ঘটতো তাহলে একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে হাউ-মাউ করে কেঁদে কেটে বুকটা হালকা করতে পারতাম, কিন্তু বাসায় তা করার উপায় ছিল না, চোখের কোনে কষ্টের জল শুধু বেয়ে পড়েছে।

বলতে দ্বিধা নেই যে, আমিসহ রোকেয়া হলের আরও কয়েকজন ভারতীয় ক্রিকেট টিমের অন্ধ ভক্ত বলে পরিচিত ছিলাম। আমাদের মধ্যে শাওলী আপা সমাজবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্রী ছিলো, তার বাবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী শহীদুল ইসলাম। ভালো ছাত্রী হিসাবে পরিচিত হলেও তার মধ্যে টিপিক্যাল ভালো ছাত্রী ভাব ছিল না।

ক্লাশ, লাইব্রেরি, পড়ার টেবিলের বাইরে যে কাজটি সে পাগলের মত করতো তা হচ্ছে, শচীনের পোস্টার জমানো, পারলে সে শচীনের পোস্টার দিয়ে জামা বানিয়ে পরতো ব্যাপারটা এমনই ছিলো তাঁর কাছে। তার হলের দেয়াল, ছাদ পুরোটাই ছিলো শচীনের পোস্টারে ঢাকা। আমি,  তানিয়া আপু, শাওলী আপু, নদী আপু, সোনিয়া আপু এবং আরো কয়েকজন পাগলের পাগলামীতে হলে তখন নতুন আসা ডিশে হিন্দি সিনেমার দাপটের জায়গায় স্থান পেলো নিয়মিত খেলার চ্যানেল দেখা।

ব্যাপারটা এমনই ছিল যে, আমরা কেবল খেলার সময়টাতেই টিভি রুমে রেগুলার, বাকি সময় নাই। আমরা কেউ টিভি রুমে যাওয়া মানেই বুঝতো কোন না কোন খেলা আছে বিশেষ করে ভারতের খেলা হলে আমরা মারামারি করে হলেও দেখতাম।

বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজন ঢাকা স্টেডিয়ামে, ভারতীয় টিম খেলবে, শচীনরা আসবে আর আমাদের গ্রুপ যাবে না, সে হবার যো নেই। কষ্ট করে টিকেট যোগাড় করলাম। বাংলাদেশের খেলা দুই-একটা দেখলেও ভারতের খেলা মিস করা যাবে না। টিকেট করা হতো ক্লাব হাউজে, ইন্ডিয়ান ড্রেসিং রুমের পাশেই।

আমি অবশ্য টিকেট কেটে খেলা কমই দেখেছি, চিকন-পাতলা ছিলাম, প্যান্ট আর স্যুয়েটার পরে যেতাম। তীব্রে শীত, কুয়াশায় কিছু দেখা যায় না। আমরা গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম লাইনে। আর আমি বিনা টিকেটে লাইনের ফাঁক-ফোকর খুঁজে, কোন দিন বিএনসিসি’র ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাথা নিচু করে ভিড়ের মধ্যে নিজেকে গলিয়ে দিয়ে দে দৌড়, একবার ভিতরে ঢুকলে আর কে পায়!

এইরকম চুরি করে ভারতের খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। মনে আছে ভারত-পাকিস্তানের খেলায় ভারত প্রথমে হারে হারে অবস্থা, তবে শেষ পর্যন্ত জিতে যায়। হায় আমাদের সবাই গোল করে গলা জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! আমাদের পাশেই লাগোয়া প্যাভিলিয়নে শচীন আর সৌরভ বসে। শচীনের চোখে পানি আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে আছে, আমাদের হাউ মাউ কান্না দেখে ওরা বুঝেছিলো আমরা ওদের ফ্যান। শচীনের কত ছবি, জাদেজা, আজহারসহ প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ছবি তোলার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা। সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিলো শচীনের অটোগ্রাফ।

আমাকে বলা হতো আমি নাকি বাংলাদেশ-ভারত খেলা হলেও ভারতকেই সাপোর্ট করবো। এত কথা বলছি কারণ এইরকম সাপোর্টার ছিলাম ওই টিমের। বাংলাদেশ না থাকলে আমি অবশ্যই ভারতের সাপোর্টার। হারলেও ভারত, জিতলেও ভারত।

সে এক সময় ছিলো যখন শচীন, সৌরভকে দেখার জন্য সবাই পাগল হয়ে যেত। কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আজকের ভারতীয় টিমের কোনো প্লেয়ারকে দেখার জন্য কয়টা জায়গায় ভিড় জমে? কারণ তারা আজকাল খেলোয়াড়ের চেয়েও স্টারডুমে ভোগে। যেদিন থেকে সৌরভ, শচীন ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছে, সেদিন থেকে মনের ভিতরে আর কোন আনন্দ বোধ জাগে না ওই টিমের জয়ে। তাছাড়া এই মুহূর্তে কয়জন খেলোয়াড়কে আমরা চিনি সেটাও একটা প্রশ্ন। সেই আবেগ আর নেই।

এর কারণ হতে পারে আমার নিজের দেশ এখন প্রতিযোগিতায় শক্ত অবস্থানে আসছে, আবার আরেকটা কারণ খেলোয়াড়ের চেয়ে অভিনেতা বেশি এখন ভারতীয় দলে। গতকাল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের খেলাটাই একটা জ্বলন্ত প্রমাণ। শিখর ধাওয়ান যদি একজন প্রকৃত খেলোয়াড় হতেন, তবে তিনি নিজেই সেই সততার প্রমাণ দিতে পারতেন, কিন্তু দেননি।

ক্রিকেট এখন একটি নষ্টদের খেলায় পরিণত হয়েছে। এই নষ্টদের খেলা এখন আর দর্শকদের খেলা নয়। কিছু ক্রিমিনালের খেলা। বাণিজ্যের সহজ উপায়। এখন তাদের আর আমাদের মত ডাই হার্ট দর্শকদের নজর না দিলেও চলবে। এই ধরনের খেলোয়াড় নামে বাজিকরদের আমি ঘৃণা করি।

এমন দিন যেন না আসে যে দিন বিশ্বকাপ হারাবে তার সমস্ত সৌন্দর্য, মর্যাদা, আকর্ষণ, দর্শকচিত্ত।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) এর কাছে আবেদন, আপনারা এভাবে আমাদের নান্দনিক সৌন্দর্যের জায়গাগুলোকে বাণিজ্যের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করবেন না। খেলাকে খেলা হিসাবে রাখুন, শিল্পের জায়গাটুকু নষ্ট করে দিবেন না দয়া করে। আমাদের মত হতভাগ্য দর্শকদের এতটুকু আনন্দের জায়গাটা কেড়ে নিবেন না।

প্রতিযোগিতাকে প্রতিযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখুন। আম্পায়ারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের যে অভিযোগ উঠেছে ক্রিকেট বিশ্বে, তা মোটেও কাম্য নয়। যেমন নয় বাংলাদেশের, তেমনি ক্রিকেটপ্রেমি যে কাররই। খেলায় হারজিৎ থাকেই। আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত জয় আগেও পেয়েছে, কিন্তু খেলে জিতুক, আমরা এটাই চাই।

তবে আশা রাখি, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না। বাংলাদেশ টিমও এবার যে শিক্ষাটা পেয়েছে, তাতে তারা আরও বলীয়ান হয়েই মাঠে নামবে আগামী বিশ্বকাপে। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ বাংলাদেশেই আসবে। কথা দিলাম। জয় বাংলা, জয় ক্রিকেট, জয় টাইগার্স।

 

শেয়ার করুন: