লিটন ভৌমিক: সন্তান যদি পুরুষ জন্ম দিতো তাহলে কি হতো?
– আমি নিশ্চিত… জন্মের সাথে সাথে পুরুষ আছাড় দিয়ে মেরে ফেলতো। তারপর একটি গোল্ডলিফ ধরিয়ে সুখটান দিতো।
১০ মাস ১০ দিন কষ্ট করার পর পুরুষ এই কাজটি নিশ্চিত করতো।
মানবদেহের সবার পরিচিত বড়ব্যথাটি হল- দাঁতের ব্যথা। সন্তান জন্ম দেয়ার ব্যথাটি এর ১২০ গুন বেশি!
পেইন মেজারিং স্কেলে গর্ভধারন সবচে ভয়ংকর পেইন। একজন মানুষ ৪৫ ডেল ব্যথা সহ্য করতে পারে। গর্ভধারনের পেইন ৫৭ ডেলও ছাড়িয়ে যায়। মানবদেহে ২০টি হাড়ভাঙলে যে কষ্ট, গর্ভধারনের কষ্টটিও একই।
VAS method হল ০-১০ পেইন মেজার।
সকল ব্যথা ৭ পর্যন্ত। একমাত্র অসহ্য ব্যথা ‘গর্ভধারন’ উঠে ১০ এ। ৭ থেকে ১০ তিনবেশি নয়; এটা জ্যামিতিক হারে বাড়ে।
১০ মাস ১০ দিনের রুটিনটি যেন- অবিরাম গোঙ্গানীর শব্দ; চোখের পাতা, জিভ, হাতের তালু ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া; নির্মম কষ্টের রাত জাগা; বিছানার এপাশ ওপাশ গড়াগড়ির শব্দ; বেদনার আকুতি; ঘামে ভেজা মুখ; প্রায়শ দাঁতের মাড়ি, গোড়ালি, হাত, মুখ ফুলে যাওয়া।
শেষের দিকে বাচ্চার লাথি, হাত-পা ছোড়াছুড়ি; শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-ত্রন্ত্রে অবিরাম তীব্র বেদনা। মাঝরাতে বাচ্চার গতিবিধিতে আর্তচিৎকার; ১০ ঘন্টা ঘুম দরকার হলেও, ২ ঘণ্টাও ঘুমানো সম্ভব নয়। শরীরে খিঁচুনি হলে অজ্ঞান, সংজ্ঞাশুন্য। মাঝে মাঝে বাচ্চার অস্বাভাবিক অবস্থান; অসহনীয় কষ্ট।
মা বলেই সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিতে পারেন।
এরপর একসময় প্রসব… রক্তে ভাসা শরীর; মৃত্যুর ভয়ে ভীত চোখ, অসহ্য বেদনায় হাত ছোঁড়াছুঁড়ি, প্রকট ব্যথা, যেন দেহ থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সমস্ত অঙ্গতন্ত্র; একটি নতুন প্রাণের বৃহৎ আশা নিয়ে পৃথিবীর সবচে নির্মম ব্যথায় ডুবে থাকা। মৃত্যু থেকে কয়েক সেকেন্ড দূরে, মুমূর্ষু হয়ে একটি জীবিত, সুস্থ প্রাণের প্রার্থনা।
… এরপর নতুন প্রাণের আগমনের খবর উদ্বেলিত, শিহরিত, মুখরিত করে তোলে মায়ের জীবন। কয়েক মিনিট আগের অমানবিক কষ্টে বিপর্যস্ত মানুষটিও নবজাতককে জড়িয়ে ধরেন হাসিমুখে। সমস্ত কষ্ট তুল্য, তুচ্ছ, নগণ্য মনে হয় তার কাছে।
এই জীবনের সেরা কষ্টটি নারী জীবনের সেরা প্রাপ্তি।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠশিল্পী কারিগর একজন মা; একজন ইঞ্জিনিয়ার ডিজাইন করেন, একজন আর্টিস্ট ছবি বানান, গায়ক গানের জন্ম দেন… একজন মা একটি নতুন জীবনের সূচনা করেন।
এরপর আবার যুদ্ধ। এরপর সন্তানটিকে বড় করা। তখন দশমাসের কষ্ট কোন ব্যাপার না। সন্তান জন্ম দেওয়ার চেয়ে আরো কষ্ট পরে তাকে বড় করা। নিরবিচ্ছিন্ন যত্ন; তারপর আমৃত্যু সেই সন্তানদের মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকা।
চাইনিজ একটি প্রবাদ আছে- ‘স্রষ্টার পক্ষে সবার খোঁজ-খবর নেয়া সম্ভব নয়। তাই সৃষ্টি করলেন মাকে’।।
… … যেকোন পুরুষের নারীর এই কষ্টটির প্রতি ধারনা থাকা দরকার; মাতৃত্বের বিশালতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার। নারীর ব্যক্তিগত পছন্দে আমি নেই বলে, সে পাষাণী-হৃদয়হীনা-ছলনাময়ী; সঙ্গী পছন্দ করেছে বলে সে নষ্টা; টিকে থাকার জন্য নির্মম পেশাকে নিতে বাধ্য হয়েছে বলে, সে পতিতা, বেশ্যা। নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক এই শব্দভাণ্ডার তবেই কমবে।
মা দিবসে শুধু নিজ মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নয়; সকল নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হোক।।