নিমফুল

Neem flowerলুতফুন নাহার লতা: নিমফুলের গন্ধমাখা আমার শৈশব, আমার কিশোরী বেলা, আমারই চরণ চিহ্নের দিকে চায় ! জানি আমি জানি সেকথা । জানি সে তো আজকে নয় সে যে আছে আমার সকল সুক্ষ্ম স্মৃতির ডোরে বাঁধা !

সেই ছোটবেলা থেকে প্রায় প্রতিদিনের মত সবার আগে ঘুম ভেঙ্গে উঠে আমি বসে আছি আমাদের খুলনার বাড়ীর পশ্চিমের বারান্দায় হাতলওয়ালা বড় চেয়ারটায়। সুনসান সকাল । বাড়ীর সবাই তখনো ঘুম । রোজ মা সবার আগে উঠে অজু করে নামাজ পড়ে দৌড়ে যান রান্না ঘরে, চুলায় গরম ভাত বসিয়ে দিয়ে এসে বসেন কোরান শরিফ পড়তে ! কিন্তু আজকাল বেশীর ভাগ দিনেই আমি উঠে যাই মা ওঠারো আগে। আজো তেমনি আমার ঘুমের রেণু মাখা চোখ চেয়ে আছে পশ্চিমের বড় ঘরের চালার উপরে এলিয়ে শুয়ে থাকা প্রিয়তম মায়া বৃক্ষের দিকে।আমার প্রিয় নিমগাছ ।

আমাদের একতলা বাড়ীর পূবের আকাশ লাল করে সূর্য উঠেছে, এই সকালের নরম আলো এসে পড়েছে পশ্চিমে দোলায়মান নিম গাছের সারা শরীর জুড়ে ! সেই বাতাসে কী যে শিহরন তুলে যাচ্ছে ! যেন আমার সমস্ত পরান ছুঁয়ে কুলু কুলু বয়ে চলেছে চির প্রেমময় ,অন্তরঙ্গ রুপসা ! আমার আপন নদী ।

কানে ভেসে আসছে সকাল বেলার সুর ! খুব ভোর বেলা উঠে পাশের বাড়ীর জর্জ দা’র বোন বেলা দি গাইছে ‘ উঠাতা বাজা, মুরালি আজা বৃন্দাবন কুঞ্জ মে, ফুলানা সব খিলাতা যাতা ঘরকি হরকি উঠাতা গাতা ,লাগাতা মাধুরা সুপ্রভাতা গুনিয়ানকি গুঞ্জ মে —উঠাতা বাজা ।

সকালের এই হৃদয় নিংড়ানো সুর, সবুজাভ আলোর ছটা , ঝিরি ঝিরি স্বপ্ন মাখা নিমগাছের চিরল চিরল পাতার মায়ামাখা আহ্বান, নিমফুলের মৌ মৌ গন্ধ, সবুজ টিয়ের রাঙা ঠোঁটে লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে সবুজ আঙ্গুরের মত পাকা পাকা নিমফল খাওয়া ! এসব আমায় ওম ওম ভালোলাগায় জড়িয়ে ধরে ! আমি আচ্ছন্ন !আমি ভাবে বিভোল ! আমি তখন ষোলো , আমার অঙ্গে অঙ্গে গুলমোহোরের ফুল ! আমি তখন অকারনে দুঃখ বিলাসি, আমি তখন লুকিয়ে কাঁদি আমার নিম গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে !

সেবার খুব বৃষ্টি ! সেই বৃষ্টিতে পশ্চিমের ঘরের চালার খুব ক্ষতি হল ! এপাশে বিন্ডিং এ আমরা তা টের পাই না তেমন , নিমের পাতা , ফুল, ফল পড়ে পড়ে চালের ছাউনির যে ক্ষতি হচ্ছে তা মা খুব বুঝলেন । লোক ডেকে ঠিক করতে চাইলেন ঘর কিন্তু নিমগাছের জন্য তা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলে, মনের ভেতর অনেক কষ্ট চেপেও সাতশো টাকার বিনিময়ে মা গাছ কাটতে নির্দেশ দিলেন । সেদিনের সকাল অন্যরকম সকাল আমার !

সেদিন বেশ বেলা বেড়েছে , আমি তখনো ঘুম । অনেক রাত জেগে পড়েছি বলে কেউ ডাকেনি আমায় সেদিন। কত বেলা হয়েছে ! রোদে ভরে গেছে আমাদের বাড়ী । ঘুমের গহীনে কোন কাঠুরিয়া আমার হৃৎপিণ্ডে তার কুড়াল চালিয়ে কেটে নিচ্ছে আমার ভালোবাসার ডালপালা ! এক লাফে বিছানা ছেড়ে ছুটে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি বড় বড় নিমের ডাল পড়ে সবুজ হয়ে গেছে আমাদের উঠোন । সেই ডালের উপর আনন্দের তুফান তুলে ঝাঁপাচ্ছে আমার ছোট বোন মিতু , ছোট্ট দুই ভাই, মনি আর মিলটন ! তখন মাত্র কিছুদিন আগে আমরা আমাদের বাবাকে হারিয়েছি !

উঠোনের এক কোনে আছড়ে পড়ে আর্তনাদ করে উঠলাম ! আমি দম ফাটিয়ে চিৎকার করছি ‘ মা ! মা! মাগো ! এ কি করলে ! এ কি করলে তুমি মা !’ কিছুক্ষণের জন্যে সবাই ভাবল আমাকে সাপে কেটেছে ! কেবল আমার মা বুঝলেন ! মুখে আঁচল চেপে চিৎকার করে ডাকলেন ওদের ‘ কেটো না ! কেটো না ! বন্ধ কর ! আমার মেয়ে কাঁদছে !’ বড় বড় ডালগুলো তখনো উঠোনে পড়ে কাতর চোখে চেয়ে রইল গাছের দিকে ।

বাড়ী সেদিন কেমন থম থম করছে ! আমরা কেউ কথা বলছি না । মা আশ্চর্য রকম নিস্তব্ধতায় ডুবে গেলেন ! সেদিন তিনি নামাজ পড়লেন না, স্নান, আহার, ঘরের কাজ কিছুই সারলেন না, এক বিপ্রতীপ স্রোতে ভাসিয়ে দিলেন নিজেকে, অসময়ে মা ঘুমিয়ে রইলেন !

ঘনায়মান সন্ধ্যা অন্ধকারে আমি একাকী গিয়ে দাঁড়ালাম ওর পাশে । আস্তে আস্তে আমার দক্ষিণ হাত রাখলাম ওর কাঁধে ! দুচোখ ভেসে চলেছে পদ্মায় গঙ্গায় একাকার ! ফিসফিসিয়ে বললাম ওর কানে কানে ‘ আমি ভালোবাসি ! অনেক ভালোবাসিরে তোকে !’

আমি বসে আছি ব্যাংকে, আমার দাদা’র ডেস্কের সামনে ! আমার হাতে টাকা তোলার ভাউচার ! আমার দাদার হাতে অপূর্ব সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ! ব্যাংকে জমা আছে আমার স্কলারশিপের তিন হাজার টাকা !

বাড়ী ফিরে মাকে বলেছিলাম ‘ মা আমি চিরদিন আছি তোমার পাশে ! তুমি ভয় পেও না মা ! তুমি আর আমি মিলে একদিন সবকিছু গুছিয়ে তুলব ‘ মা কাঁদছেন !ব্যাংকের নতুন টাকার উপরে মার চোখের জল পাকা টসটসে নিমফলের মত ঝরে পড়ছে টপ-টপ !!!

 

শেয়ার করুন: