ধর্ম আর শোষণ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের মূলমন্ত্র

কাকলী তালুকদার: আপনি কাকে ভালবাসবেন? যে আপনাকে যত্ন করে, তাঁকে? নাকি যে আপনাকে অযত্ন করে, তাঁকে? আমরা কোনোদিন বলতে পারবো না, যে আমাকে অযত্ন করে তাকে আমি সম্মান করি অথবা ভালবাসি!
শোষণ, বঞ্চনা কোন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ ভালবাসতে পারে না।
যে পরিবারে শুধুমাত্র কন্যা সন্তানের ভ্রুন বলে মায়ের পেটের ভিতরেই সেই ভ্রুনকে হত্যা করা হয়, সেই পরিবারকে একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী কেন সম্মান করবে?

Relighion 1শুধুমাত্র মেয়ে সন্তান বলে খাওয়া-পরা, সম্পত্তি, সকল অধিকার ভাগাভাগিতে মেয়েটি বঞ্চিত! সেই মেয়ে কেন পরিবারকে সম্মান করতে শিখবে? প্রতিটি একক মানুষ যে নারীর গর্ভে জন্ম নেয় সেই নারীকে অপমান, নির্যাতন, অবজ্ঞা, অত্যাচার, বঞ্চিত করে রাখতে যে সমাজটি গড়ে উঠে, সেই সমাজকে একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী কেন সম্মান করবে?

যে ধর্ম পৃথিবীর দুইটি মাত্র জাতি নারী এবং পুরুষকে সমান চোখে সামাজিক অধিকার বণ্টন করে দিতে পারে না সেই ধর্মকে নারী কেন সম্মান করবে? যে সংস্কৃতি শুধুমাত্র নারী বলে মানুষের মধ্যে বিভেদের জন্ম দেয়, সেই সংস্কৃতিকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন নারী কেন ধারণ করবে? আজ সকল ক্ষেত্রে বিভিন্ন দোহাই এর অজুহাতে নারীকে রুদ্ধ করে রাখার যে সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতি কারা তৈরি করেছে?

নারীর সতীত্ব বনাম বেশ্যা রূপে কারা দাঁড় করাচ্ছে? যারা নারীর সতীত্বের সার্টিফিকেট নিয়ে চিন্তিত তারা তো নিজেদেরকেই সবচেয়ে বেশি অপমান করছে। একজন নারী কি পুরুষ ছাড়া বেশ্যা হতে পারে কোনদিন?
আমাদের সমাজে প্রতিটি মেয়েকে একটি ছেলের চেয়ে দ্বিগুণ সংগ্রাম করতে হয়। আজকে যে নারীদের নিজের অধিকার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শোনা যায় তার পিছনের পথ কাঁটা বিছানো।

Religious edu 1সেই কাঁটাগুলো কে বিছিয়ে রাখে জানেন? কোন মায়েরই সন্তান, আর সেই সন্তানটি মানুষ হয়ে উঠার আগে পুরুষ হয়ে উঠে। তারপর একসময় তার মায়ের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে শুরু করে। নিজেকে ‘শক্তির প্রতীক’ মনে করে শাসক হয়ে উঠে।
যে মেয়েটি বাবার সুযোগ্য সন্তান হিসেবে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হলো বিয়ের পর স্বামী দ্বারা নির্যাতিত, অবহেলিত, অবজ্ঞার পাত্র। কারণ সেই স্বামী নামক পুরুষটি নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়তে পারেনি। সে বড় হয়েছে পুরুষতন্ত্রের ছায়াতলে। সেই বাবা-ই আবার সন্তানের জন্য তখন কষ্ট পায়। পুরুষতন্ত্র বিষয়টি পুরুষের জন্যও যন্ত্রণার হয়ে উঠে একসময়।

যেমন অনেক নারীও নারীদের পথের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই সকল পুতুল নারীমূর্তি পুরুষতন্ত্রের তৈরি গুটি। এর মূল কারণ একটি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে আমরা বেড়ে উঠি সবসময়। সেই দৃষ্টি আমাদেরকে অভ্যস্ত করে তোলে তাই নারী হয়েও নারীর মর্যাদাহীন জীবনকে আমরা বুঝতে পারি না।

আমাদের বেশীরভাগ জীবনসঙ্গী প্রকৃত জীবনসঙ্গী হয়ে উঠতে পারে না। স্বামী শব্দটির মতো তারা প্রভু হয়ে থাকতেই ভালবাসে। তা মেয়েটি বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক বা প্রশাসনের যত বড় কর্মকর্তাই হউক না কেন!

এই যে অধস্তনতা, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন নারী কেন ভালবাসবে? পরিবারটি যদি পারস্পরিক সম্মানবোধের না হয়, সেই পরিবার প্রথা কেন একজন নারী টিকিয়ে রাখতে যাবে?

ধর্মে নারী-পুরুষের বিভেদ হচ্ছে নারীর পথের বড় বাধা। ধর্মকে যারা শাসন করছে, তাঁরা একেকজন শোষক। যেখানে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ স্পষ্ট সেই ধর্মের প্রতি  আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীর কেন সম্মান থাকবে?
নারীকে ধর্মের দোহাই দিয়ে, পরিবারের দোহাই দিয়ে বন্দী জীবনে বাধ্য করছে কারা? কারা শিখাচ্ছে নারীকে, সতীত্ব, বেশ্যা, ধর্ষিতা শব্দ?

Hindusপ্রতিটি শব্দ নারীর সাথে যোগ হয় পুরুষের কারণে। নারীকে ব্যক্তিগত ভোগের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করতেই এই সকল শব্দ পুরুষগণ সৃষ্টি করেছে। আমরা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীগণ একটু একটু করে নারীর উপর থেকে শব্দের কাঁটাগুলো সরাতে পুরুষ তান্ত্রিক শব্দের সংস্কার করার চেষ্টা করি। ধর্ষিতাকে ধর্ষণের শিকার বলে সম্মান দেয়ার চেষ্টা করি। আমাদের সেই চেষ্টাকে প্রতিনিয়ত ধূলিস্যাৎ করতে লোকের অভাব হয় না।

মিডিয়া এখন দুই ভাগে বিভক্ত অমাবস্যা-পূর্ণিমার মতো। তাই বাবুল আক্তারের মতো সৎ পুলিশ অফিসারের জীবনও পুরুষতন্ত্রের চাবুকের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। আমরা মানবিক হলে অনেক কিছু ভাবতাম, দুইটি শিশুর কথা একজন সৎ অফিসারের কথা, তনুর কথা, প্রতিদিন খুন হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কথা, মা-মেয়ের ধর্ষণের কথা, দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া মানুষের কথা, পাহাড়ের মানুষগুলোর কথা।

ধর্মের নামে প্রতিদিন খুন, লুট হচ্ছে বিধর্মীদের বাড়ি-ঘর সম্পদ। ধর্ম আর শোষণ হচ্ছে পুরষতন্ত্রের মূলমন্ত্র। ধর্মের শাসকগণ তাই বৈধতা দিয়ে দেয় রাষ্ট্র ধর্মকে। বিভেদের ধর্ম কোনদিন পথিকৃতের জন্ম দিতে পারবে না। শাসকের জন্ম চলছে পুরুষতান্ত্রিক ধর্মের ছায়াতলে। সমাজ আজ শাসকদের হাতের মুঠোয়, এখানে মানুষের মুক্তি নেই।

২৮ জুন ১৬

শেয়ার করুন: