আমার নাম শাকিলা খাতুন । আমার বয়স ৩০ বছর। আমি নিজেকে একজন কৃষক হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কৃষিআবাদ সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে আমার ঝটপট উত্তর আমাকে সবার কাছেই প্রিয় করে তুলেছে। আমার বাড়ি যশোর সদরের লেবুতলায়। আমার স্বামীর নাম আব্দুল হাই মুক্তি। স্বামীই পরিবারের প্রধান দায়িত্ব পালন করেন, কৃষি আবাদ আমাদের আয়ের প্রধান উৎস যেখান থেকে বছরে ৭০/৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত উপার্জন হয়।
৮ শতক বসতভিটা এবং আড়াই বিঘা কৃষি জমির মালিকানা আমার স্বামীর হলেও আমাদের দু’জনের মিলিত সিদ্ধান্তেই সম¯ত কাজকর্ম আমারা করে থাকি। নিজের জমি ছাড়াও অন্যেও জমি বর্গা নিয়েও আমারা চাষাবাদ করছি। স্বামী- স্ত্রী মিলে ধান, পাট, করলা, কপি,পটল, মুশুরি, সরিষা ইত্যাদি ফসলের আবাদ করি। আমি বাড়ির আঙিনায় পুঁইশাক, সিম, বরবটি, লাউসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করি যেখান থেকে খাওয়া সহ বিক্রি করে মাসে প্রায় হাজার টাকা উপার্জন হয়। এছাড়া আমি হাঁস, মুরগী, গরু পালন করে ডিম ও দুধ বিক্রয় করি এবং বাড়ির একপাশে একটি পুকুর রয়েছে সেখানে মাছও চাষ করি। আগাছা পরিষ্কার, জমি নিড়ানো, সার, পানি, কীটনাশক প্রদান, বীজ ধুয়ে শুকিয়ে প্লাস্টিক পাত্রে সংরক্ষণসহ সব কাজগুলোই আমি করে থাকি। বীজ সংরক্ষণে পোকা দমনের জন্য আমি বীজের পাত্রে নিমের পাতা দিয়ে রাখি। এছাড়া অন্যের জমিতেও আমি মাঝে মধ্যে টমেটো, কপি, কলাই, মরিচ ও ঘাস তোলার কাজ করে থাকি।
কৃষক হওয়া সত্ত্বেও সমাজে কেউ আমাকে নারী কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। নারী হয়ে কৃষি কাজের সর্বত্র আমার অবাধ যাতায়াতের জন্য আমি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমালোচনার সম্মুখীনও হই, তারপরও আমি এগুলোকে অতিক্রম করেই কাজ করে যাচ্ছি। অন্যের জমিতে ফসল তোলার ক্ষেত্রে নারী কৃষক হওয়ার কারণে আমি মজুরি পাই ১৫০ টাকা যেখানে পুরুষ কৃষক পায় ২০০ টাকা। কখনও কখনও আমি ১০০ বা ১৩০ টাকা মজুরিও পাই। প্রতিবেশীদের কটু মন্তব্যের কারণে আমি কৃষিপণ্য নিয়ে নিজে বাজারে যাই না, আমার স্বামী নিয়ে যায় । অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাপারিরা বাড়িতে এসে কিনে নিয়ে যায় । বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে যাওয়ার কারণে ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায় না। আমি কৃষি কাজে ্ট্রাক্টর, লাঙ্গল ব্যবহার করি, কেমিক্যাল সার ছাড়াও গোবর সার ব্যবহার করে থাকি। কৃষিপণ্য বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই কৃষি আবাদের খরচ (বীজ, সার, খৈল, কীটনাশক, পানি, ট্রাক্টর ভাড়া, দিন মজুর) বহন করি। আমি বেসরকারি সংস্থা উলাসী সৃজনী সংঘ থেকে বহুমুখী ফসল চাষ এবং ঢাকা আহছানিয়া মিশন থেকে গরু পালন, গো-খাদ্যের ধরণ, গরুর বিভিন্ন জাত বিষয়ক প্রশিক্ষণ পেয়েছি। উপ-সহকারী কৃষি অফিসার ও অন্য কৃষকদের নিকট থেকে পরামর্শ নিয়ে আমি আমার কৃষি কার্যক্রম পরিচালনা করি। আমি ব্র্যাক থেকে ৪০,০০০ টাকা ঋণ নিয়ে সে একটি গাভী কিনেছি। কৃষিকাজে পরিবারের সকলেই আমাকে সহায়তা করে। পরিবারের খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, পশুপালনসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় খরচই আমাদের এই কৃষি উপার্জন থেকে ব্যয় করা হয়। দিনের চার ঘন্টা সময় আমি কৃষি কাজে ব্যয় করে, অবসর পেলে আমি কাঁথা সেলাই করতে বসে যাই। নারী হিসাবে কৃষি কাজে নিজের ভূমিকার প্রশ্নে ছোটবেলা থেকেই আমার ভাবনা “আমার ভাই যদি পারে তবে আমিও নিশ্চয় পারি।” আমাকে দেখে এ পর্যšত আরো ৬ জন নারী কৃষি কাজে যুক্ত হয়েছে।
কৃষিকে ঘিরে আমার ভবিষ্যত ভাবনা হলো, ঘর পাকা করে ঘরের আঙিনায় টমেটো চাষ, সফেদা, কামরাঙা, জলপাই, পেয়ারা, আমগাছ লাগাবো।