শেখ তাসলিমা মুন:
আমি এখনও ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে নিয়ে লিখিনি। কেন লিখতে পারিনি সে আমি জানি না।
এ এক শূন্যতা। তার সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমার নেই। একটি বৃক্ষ দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা কিছুদিন আগে যশোর রোডের গাছগুলো নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম না? আমার প্রিয়ভাষিণীকে ৭১ এর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক গাছ মনে হতো। আমি নিজে দুর্বল চিত্তের মানুষ না হলেও প্রিয়ভাষিণীর সাথে কোনদিন দেখা করিনি। কপালে সূর্য নিয়ে মানুষটি বসে থাকতেন, আমি দূর থেকে চেয়ে দেখতাম সূর্য নুয়ে আছে, কিন্তু আলো ছড়িয়ে আছে।
একটি ইতিহাস ঝরে পড়লো। আমরা মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত গাছগুলো হারাচ্ছি। প্রিয়ভাষিণী তার ভেতর আলাদা এক অস্তিত্ব।
যাদের আমরা ‘বীরাঙ্গনা’ নাম দিয়েছি। তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা বলার প্রশ্নটি অনেক পরে এসেছে। বলা বাহুল্য তাঁরা নারী। বলা হয় আড়াই লাখ, কিন্তু হিসাব বলে চার লাখ নারীকে সিস্টেমেটিক এবং বীভৎস পৈশাচিকভাবে যৌন নির্যাতন করা হয়। যুদ্ধ শেষে ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেয়ে অনেকে পাগল হয়ে যায়, অনেকে মারা যায়। আর সবাই কোথায়, কে জানে না। খুব অল্প সংখ্যক তাদের কথা আমরা জানি, বলি। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী সেই নারীদের একটি জ্বলন্ত গনগনে মুখ হলেন। বিষয়টি সহজ নয়।
এই মেয়েদের পরিবারের জন্যও সহজ ছিল না। রাতারাতি তাদের বিয়ে দিয়ে দূরদেশ করে দিলেও এ নারীদের ভাগ্য বদলায়নি। সারাটা জীবন তাঁরা বহন করে যাচ্ছে ৭১ এর দুঃসহতা এবং প্রতিদিনের অপমান লাঞ্ছনা। প্রিয়ভাষিণী তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। খুব কম সংখ্যক শুভানুধ্যায়ী ছাড়া তাঁকেও চলতে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে, যুদ্ধ করে। তাকে মোকাবেলা করে শিরদাঁড়া করে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।
প্রিয়ভাষিণীর এবং আমার মায়ের জন্ম একই সালে। আমার মা কাছের প্রিয়জন হারিয়ে নিঃশেষ হয়ে মনে হয় নিজে বেঁচে গিয়েছিলেন।
একজন প্রিয়ভাষিণী সারা বাংলাদেশের মানচিত্র হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তিনি চোখের আড়াল হয়ে গেলেন। আর তাঁকে বসে থাকতে দেখবো না বাংলাদেশের মাটিতে। একটি বটবৃক্ষ হয়ে।
তবুও আমরা অনেকটা তাঁর অংশ হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁকে দেখলে মনে করতে পারতাম কতটা ভয়ঙ্কর ছিল পাকিস্তানি জান্তা! পাকিস্তানি শকুনেরা! কতটা দাম দিয়েছিলাম আমরা এ দেশটি অর্জনের জন্য। কতটা মুল্য দিতে হয়েছে একটি দেশের মানুষকে তাদের বাঙালি স্বত্বার জন্য।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী সে মূল্যের জননী হয়ে বসে থেকেছেন আমাদের সামনে। জায়গাটা এখন শূন্য হয়ে আছে। বাংলাদেশ শূন্য হয়ে আসছে। চেতনায়। আদর্শে। স্বজনে।