কজন নারীর সাহস আছে এমন জবরদস্ত দেওয়াল ভেঙে ফেলার!

সালমা লুনা:

প্রায়ই ফেসবুকে কিছু লেখা খুব ছড়ায়, যেমন ৪০ এ নারী ৫০ এ নারী। তারা এই বয়সে কী করবে, কীভাবে চলবে, কেমন করে সব বাধা পেরিয়ে জীবনকে উপভোগ করবে ইত্যাদি।
লেখাগুলো ভালোই লাগে। কিন্তু বাধাগুলো আসলে কেমন আর সেই আপাত নিরীহ বাধাগুলো, দুচারটে বাক্যের নিরীহ তীর কোথায় কীভাবে বিঁধে কতটা যন্ত্রণা দেয় রক্ত ঝরায় – কোন ৫৫/৬৫ বছর বয়সী নারী আর সেসব মুক্তকণ্ঠে বলে।
মানুষের জীবনের পড়ন্ত বেলা হচ্ছে ৫০,৫৫,৬০,৬৫। এই বয়সীদের জীবন আসলে কেমন কেউ কি কারো জীবন যাপন করে দেখেছে। দেখলে মনে হয় একরকম মুক্ত স্বাধীন। কিন্তু নারী কি আদৌ স্বাধীন হয়?

স্বামীর উপস্থিতিতে নিজের সংসার, সময় কাটানোর মত উপলক্ষ বা কিছু কর্তব্য থাকলেও। অনুপস্থিতিতে সেই সংসারটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভেঙে যায়। নিজের বলে আর কিছুই থাকে না। সন্তানদের মানুষ করা তো শেষই বরং সন্তানদের সন্তানরাও তখন বড় হয়ে যায়।
এই সময়ে নারী তখন সন্তানের লায়াবিলিটি। দায় বললেই ভালো শোনায়।
অসুখ বিসুখ কিছু থাকেই শরীরে।
ছেলেমেয়েরা পালা করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। একাধিক সন্তান হলে পালাক্রমে তাদের বাসায় ঘুরেফিরে থাকা।
প্রবাসী সন্তানদের মায়েদের আবার এই সুবিধে নেই। তারা বেতনভুক্ত কর্মচারী কাজের লোক রাঁধুনিদের দয়ায় দিন গুজরান করে। নিতান্তই অসুখ বিসুখ হলে নিকট আত্মীয়রা দয়া করে এসে বিধিব্যবস্থা নেন। একাকীত্ব তাদের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণার নাম। তীর্থের কাকের মত পথ চেয়ে বসে থাকেন এই বুঝি কেউ এলো। ক্যালেন্ডারের পাতায় সন্তানের দেশে আসার তারিখ খোঁজেন।

আর বেশির ভাগ মা আছেন যারা শারীরিকভাবে ততটা অক্ষম নন। সন্তানের বাসায় মোটামুটি গৃহিনী না হলেও সামান্য কিছুটা কর্তৃত্ব করেন। তারা পুত্র পুত্রবধূ কিংবা কন্যা জামাতা এবং নাতিনাতনিদের জন্য রান্না করেন। পুত্র ভালোবাসে ছোট মাছ, অথচ ছোট বেলায় মেরেধরেও খাওয়ানো যেত না। আজ পরিণত বয়সে মায়ের হাতের ছোট মাছের চচ্চড়িটা ভালোবেসে খায় বলে মা নিজ হাতে রাঁধেন। কিন্তু সেটা করলেই তো হচ্ছে না। বউমা খাবে সর্ষে ইলিশ। আর নাতনিটা তো চিকেনের ঝোল পাতে নেবেই না। ডায়েট করে। তাকে কম তেল মশলায় গ্রিল করে দিতে গিয়ে হয়তো ইউটিউব দেখে এই বয়সে শিখে নিয়েছেন গ্রিল, বাটার চিকেন, এয়ার ফ্রাই।
ছেলে অফিসে খাবার নিলে তার সহকর্মীদের জন্যও প্রায়ই খাবার প্যাক করতে হয়। কারণ ছেলে চায় তার মায়ের চমৎকার রান্নার স্বাদ বন্ধুরা চেখে দেখুক। মেয়ের জামাই শুটকি খেলে নাতি হয়তো চিকেন বা চিংড়ি। মেয়ের আবার মায়ের হাতের শিং মাছের ঝোল পছন্দ।
এসব করতে গিয়ে নিজের পছন্দ বলে আর কিছু কি থাকে? সে অবশ্য যৌবনকালেও ছিলো না। তখনও অন্যের পছন্দেই মেন্যু তৈরি হতো।

তবে হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে সন্তানরা মাকে নিয়ে এদিক-ওদিক আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে যান। দুএকবার থাইল্যান্ড, ভুটান। বছরে একবার কক্সবাজার, নামী রিসোর্টও ঘোরা হয় বৈকি! সন্তানরা বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে তাদের এবং তাদের সঙ্গীসঙ্গীনি কিংবা সন্তানদের পছন্দের রেস্টুরেন্টে গেলে মাকেও টেনে নিয়ে যায়।
কারো কারো আবার প্রবাসী সন্তানের বাচ্চা প্রসব উপলক্ষে ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়াও দেখা হয়ে যায়। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ছ’মাস-ন’মাস থাকতেও হয় বিদেশ বিভূঁইয়ে।
এই বয়সে নারীদের কোন প্রাইভেসি থাকতে নেই৷ এমনটাই ভাবে বাঙালি। সন্তানের বাড়িতে তার হয়তো আলাদা একটা কামরা আছে যেখানে আছে নাতিনাতনির পড়ার টেবিল বা খেলনা দোলনা। কিংবা ছোট নাতি-নাতনীদের সাথেই শোবার ব্যবস্থা।

এখন তবে হিসেব হোক, স্বাধীনতা তাদের কতটুকু?
স্বাধীনতা বলতে একটা নিজের বাসা,নিজের ঘর, নিজের জন্য রাধাবাড়া, ইচ্ছে হলো আজ রাধলামই না। নিজের পছন্দের জায়গায় বেড়ানো। শরীরটা ভালো নেই, বা আজ শুধু ভর্তা ভাত খেয়ে সারাটাদিন গড়াগড়ি করে বেশ কাটিয়ে দিলেন – এটা কতটা সম্ভব!
সেই যে সারাটা জীবন নিজের সংসার জীবনে শ্বশুর শ্বাশুড়ি ননদ দেবর ভাশুর সন্তান স্বামী তাদের জন্য যা করেছেন, তাদের ইচ্ছায় যেমন চলেছেন। আজ জীবনের এই পড়ন্ত বেলায়ও সেই একই কাজ অনিচ্ছা হলেও করতেই হচ্ছে।
এই বয়সের কোন নারী পুরুষ বন্ধু দূরে থাক,যদি সমবয়সী কিংবা অসমবয়সী নারীদের সঙ্গেও দেশে কিংবা বিদেশে ঘুরতে যেতে চান নিজের ইচ্ছানুযায়ী কী হতে পারে বলে মনে করেন! ঘন ঘন ছোটবেলার বন্ধুর বাড়ি গেলেন কিংবা বন্ধুরাই দল বেঁধে এলো। অথবা নদীর ধারে কাশবনে, কী কোন কফিশপে মাসে দুচারবার বসা হয়েই গেল।

প্রথম বাধাটা কোথা থেকে আসে জানেন? নিজের কন্যাটির কাছ থেকে। মা ঘুরে বেড়ালে, রঙিন শাড়ি পরলে, মাথায় আঁচল কিংবা হিজাব না দিলে, গাঢ় লিপস্টিক দিলে,টিপ পরলে, গলায় মালা, চুলে দুটো ফুল গুঁজলে, ফেসবুকে ঘন ঘন ছবি দিলে কন্যার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে কন্যার মুখ দেখানো দায় হয়ে যায়।
ছেলের বউটিও কী কম! ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে, ছেলেকে টিপ্পনি কাটে। তারও বাপের বাড়িতে শ্বশুর কুলের সম্মানের গায়ে কীভাবে যেন কাদার ছিঁটে লেগেই যায়।
এইসব দুর্ভেদ্য দেওয়াল নারীর চারপাশে ক্রমশ উঁচু থেকে উঁচু হয়ে বয়সী নারীটিকে আরো হতাশ , আরো একটু অথর্ব আর অসুস্থ করে তোলে।

কজন নারীর সাহস আছে এমন জবরদস্ত দেওয়াল ভেঙে ফেলার!
বরং এই দেয়ালের সামনে মাথা কুটে মরতে মরতে ৫০ থেকে ৬৫ পার হয়ে একসময় এক বুকভর্তি অপূর্ণ সব ইচ্ছা নিয়ে নারীটি ইহধাম ত্যাগ করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেন।

কী হয় যদি মেয়েটি মাকে রান্নার কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বরং মায়ের পছন্দের একটা খাবার প্রতিদিন না হোক অন্তত ছুটির দিনে রান্না করে পাশে বসে হাসিগল্পে খেয়ে উঠলে। ছেলের বউও করতে পারে। নাতি-নাতনিও পারে।
মেয়েটি বা পুত্রবধূ একটা শাড়ির সাথে ম্যাচিং গলার মালা কিনে পরিয়ে দেয় মায়ের বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবার সময়। চাচি ফুপু খালারা যদি মায়ের সমালোচনা করেই ফেলে মেয়েটির সামনে। মেয়েটির কেন একবার মনে পড়ে না তার কিশোরী বেলায়, তারুণ্যের সময়ে স্কার্ট পরলে, চুল খোলা রাখলে, ছাদে গিয়ে বিকেলে একটু দাঁড়ালে, বান্ধবীর বাড়ি গিয়ে ফিরতে দেরি হলে যখন সবাই চোখ রাঙাত তখন মা কেমন ঢাল হয়ে দাঁড়াতো তার সামনে।

কেন ছেলেটির মনে হয় না, বন্ধুদের মায়ের হাতের রান্না খাইয়ে তার যে তৃপ্তি হয় তাতে মায়ের পায়ের ব্যথাটা যে আরেকটু বাড়ে, কোমরে জোর টান পড়ে। রাতে ভালো ঘুম হয়না। সন্তানদের জন্য রান্না করা, পছন্দের খাবার বানিয়ে খাওয়ানো তাদের দায়িত্ব, তাদের মায়ের নয়। তাদের হাত ধরে স্কুলে নিয়ে গিয়েছেন মা, টিফিন বানিয়ে দিয়ে বাবার খাবার রেডি করে স্কুলে দিয়ে এসে দুপুরের রান্না করে ফের স্কুল থেকে এনেছেন মা৷ বিকেলে কোচিংএ দৌড়েছেন মা। ছবি আঁকতে সাঁতার শিখতে নাচের ক্লাসে পৌছে দিয়ে বসে থেকে নিয়ে এসেছেন মা। বাসায় মেহমান আত্মীয় স্বজনের আগমনে আপ্যায়নে ব্যতিব্যস্ত হয়েছেন মা’ই।
পরীক্ষার আগে তাদের পাশাপাশি রাত জেগেছেন মা। দোয়ার জায়নামাজেও মাই বসেছেন। লেখাপড়া প্রেম বিরহ বন্ধুবান্ধবদের অত্যাচার সবই মা সহ্য করে করেই তাদের এই পর্যন্ত হাত ধরে নিয়ে এসেছেন এই মা।

এতটা পথ অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে মায়ের যখন এখন ছুটি কাটাবার সময় হলো তখন আমরা সন্তানরা তাদেরকে আবার শেকল পরাতে চাই। তাদেরকে নিয়মে বেঁধে রাখতে চাই। তাকে আঘাত করি। তাদের কাঁধে স্বার্থপরের মতো নিজের সংসারের জোয়ালটা চাপিয়ে দিয়ে ভাবি একটু নড়াচড়া করা ভালো। এতে মায়েরই স্বার্থ, এটুকু না করলে মা অসুস্থ হয়ে যাবে।
শুধু মা নিজে কী চান, মায়ের মন কীসে ভালো থাকবে সেই খোঁজ আমরা ক’জন নেই!

শেয়ার করুন: