
সুপ্রীতি ধর: “খেলা শেষে গা-ধাক্কা মারা, তেড়ে আসা, এর পর পুলিশের সহায়তায় সিএনজিতে ওঠার পর সিএনজির উপর পাথরসদৃশ বস্তু ছুঁড়ে মারা – এইগুলো কি লাঞ্ছনার মধ্যে পড়ে না? (পরে পুলিশের এডিসি কথাগুলো কনফার্ম করেছে-ও)। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম ফ্যান সুধীর গৌতম আহত হয়নি, মানে তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, সুতরাং তার উপর হামলে পড়াটা জায়েজ হয়ে গেলো?”
কাল রাতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির একটি রিপোর্ট দেখছিলাম সুধীরকে নিয়ে। এটা কোন ধরনের সাংবাদিকতা, আমার জানা নেই। রিপোর্টার যেভাবে ধমকের সুরে বার বার একই প্রশ্ন করে নাজেহাল করে উত্তর বের করে নিয়ে আসছিল, সেটাও তো একধরনের নির্যাতনের মধ্যেই পড়ে। তার ওপর ভুলভাল ইংরেজিতে তাকে জিজ্ঞাসা করছিল রিপোর্টার। একপর্যায়ে হিন্দিতে প্রশ্ন করে। কিন্তু প্রশ্নের বিষয়বস্তু একটাই ছিল, শরীরে কোনো আঘাত লেগেছে কিনা! এ দিয়ে কী হাসিল করতে চাইছে মিডিয়া, তা আমার বোঝারও অতীত। আমার নিজের দেশের দর্শকদের আচরণকে জায়েজ করে আর পক্ষান্তরে ভারতীয় মিডিয়ার সমালোচনা করে লাভ কী হচ্ছে! আমরা কি শুধরাচ্ছি এর মধ্য দিয়ে?
সুধীরকে নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া বাড়াবাড়ি করছে বলে অভিযোগ করছে সবাই, হতেই পারে। ধরেই নিলাম বাড়াবাড়ি করছে। তাই বলে আমরাও তো পাল্লা দিয়ে সেই পথেই হাঁটছি। ‘তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইবো না কেন’ -এই তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমরাও তো তাহলে ওই অধমের খাতায়ই নাম লেখাচ্ছি।
আমি কখনই স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাই না এই ভিড়ের কারণে। আমার মানুষজন দেখলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি পহেলা বৈশাখ বা একুশে ফেব্রুয়ারিতেও যাই না। কারণ আমার ধারণা আছে এই ভিড় সম্পর্কে, মেয়ে বলে তো আরও অনেক ধারণাই আছে। আমাদের চরিত্র তো ফুলের মতোন পবিত্র, তা ভিড়ে যেমন টের পাওয়া যায়, তেমনি অনলাইনের ভাষাতেও।
বিডিনিউজের রিপোর্টার যতোই সাফাই গাক না কেন, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করবো না যে, ওইসময় ওই ভিড়ের মধ্যে বাংলাদেশি সমর্থকরা কেবল ‘মওকা’ ‘মওকা’ আর ‘ভুয়া’ ‘ভুয়া’ বলেই ক্ষান্ত ছিল! এমন একজন নিরলস, একনিষ্ঠ ভারতীয় দর্শককে সামনে পেয়ে বাংলাদেশি সমর্থকরা জয়ের আনন্দে আর কিছুই বলেনি, সেটা হতেই পারে না।
সুধীর নিজেও বলেছেন, তিনি একটি দোকানে যখন যান, তখন সেই দোকানি ঝাঁপ ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওটা কি বাংলাদেশি সমর্থকদের ভালবাসা আগলে রাখতে? আর পুলিশকেই বা কেন সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হলো সিএনজিতে উঠানোর জন্য? পুলিশ এতো ভাল দায়িত্ব কবে থেকে পালন করা শুরু করলো?
যে পুলিশের কয়েক গজ দূরত্বে ড. অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়, সেই হত্যাকাণ্ডের পরও যে পুলিশ এগিয়ে আসে না, এতো এতো নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেও পহেলা বৈশাখে যে নিপীড়নের ঘটনা ঘটে, সেখানে পুলিশের কী ভূমিকা ছিল আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। তারা তো সিসিটিভির ক্যামেরাতেও কোনো নির্যাতন-নিপীড়নের আলামতই পায়নি। যদিও পরবর্তীতে তারা অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করে। কাজেই পুলিশের এমন বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে বৈকি! তাছাড়া টিভি রিপোর্ট অনুযায়ী পুলিশের বক্তব্য ভাল করে শুনলেও ‘কিছু যে একটা হয়েছে’ তা স্পষ্টই বোঝা যায়।
কথা হচ্ছিল, ‘লাঞ্ছনা’ শব্দটির মানে নিয়ে। কালই ভেবেছিলাম এ নিয়ে একটা পোস্ট দিই, সকালে দেখলাম সিনিয়র সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর এরই মধ্যে প্রশ্নটি তুলেছেন। ধন্যবাদ তাকে। কেবল শরীরে আঘাত করলেই ‘অ্যাটাক’ হয়? লাঞ্ছনা হয়? বাংলাদেশে টিভি চ্যানেলগুলো সব উঠেপড়ে লেগেছে সুধীরকে শারীরিক আঘাত করা হয়নি, এটা জায়েজ করতে। তিনি যে বলছেন, তাকে ধাক্কা দিয়েছে লোকজন, এটা কি আক্রমণের মধ্যে পড়ে না?
বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে, কথা বলে, টিকা-টিপ্পইন কেটে মানসিক যে নিপীড়ন তাকে করা হয়েছে, তা কিন্তু উহ্য থেকে যাচ্ছে তাদের রিপোর্টে বা বক্তব্যে, এমনও বলতে পারি, তাদের বোধশক্তিতে।
এটা অনেকটা ধর্ষণ কেসের মতোন, ফরেনসিক রিপোর্টে প্রমাণ হবে মেয়েটা ধর্ষণের শিকার হয়েছে কিনা! মেয়েটা যে বলছে, তাতে কিছুই এসে যাচ্ছে না কারও! পুরুষতান্ত্রিকতা আসলে সবার মনের মধ্যে, সব কাজে, সব পদক্ষেপে।
আরেকটা বিষয় না বললেই না। আমি এই ঘটনা নিয়ে কিছুই লিখিনি বলতে গেলে, শুধু বলেছি, নিজেকে সংযত করতে, অন্যকে আঘাত না করেও যে বিজয় উৎসব পালন করা যায়, সেই কথা মনে করিয়ে দিয়েছি। তাতেই আমি সাম্প্রদায়িক হয়ে গেলাম? এটা কি আমার নামের পিছনে ‘রহমান’ না থেকে ‘ধর’ থাকার কারণে? সৌরদীপ দাশগুপ্তকেও ভারতের দালাল বলে ছাড়লো অনলাইনের লোকজন। একই তো কারণ, নাকি? সত্যি কথা, ন্যায়ের কথা বললেই হয় ভারতের দালাল, নয়তো সাম্প্রদায়িক আখ্যা পেতে হয়। বিশ্বকাপের সময়ও আমাকে ভারতের দালাল বলে আমার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল মিডিয়ায় বেশ আলোচিত একটি চরিত্র।
এই দেশে অধিকাংশ মুসলিম এটাই বোঝে না, তাদের কোন কথায় বা কোন আচরণে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত বোধ করে, লাঞ্ছিত বোধ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘরবাড়িতে হামলা না চালিয়ে বা সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়েদের ধর্ষণ না করেও যে তাদের লাঞ্ছিত করা যায়, তাদের ওপর নির্যাতন করা যায়, এটা বোঝে না এইদেশীয় নব্য ‘লেখক’ ‘বুদ্ধিজীবীরাও’। তারা তাদের লেখায় যেভাবে একটা পরাজিত টিমকে নাস্তানুবুদ করছে, এতে তাদের পারিবারিক শিক্ষাটাই প্রকাশ পাচ্ছে।
ভারতীয় ক্রিকেটার বা মিডিয়া যাই করুক না কেন, আমাদের কেন তাদের সাথে পাল্লা দিতে হবে! আমাদের অ-খেলোয়াড়সুলভ আচরণগুলো, আমাদের অশিক্ষা-সংস্কৃতিহীনতার বিষয়গুলো কেন আমরা ঢেকে রাখতে চাইছি! আমরা কি জানি না আমাদের দুর্বল জায়গাগুলো?
এটা একদিকে যেমন হাস্যকর, তেমনি দু:খজনকও। আমার দেশ আজ ভালো করেছে, বলবো অসম্ভব ভালো করেছে, আরও ভালো করবে ভবিষ্যতে, করতেই থাকবে। এটাই তো আমাদের চাওয়া। তাই নয় কী? তাহলে আমরা কেন বিনয়ী হবো না, কেন আমরা আজ আমাদের কৃত অপরাধটাকে লঘু করে দেখানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছি কাজে ও কথায়?
আমাদের পরাজিত হওয়ার কষ্ট জানা আছে সবার, হতাশায় ডুবে যাওয়ার অভ্যেস আমাদের স্বভাবজাত, তাহলে কেন আজ এই আস্ফালন আমাদের?
সুধীর, আমি ঠিক জানি না আপনার সাথে আসলেই কী ঘটেছে! যাই ঘটুক, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আর আপনিও দেখবেন, আপনাকে নিয়ে কেউ যেন ব্যবসা না করতে পারে, দাবার ঘুঁটি না বানাতে পারে! আপনি বরারের মতোই আসবেন বাংলাদেশে।