‘কুমারী’ শব্দের অপসারণ, হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায়

রাহাত মুস্তাফিজ:

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ চমৎকার একটা রায় দিয়েছেন। মুসলমানদের বিয়ের কাবিননামার ৫ নাম্বার কলামে বিয়ের কনে কুমারী (ভার্জিন)/ বিধবা/ তালাকপ্রাপ্ত কিনা জানতে চাওয়া হয়। “কুমারী” অপশনটা বাতিল করে তদস্থলে “অবিবাহিত” লেখার আদেশ দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ছেলেদের ক্ষেত্রে তারা বিবাহিত, অবিবাহিত বা তালাকপ্রাপ্ত কিনা তা কাবিননামার ৪ (ক) ধারায় সংযুক্ত করারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

১৯৭৪ সাল থেকে কুমারী শব্দটার উল্লেখ প্রাইভেসি লঙ্ঘন করা একটা বৈষম্যমূলক, অসভ্য, পুরুষতান্ত্রিক অপশন হিসেবে জারি ছিল। নারীর ‘অক্ষত’ যোনি পুরুষের কাছে অতি আকাঙ্ক্ষিত আকর্ষণীয় ব্যাপার। চূড়ান্ত লম্পট পুরুষটিও কামনা করে একটি ইনটেক যোনিপথ। পুরুষের ওই লালসা পূরণ করতে বাসর রাতে সাদা কাপড়ের উপর শুয়ে নববিবাহিত স্ত্রীকে রক্তের পরীক্ষা দিতে হতো (এখনো কি হয় না?)। নির্বোধ ও বর্বর স্বামীর কাছে প্রথম রাতের রক্ত বিশ্বজয় করার সমতুল্য।

রাহাত মুস্তাফিজ

বর্তমানে কিছুটা শিক্ষার আলো পাওয়া বাঙালি মুসলমান এখন সাদা কাপড় বিছিয়ে রক্তের পরীক্ষা নিতে শরম পায়, কিন্তু মনে মনে আশা করে অল্প বয়সী কুমারী, যার যোনি পর্দা নিশ্ছিদ্র ও অটুট আছে। এবং যে তরুণীর ভেতর আর কোনো পুরুষ প্রবেশ করেনি। মূলত এই টাইপের চরম আধিপত্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক সেন্স ও কনশাসনেস থেকে আমাদের মেলশোভিনিস্ট আইনপ্রণেতারা “কুমারী” শব্দটা কাবিননামায় অপরিহার্য করে তুলেছিলেন।

অবশেষে সতী নারীর সাইনবোর্ড হিসেবে কাবিননামায় লটকে থাকা অমর্যাদাকর “কুমারী” শব্দটা অপসারিত হলো। নষ্টদের অধিকারে চলে যাওয়া বাংলাদেশ হঠাৎ আলোয় কিছুটা চমকিত হলো। অবশ্য এই হঠাৎ আলোর পাশেই অন্ধকার হয়ে “কুমারী” শব্দটি রেখে দেওয়ার পক্ষে যুক্তির ডালা সাজিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কতিপয় আইনজ্ঞ। তারা বলতে চেয়েছেন, কুমারী শব্দটা থাকায় কনের সন্তানসন্ততি না থাকার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝা যেতো।

কী অকাট্য যুক্তি! যেনো কনের সন্তান থাকা না থাকার তথ্য বিয়ে সংঘটনের জন্য খুব জরুরি। এবং এই তথ্য বরের কাছ থেকে আশা করা হয় না। কাবিননামার কোথাও বরের কাছে প্রশ্ন করা হয় না সে “কুমার” (ভার্জিন) কিনা? সুতরাং এই জিজ্ঞাসাটাও নিষ্প্রয়োজন যে বরের আগের ঘরের সন্তানাদি আছে কিনা?

বিরোধী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণের বোধদয় ঘটুক। তারা উপলব্ধি করতে শিখুন যে, কুমারী বা কুমার শব্দের অন্তর্ভূক্তি রেখে ব্যক্তির প্রাইভেসি, গোপনীয়তা ভঙ্গ করার অধিকার কারও নেই, থাকতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানেও সে অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি, বরং এজাতীয় বিষয়ের অন্তর্ভূক্তি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, এবং সেকারণে তা বাতিলযোগ্য।

কাবিননামায় উল্লেখিত বিষয়টি বাতিলের জন্য যারা আদালতে আইনি লড়াই চালিয়েছেন তাদেরকে ধন্যবাদ। বিশেষ করে লার্নেড সিনিয়র এডভোকেট জেড আই খান পান্না ও এডভোকেট আইনুন নাহার আপাকে স্যালুট! আপনারা একটি যুগান্তকারী কাজ করেছেন। আইনী ও সাংস্কৃতিকভাবে পিছিয়ে থাকা পশ্চাৎপদ এই দেশটা এতে করে কিছুটা এগোতে পারলো।

এবং অবশ্যই আপনাদের এই কাজ নারীবাদী আন্দোলনের পথে সাফল্যের পালক হিসেবে বিবেচিত হবে। সো-কল্ড নারীবাদীদের দিবানিশি বাকোয়াজের চেয়ে এই কাজটি হাজারগুণ বেশি কার্যকর হিসেবে চিহ্নিত হবে।

শেয়ার করুন: