আমি পূর্ণিমা রায় ।
আমার বাবা ছিলেন মৎস্য জীবি, সাত ভাই বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। ১৪ বছর বয়সে মৎস্যজীবি পরিবারে আমার বিবাহ হয়। আমার স্বামীর পরিবারে অভাব অনাটন ছিল নিয়মিত। কখনও শুধুমাত্র ভাত খেয়ে আবার কখনও কিছু না খেয়ে থাকা। সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই ভিটাটুকু ছাড়া। এক সময় চিন্তা করতাম বাড়ির পাশে পতিত জমিতে কিছু শাক এবং ঘরের চালে পুঁইশাক লাগানো যায় কিনা। এই ভাবনা থেকেই শিম, লাউ প্রভৃতি বাড়ির পাশে ফসল আবাদ শুরু করলাম। সেখানে যা উৎপাদন হত তাতে সংসারের বেশ কিছুটা চাহিদা মিটতো। এর পরে ঘরের পাশে ১কাঠা পতিত জমিতে সবজি আবাদ শুরু করলাম। কিন্তু অল্প জমি হওয়ায় সবজির আবাদ খুব বেশি লাভজনক হচ্ছিল না, তাই তখন চাষাবাদের জন্য আরও জমির ব্যবস্থা করতে এলাকার মহাজনদের সাথে যোগাযোগ করি। অনেক চেষ্টার পর পরের বছর আরও ৫কাঠা জমি লিজ নিলাম। এভাবে বাড়াতে থাকে আবাদের পরিমাণ। আমার কৃষি বিষয়ক জ্ঞান কম থাকার কারণে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছিল না। প্রতিবেশী কৃষকদের কাছে তখন জানতে পারলাম কৃষি জমিতে সার দিতে হবে। কিন্তু সে বছর সারের খুব অভাব ছিল, তাছাড়া নারীকৃষক হিসেবে বাজার থেকে সার ক্রয় করা আমার জন্য সহজ ছিল না। চাহিদার তুলনায় বাজারে সারের সরবরাহ কম থাকার কারণে বাজারে যে অল্প পরিমাণ সার পাওয়া যেত, তা অধিকাংশ সময় পুরুষ কৃষকরাই ক্রয় করতো। তাই অনেক সময় আমাকে বাজারে সার কিনতে গিয়ে খালি হাতে ফেরত আসতে হতো । তাছাড়া আমার কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে আমি জৈবসার কীভাবে তৈরি করতে হয় তা জানতাম না। বাজারে সার আনতে যাওয়ার পথে একদিও দেখি পাশের গ্রামের সমীর কি যেন করছেন। কাছে গিয়ে দেখলাম বেশকিছু কেঁচো নিয়ে সে নাড়াচাড়া করছে। পাশে একটা চাড়িতে চা পাতার মত কিছু একটা দেখতে পেলাম। তখন তাকে জিগ্যেস করে জানতে পারলাম কেঁচো দিয়ে সার তৈরি হয় এবং ৫ টাকা কেজিতে তা বিক্রয় করা হয়। রাসায়নিক সারের বদলে এটা দিলে উৎপাদন বেশি হয়। জমিও ভাল থাকে। তখনই বাড়ি ফিরে ছেলের সাথে পরামর্শ করলাম বাড়ির পাশের কিছু জমি থেকে কেঁচো তুলবো। কিন্তু জানতে পারলাম এই কেঁচো দিয়ে কাজ হবে না। কেঁচো কিনে সার বানাতে হবে। তখন ছুটে গেলাম সমীরের কাছে। কিন্তু কিছুতেই সে আমাকে এই পদ্ধতি শেখাতে রাজি হলো না। তখন আমি অন্যান্য কৃষকদের সাথে যোগাযোগ করলাম, কিন্তু নারী কৃষক হওয়ায় কেউ আমাকে মূল্যায়ন করতো না এবং আমাকে পরামর্শ দিতো না। তখন একটা জেদ চেপে বসল। ইতিমধ্যে পরিচয় হলো কৃষক নেতা এবং গাইদঘাট কৃষি ক্লাবের সভাপতি আইযুব হোসেনের সাথে। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন ওই এলাকার ব্লক সুপারভাইজারের সাথে। ব্লক সুপাভাইজার এ বিষয়ে কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিলেন। এখন আমি একজন সফল কেঁচো সার উৎপাদনকারী। সার উৎপাদন করতে যেয়ে বুঝলাম জৈব সার কতটা উপকারী। আমি চিন্তা করলাম আশেপাশে যে সকল নারীরা থাকেন তাদেরকে এটা শেখাবো।
এক এক করে অনেককে সংগঠিত করলাম এবং কৃষি বিভাগ থেকে সকলের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলাম। এরপর নিজেরা একটি সংগঠন তৈরি করলাম। সদস্য সংখ্যা হলো ৬৫ জন। আমার সংগঠনের সদস্যবৃন্দ বাড়ি বাড়ি যেয়ে কৃষকদেরকে রাসায়নিক সারের ক্ষতি এবং জৈব সারের উপকারীতা বোঝান এবং জমিতে জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহিত করে। এক সময় ছাপড়া ঘর ছিল আমার, এখন আধাপাকা টিনের বাড়ি। যে সার উৎপাদন হয় সেটা দিয়ে বছরে ৬০-৭০ হাজার টাকা আয় হয়। বাড়ীর পাশে সবজি হতেও ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় হয়। বর্তমানে কিছুটা হলেও স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছি। মৎস্যজীবি স্বামীর আয়ের উপর এখন আর শুধু নির্ভর করতে হয় না। প্রতি মাসে সদস্যদের সাথে মিটিং করি কিভাবে পতিত জমিতে সবজি উৎপাদন করে সংসারের আয় বাড়াতে হবে, কিভাবে সাবলম্বী হতে হবে। এখন আমি স্বপ্ন দেখি সমিতি রেজিট্্েরশন হয়েছে এবং নারী কৃষকেরা সমাজে ও পরিবারে মর্যাদা পাচ্ছে।