আলফা আরজু:
সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনগতভাবে বিবাহ বিচ্ছেদে কোনো বাধা আছে? নাহ, নেই। এই বিচ্ছেদ বিবাহের একদিন বা এক যুগ পরও হতে পারে। কোনো সমস্যা আছে? নাহ, তাও নাই !
কিন্তু কোথায় সমস্যা আছে? – এই বৈবাহিক প্রক্রিয়া একটা “দালিলিক, সামাজিক ও ধর্মীয় পদ্ধতিতে” সম্পন্ন হয়। তাই এখানে কিছু নিয়ম কানুন থাকে (যদি ভুল না জেনে থাকি!)। সেইসব না মেনে বিবাহ যেমন সম্পন্ন হয় না, তেমনি বিচ্ছেদও হয় না।
এবার আসি যেই কোনো বন্ধনের “মানবিক ও মূল্যবোধের” জায়গায়। আপনি স্বামী বা স্ত্রী- আপনার সঙ্গীর মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক সকল বিষয়ে দুইজন মানুষ একে অপরকে- সহযোগিতা-সহমর্মিতা-প্রেম-ভালোবাসা আদান প্রদান করার কথা (কেও কেও শুধুই “ইয়ে’ করতে বিয়ে করতে পারেন – সেই বিষয় বিবেচ্য নয়)।
আপনার ও সঙ্গীর বিশ্বাসের জায়গায়। একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করবেন – এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু “বালখিল্ল্যা” আছেন – যারা রাত-দিন মিথ্যে বলেন। সকল প্রকার বিষয়ে মিথ্যের আশ্রয় নেন ও সত্য গোপন করেন। তখন অন্য সঙ্গীর জন্য এই বিশ্বাসের জায়গা খুবই “ভঙ্গুর” থাকে ! ঠিক কোনটা বিশ্বাস করবেন আর কোনটা করবেন না- এই বুঝতে কুলকিনারা করতে পারেন না।
তবে “অবিশ্বাসী”কে বিশ্বাস না করাই মনে হয় – সহজ রাস্তা। না হলে ‘তাহাকে বিশ্বাস করিবার বৃথা চেষ্টা করিয়া’ – নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে নিজের মনো-জগতে সুনামী তোলার কোন মানে হয় না।
Maya Angelou (আমেরিকান কবি, গবেষক, মানবাধিকার কর্মী, অধ্যাপক ও জীবনের তাগিদে বিভিন্ন সময় নানাবিধ পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন) কোন এক জায়গায় বলেছিলেন/লিখেছিলেন, “accept them – what they’re! what they showed you!” এটা কিছুটা “বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর” এর মতো।
একজন অবিশ্বাসী, মিথ্যে বলে যাচ্ছে, ভুলের নামে অপরাধ ও প্রতারণা করে যাচ্ছে, আর আপনি তার সেইসব বিশ্বাস না করে তাকে শুধরানোর চেষ্টা করছেন (শাবানা সেজে) ও নিজের মানসিক যন্ত্রণা বাড়াচ্ছেন।
সেটা বাদ দিয়ে বরং সঙ্গী যদি অবিশ্বাসী হয়, মিথ্যুক হয়, প্রতারক হয়, অমানবিক হয়, তার সেইসব “নেতিবাচক” আচরণ ও মানসিকতাকে বিশ্বাস করুন বা accept করুন। তাহলে বাকি পথ পাড়ি দেওয়াটা আপনার জন্য সহজ হবে!
ধরেন আপনি জানলেন যে আপনার সঙ্গীর একাধিক সম্পর্ক আছে। এটাই বিশ্বাস করেন। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, “আপনি জীবন দিয়ে ভালোবাসলে সে তার এইরকম ব্যাভিচার বাদ দিবে।” আপনার আবেগ, প্রেম, ভালোবাসা ও শ্রম-সময় কোনো কিছুই সেই ব্যাভিচার সঙ্গীকে ফেরাতে পারবে না। তাই, সঙ্গীর ব্যাভিচার স্বভাবকে মেনে নিন। তার ব্যাভিচার সহ্য করেও যদি তার সাথে থাকতে হয় – সঙ্গীর এই স্বভাব জেনেই থাকুন। সে ভালো হয়ে যাবে বা অন্য কিছু মাথায় নিবেন না।
আর যদি, এমন ব্যাভিচার সঙ্গীর সাথে একই ঘরে থাকতে পারবেন না। তাহলে বেরিয়ে আসুন।
এই বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াটা কঠিন আমাদের দেশের জন্য। কারণ আপনি যখনই এই বিষয় নিয়ে পরিবারের কারোর সাথে বা বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, সেইদিন থেকে আপনি একটা মহাসমুদ্রে পড়বেন। কারণ যাদের কাছে বলবেন – সবার আলাদা মতামত থাকবে ও আপনাকে সেইসব বিপর্যস্ত করবে। তাই নিজের বিবেক বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্ত নিন। আপনি জানেন আপনার মনোজগতের অবস্থাটা। আপনার বাবা-মা-আত্মীয়-সমাজ-বন্ধু সবাই তাদের অবস্থান থেকে – মতামত দিবে।
আর বাংলাদেশে, খেয়াল করলে দেখবেন – আপনার মানসিক কাউন্সেলর, আইনের লোকজন, কলিগ, বন্ধু, আত্মীয় সবাই – “মেনে চলো”, “সমঝোতা করো” বলে নিজেদের ঘরে যেয়ে আরামে ঘুমাবে।
কিন্তু, ওই মেনে চলতে যেয়ে বা সমঝোতা করতে যেয়ে আপনার চোখের পলক আর এক হবে না। কারণ, জেনেশুনে একজন প্রতারক, মিথ্যুক, লম্পট, নির্যাতক ও ব্যাভিচারী মানুষের সাথে সমঝোতা করা কতটা কঠিন – সেটা শুধু আপনিই বুঝবেন।
গত বছর অস্ট্রেলিয়াতে একজন বাংলাদেশী নারীকে তাঁর স্বামী প্রথমে গরম মিষ্টির রসে মুখ পুড়িয়ে, পরে ছুরি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে মেরে ফেলেছে। এই ঘটনার সূত্রপাত নিশ্চয় অনেক আগেই হয়েছে। এবং স্ত্রী’টিকে যথারীতি মেনে চলো-মানিয়ে চলোর বেড়াজালে নিজের আত্মীয়-পরিজনরা ফেলেছিলেন। (অনেকেই পরিবারের কঠিন বেড়াজালে থেকে – নিজে থেকে সিদ্বান্ত নিতে পারেন না।)
ওই নির্যাতিত নারীর খুব কাছের একজন মানুষের কাছে শুনেছি। তাদের দাম্পত্য কলহ ছিলো – সংসারের প্রতি স্বামীর অবহেলা ও অযত্নের হাত ধরে। আর এতে স্বামীর মা ও বোন জড়িত ছিলেন। স্বামীটি স্ত্রীর কোনো প্রকার কথার মূল্য দিতেন না। সংসারের খরচ দিতেন না, সন্তানদের দেখভালের জন্য কোনো গরজ ছিলো না। অন্যদিকে বোনের সন্তানদের প্রতি তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন দেখে – স্ত্রী স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। আর সেই বোঝানোর চেষ্টাই স্ত্রীটির জীবনের জন্য হুমকি হয়েছিল এবং সেটা তার নিজের জীবন দিয়ে ইতি টানতে হয়েছে। যাহোক খুনি স্বামীটি এখন আজীবন কারাগারে আছেন। তাদের সন্তানরা কোথায় আছে জানি না।
এমন করে কারোর জীবনের ক্ষতি করা উচিত নয়।
আর এই যুগল জীবনের কোথাও “নির্যাতনের” বিষয় আসা উচিত নয়। শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়ার মতো বিষয় নয়।
Dwayne Douglas Johnson (দা রক, নাম পরিচিত) বিশ্বের সর্বোচ্চ পেইড একজন অভিনেতা, তার প্রথম স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদের পর সেই প্রাক্তন এখন তাঁর বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার পার্টনার। তাঁরা সম্মানের সাথে আলাদা হয়েছেন, সন্তানদের লালন পালন করছেন – এবং পরে নিজেরা আবার বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।
বর্তমান সঙ্গীকে কোনো কারণে ভালো না লাগলে – লুকিয়ে অন্য সম্পর্কে জড়ানোর আগে – বিচ্ছেদে যান। মানুষ সম্মান করবে।
স্ত্রীকে মানসিক ও শারীরিকভাবে মেরে-কেটে ফেললে – আপনার সমাজের চোখে পড়ে না, লুকিয়ে করলে কেউ কিছু বলে না। তার মানে এই নয় যে আপনাকে মানুষ শ্রদ্ধা করছে।
মনে মনে আপনাকে কিন্তু “লম্পট”ই বলছে তারা।
কোনো দম্পতি যদি মনে করেন – তাদের কোনো কারণে একসাথে থাকা সম্ভব না। আর এই দম্পতির পরিবারের মানুষ হিসেবে – তাদের দুইজনকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে, সম্মানের সাথে থাকতে সাহায্য করুন। “মেনে নাও”, “সমঝোতা করো” – বলে অন্যের জীবনের হুমকি হবেন না।
বরং বলুন – তোমরা প্রাপ্তবয়স্ক ও বুদ্ধিমান মানুষ। এক সাথে না থাকতে পারলে – থেকো না। আলাদা হয়ে সুন্দরভাবে সম্মানের সাথে থাকো। আমরা তোমাদের সাথে আছি