নিষিদ্ধপল্লীর পৃথক কোনো ভাষা আছে কি?

Parliament_innerলাভলী ইয়াসমিন জেবা: আমাদের দেশে ‘নিষিদ্ধপল্লী’ নামে কোন পল্লী আছে কী? তার আবার নিজস্ব কোন ভাষা? তবে নিশ্চয়ই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশের কোথাও না কোথাও আছে! নয়তো লোকের মুখে প্রায়ই এই পল্লীর নাম শোনা যেতো না। বিশেষ করে সরকার দলীয় হুইপ আ স ম ফিরোজ যখন সংসদের অধিবেশনেই দায়িত্ব নিয়ে কথাটি বলেছেন, তবে তো আমাদের বিশ্বাস করতেই হয় যে, আমাদের দেশে ‘নিষিদ্ধপল্লী’ বলে কোনো স্থান বা এলাকা আছে। হ্যাঁ তবে এর আগেও যে আমি এই শব্দটি শুনিনি তা কিন্তু নয়। লোকমুখে শুনে যতোটুকু বুঝতে পেরেছি তা হলো, যৌনকর্মীরা যেখানে অবস্থান করেন সেটাই কারো কারো মতে ‘নিষিদ্ধপল্লী’ এবং ওখানে অবস্থানরত সবাই বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন, তা হোক সে আঞ্চলিক, চলিত বা সাধু ভাষা। কিন্তু প্রশ্ন হলো ঐ ‘নিষিদ্ধপল্লী’তে যারা যাতায়াত করেন তাদেরকে কি এই সমাজ ‘নিষিদ্ধ মানুষ’ বলে আখ্যায়িত করেছে?

এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার পর গত ৯ জুন জাতির আশা পূর্ণ করতে জাতীয় সংসদে অবশেষে উপস্থিত হয়েছিলেন বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। জাতীয় সংসদে সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনার প্রথম দিনে বিরোধী দলের উপস্থিতি ছিল সত্যিই সরব। তবে এ থেকে জাতি কী পেলো সেটাই ভেবে দেখার বিষয়। বিশেষ করে সংসদ সদস্য সৈয়দা আসিফা আশরাফী ও রেহেনা আক্তার রানু আলোচনার সময় যে ধরনের অশালীন ও অশোভনীয় শব্দ, বাক্য ব্যবহার করেছেন তা শুধু দুঃখজনক নয় অমার্জনীয়। জাতীয় দৈনিকে পরদিন তা ফলাও করে ছাপা হয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকা আবার ঐসব বাক্য নিয়ে হেডিংও করেছে। তবে বাদ যায়নি হুইপ আ স ম ফিরোজের বক্তব্যটিও। তিনি বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের ভাষাকে ‘নিষিদ্ধপল্লীর ভাষা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। যদিও রেহেনা আক্তার স্পষ্টত বলেছেন, ‘আমি আমার ফেনীর ভাষায় বলতে চাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়া কোন চুদুর বুদুর চইলত ন’। বাক্যটি লিখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তবুও তথ্য প্রকাশের জন্য লিখতে হলো।

অনেকে আবার তার ভাষাকে ছোটলোকের ভাষা, বস্তির ভাষা বলেও ধিক্কার দিচ্ছেন। নিঃসন্দেহে কেউ ফেনীকে ইঙ্গিত করছেন না, আঙুল তুলেছেন বস্তি আর নিষিদ্ধপল্লীর দিকে; যেখানে সমাজের অবহেলিত, অধিকারবঞ্চিত, লাঞ্ছিত মানুষগুলো বাস করে। যাদের শিক্ষা-দীক্ষা নেই, সভ্যতা, ভাষা, সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা নেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্রসমাজের মানুষেরা যখন কখনো সখনো কুরুচিপূর্ণ, অশালীন শব্দ বাক্য ব্যবহার করে ফেলেন তার দায়ও কিন্তু ঐ নিরীহ অসহায় মানুষদের উপরে গিয়েই বর্তায়। কোনো অপরাধ না করেও গালি খায় আর ভদ্রসমাজের কুকর্মের উদাহরণ হিসেবে পরিণত হয়।

আমাদের রাজনীতিকদের এহেন আচরণ তো নতুন কিছু নয়। এরশাদ সরকারের মন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম সাহেবের কুখ্যাত ‘জিরো থিয়োরি’ দেশবাসী নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রীর ঐক্যবদ্ধ অবস্থানকে কটাক্ষ করে তিনি বলেছিলেন (০+০ = ০) অর্থাৎ (শূন্য + শূন্য) = যেমন শূন্য হয় তেমনি দুই নারীর মিলনে কিছুই উৎপাদিত হয় না। এই বলে তিনি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতাকে অবজ্ঞা ও অপমান করেছিলেন। কিন্তু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে দুই নেত্রী তাদের রাজনৈতিক যোগ্যতা ও ক্ষমতা প্রমাণ করেছিলেন। দেশে উৎপাদিত হয়েছিল গণতান্ত্রিক সরকার।

দুই নেত্রীর সৌন্দর্য, ফ্যাশন সচেতনতা নিয়েও সংসদে অশোভন আলোচনা, সমালোচনা কম হয়নি। একবার সংসদ চলাকালীন অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের এক সাংসদ খালেদা জিয়ার সৌন্দর্য সচেতনতাকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন যে, তিনি নাকি প্রতিদিন ডাবের পানি দিয়ে মুখমণ্ডল পরিষ্কার করেন। এর জবাবে বিএনপির এক সংসদ সদস্য শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘আপনাদের নেত্রীর জন্য আমরা ডাবের পানির পুকুর বানিয়ে দেবো। সেই পুকুরে প্রতিদিন গোসল করেও তিনি আমাদের নেত্রীর মত ফর্সা হতে পারবেন কি?’ এই উদাহরণগুলো উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে, আমি রেহেনা আক্তার বা এমনতর অন্য কারো পক্ষ নিচ্ছি। আমি শুধু বলতে চাইছি যে, এই হচ্ছে আমাদের সংসদীয় সংস্কৃতি শিক্ষার ধারাবাহিকতা।

২০১২ সালের ১৮ মার্চ রাষ্ট্রপতির ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনার এক পর্যায়ে এই সাংসদ রানু বলেছিলেন, ‘মঈন, ফখরুলের কোলে বসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন। থু থু থু থুথু তারা, শেখ হাসিনা মার্কা মারা।’ তখন সরকারি দলের এমপি ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী আঙুল তোলে তাকে চুপ করতে বললে বিরোধী দলের সংসদ সদস্য পাপিয়া এবং শাম্মী তার দিকে তেড়ে যান এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।

পরবর্তীতে একই অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, এ রকম ভাষা নিষিদ্ধপল্লীতেও ব্যবহার হয় না। আবারো আঘাত করা হলো সমাজের সেই নিপীড়িত, নির্যাতিত অসহায় নারীদের। একেই বলে, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় আর উলু খাগড়াদের জীবন যায়’। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন অর্জনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে এ দেশের নারী আন্দোলন নেত্রীরা সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন, আসন সংখ্যা বৃদ্ধি, সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন, মন্ত্রিপরিষদসহ গুরুত্বপূর্ণ আসন ও সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটিতে নারী আসন বৃদ্ধি, নারী উন্নয়ন নীতি সবই নারী নেত্রীদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল। আর যারা এই ফসল ঘরে তুলেছেন, যাদের কর্তব্য মৌলিক অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে সমাজের পিছিয়েপড়া নারীদের হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাওয়ার কথা, তাদের এরূপ আচরণ দেখে লজ্জায় মাথা নত করেন সমগ্র নারী সমাজ। প্রশ্নবিদ্ধ হয় নারী অধিকার আন্দোলনের প্রচেষ্টা।

২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারী সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী ‘সংসদ সদস্য আচরণবিধি’ নামে একটি বিল মহান সংসদে উত্থাপন করেন। কিন্তু বিরোধী দল ও সরকারি দলের কতিপয় সাংসদের প্রতিবাদের কারণে বিষয়টি সেখানেই থেমে যায়। এই হচ্ছে আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চা। যদি বিলটিতে সবাই সম্মতি জানাতেন এবং সংসদে তা পাস হতো তাহলে হয়তো আজকে সাংসদদের মুখে এমন কুরুচিপূর্ণ শব্দ, বাক্য আবার শুনতে হতো না। যে মহান সংসদে দেশের উন্নয়নের জন্য, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইন প্রণয়ন হওয়ার কথা, সেই সংসদের অধিবেশনগুলো হবে দেশের মানুষের প্রাণকেন্দ্র। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিতও হয়ে থাকে। অথচ আমাদের দেশের মানুষ তা দেখার বদলে ভারতীয় সিরিয়াল দেখার প্রতিই বেশি আকর্ষণ বোধ করে। আজকের শিশু-কিশোররা সংসদ এবং সাংসদ সম্পর্কে ভালো করে জানে না। কিছুটা জানলে ও তা মোটেও ইতিবাচক নয়Ñ সন্ত্রাস, রাহাজানি, প্রবঞ্চনা, অনিশ্চয়তা, অধিকারহীনতা ইত্যাদির সঙ্গে রাজনীতি এবং নেতৃত্ব নোংরাভাবে জড়িয়ে গেছে বলে অভিভাবকরা সন্তানকে নিয়ে আর দেশ গড়ার হাতিয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখেন না। তৈরি করেন অর্থ কামানোর কারিগর। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত একটি স্বাধীন জাতির জন্য এরচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে!

লাভলী ইয়াসমিন জেবা : জেন্ডার বিশেষজ্ঞ।
(সূত্র: ভোরের কাগজ, ১২ জুন ২০১৩)

শেয়ার করুন: