পাঞ্জাবি

এই লেখাটি মূলত দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া শাড়ি শীর্ষক একটি লেখারই প্যারোডি মাত্র। মূল লেখকের লেখাটি একইরকম রেখে শুধু নারীর জায়গায় পুরুষ আর শাড়ির জায়গায় পাঞ্জাবি বসানো হয়েছে। 

নাসরিন খন্দকার:

বাঙালি পুরুষের কাছে পাঞ্জাবি তার সারা শরীর জড়িয়ে রাখা কাপড়ের একটা দীর্ঘ স্বপ্নখচিত জড়োয়া গয়না। যুগে যুগে এই পোশাককে বিচিত্র শব্দে–বর্ণে মহিমান্বিত করেছেন নারীরা। তবে বর্তমানে পুরুষদের মধ্যে কমে গেছে পাঞ্জাবি পরার চল। পাঞ্জাবি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক। শুধু শালীন নয়, রুচিসম্পন্ন, সুস্মিত ও কারুকার্যময় পোশাক। পুরুষ শরীরকে যতটুকু অনাবৃত রাখলে তা সবচেয়ে রহস্যচকিত হয়ে ওঠে, পোশাক হিসেবে পাঞ্জাবি তারই উপমা। শরীর আর পোশাকের ওই পুরুষালী এলাকা বিভাজনের অনুপাত পাঞ্জাবির রচয়িতারা কি জেনে না না–জেনে খুঁজে পেয়েছিলেন, সে কথা বলা না গেলেও এর পেছনে যে গভীর সচেতন ও মুগ্ধ শিল্পবোধ কাজ করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। আধুনিক পাঞ্জাবি পরায় পুরুষের উঁচু-নিচু ঢেউগুলো এমন অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে, যা পুরুষকে করে তোলে একই সঙ্গে পুরুষালী ও আকর্ষণীয়। পাঞ্জাবি তার রূপের শরীরে বইয়ে দেয় এক অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল।

না, সব দেশের ছেলেদের পাঞ্জাবিতে এমন অপরূপ লাগবে না। পৃথিবীর কোনো কোনো এলাকার পুরুষ শরীরেই কেবল পাঞ্জাবিতে এ অলীক রূপ ফুটে ওঠে, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের সুদর্শন সুকুমার সুপুরুষদের দেহবল্লরীতে—সে বাংলা, পাঞ্জাব বা উত্তর ভারতের—যেখানকারই হোক। বিশালদেহী আফ্রিকার পুরুষের জন্য এ পোশাক নয়, জার্মান বা ইংরেজ পুরুষের উদ্ধত সৌন্দর্যেও এ পোশাক হয়তো খাপ খাবে না। পাঞ্জাবি সুকুমার ও নমনীয় শরীরের জন্যই কেবল সত্যিকার অর্থে মধুর। হয়তো উপমহাদেশের বাইরে একধরনের মঙ্গোলীয় পুরুষকেও পাঞ্জাবিতে ভালো লাগবে তাদের শারীরিক কমনীয়তার জন্য। কিন্তু পোশাকটি তাদের ভেতর প্রচলিত নয় বলে সে কথায় এখন যাবো না। এটি ভালো লাগে বিপুলসংখ্যক উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় ছেলেদের। যদি বাঙালি ছেলেদের প্রশ্ন ওঠে তবে বলবো, এটি ভালো লাগে প্রায় প্রত্যেকটি বাঙালি ছেলেকে। সত্যি কথা বলতে কী, অধিকাংশ বাঙালি ছেলেকে পাঞ্জাবি ছাড়া আর হয়তো কিছুতেই মানায় না। এ জন্য তাদের প্রকৃতিগত পোশাক—তাদের সহজাত রূপের অংশ।
কেন, তা নিয়ে একটু ভাবা যাক।

কোনো এক কবিতায় কবি ওমর আলী লিখেছিলেন, ‘এ দেশের শ্যামল রং পুরুষের সুনাম শুনেছি।’ কেন এই শ্যামল পুরুষদের রূপের এতো সুনাম? এর কারণ তিনি ব্যাখ্যা করে বলেননি, কিন্তু তাই বলে গড়পড়তা বাঙালি পুরুষ রূপের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা সুদর্শনদের মধ্যে পড়ে এ বললেও যেন কিছুটা বেশি শোনাবে। বাঙালি নারীদের ব্যাপারেও হয়তো তা–ই।

ইংল্যান্ডের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: এখানে রাস্তায় বেরোনোর বড় সুবিধা যে থেকে থেকেই সুন্দর মুখ দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালি জাতির বেলায় কথাটা হয়তো ওভাবে খাটবে না। তবে মাঝে মাঝে এ দেশেও যে এক–আধজন সুন্দর মুখের দেখা পাওয়া যায় না, তা–ও নয়। তবে একটিমাত্র কারণেই কেবল তা হতে পারে; যদি তারা তাদের কমনীয় পাঞ্জাবিগুলোকে নান্দনিক বা সুরুচিসম্মতভাবে পরতে পারে। রবীন্দ্র সংগীতের সুরের সঙ্গে রবীন্দ্র সংগীতের অনিন্দ্য কথা যোগ হলে যা হয় আমাদের সুদর্শন পুরুষেরা তখন তা–ই হয়ে যায়।

বাঙালি সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা: আমার ধারণা ‘উচ্চতা’। সবচেয়ে কম যে উচ্চতা থাকলে মানুষকে সহজে সুন্দর মনে হয়—যেমন পুরুষের ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি ও মেয়েদের ৫ ফুট ৫ বা ৬ ইঞ্চি—আমাদের গড় উচ্চতা তার চেয়ে অন্তত ২–৩ ইঞ্চি কম। দৈহিক সৌন্দর্য মেয়েদের বড় ব্যাপার নয় বলে এ নিয়েও তারা কোনোমতে পার পেয়ে যায়। কিন্তু আটকে যায় ছেলেরা।

আমার ধারণা, একটা ছেলের উচ্চতা অন্তত ৫ ফুট ৪–এর কম হলে তার শরীরে পুরুষজনিত গীতিময় ভঙ্গি পুরোপুরি ফুটে ওঠে না। এরপর তাদের দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ৫, ৬ বা কিছু পরিমাণে ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত উঠলে তা ক্রমাগত অলীকতর হয়ে উঠতে থাকে। বাঙালি ছেলেরা বিপদে পড়ে এখানটাতেই। এদের গড় উচ্চতা ৫ ফুট ২ থেকে ৩ ইঞ্চির সামান্য এদিক–ওদিকে (অবশ্য ১০ শতাংশ ছেলেকে বাদ দিয়ে ধরলে)। এই উচ্চতা নিয়ে ললিত–মধুর ও দীর্ঘাঙ্গ পুরুষের কমনীয় শরীর নিয়ে ফুটে ওঠা কঠিন, যা দেখা যায় এই উপমহাদেশের উত্তর দিকের পুরুষের উন্নত দেহসৌষ্ঠবে। ওই অঞ্চলের ছেলেদের তুলনায় বাঙালি ছেলেদের আরও একটা জায়গায় ঘাটতি আছে।

মনে রাখতে হবে, বাঙালিরা একটু বেশি রকমের মিশ্র জাতি। নানা জাতির দৈহিক বৈশিষ্ট্য এ জাতির মানুষের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে অমিলভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। কিছুটা অবিন্যস্তভাবে, তাই বাঙালি ছেলেদের দেহ গঠন উপমহাদেশের উত্তরাংশের ছেলেদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অসম। যেকোনো অসমতাকে আড়ালে রেখে মানসম্মত দেহসৌষ্ঠব নিয়ে দাঁড়ানোর পথ একটাই—ইংরেজিতে যাকে বলে মেকআপ—যার গভীরতর মানে মেকআপ দ্য লস। শারীরিক অসমতার এতো ঘাটতি থাকার পরও অন্যান্য মেকআপের মতো রূপকে নিটোলতা দেওয়ার মতো এক অনন্য সাধারণ মেকআপ রয়েছে বাঙালি ছেলেদের ভাঁড়ারে। আমার মতে, এর নাম ‘পাঞ্জাবি’।

আগেই বলেছি, উচ্চতার কারণে উপমহাদেশের উত্তরাংশের গড়পড়তা ছেলেদের পাঞ্জাবি বা লুঙ্গি দুটোতেই ভালো লাগে। কিন্তু ওই কাম্য উচ্চতার অভাবে বাঙালি ছেলেদের পাঞ্জাবি ছাড়া আর যেন কোনো গতিই নেই। আজ বাঙালি ছেলেরা সেই পাঞ্জাবিকে প্রায় ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিচ্ছে।

আজকাল পাঞ্জাবি ছাড়া অনেক রকম কাপড় পরছে তারা লুঙ্গি গেঞ্জি তো আছেই, পাশ্চাত্য ফ্যাশনের কাপড়ও কম পরছে না—এবং পরার পর ইউরোপ বা ভারতের ওই সব পোশাক পরা সুদর্শনদের সমকক্ষ ভেবে হয়তো কিছুটা হাস্যকর আত্মতৃপ্তিও পাচ্ছে।

আমরা যেন না ভুলি যে এসব পোশাক বাঙালি ছেলেদের দেহ গঠনের একেবারেই অনুকূল নয়। দেহভঙ্গিমারও না। বাঙালি ছেলেদের উচ্চতার অভাবকে আড়াল করে তাদের প্রীতিময় ও কিছুটা তন্বী করে তুলতে পারে একমাত্র পাঞ্জাবি। ছেলেরা পাঞ্জাবি পরে মাথা বা কাঁধ থেকে হাঁটু পর্যন্ত। এভাবে পাঞ্জাবিতে শরীর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যেকোনো ছেলের রূপে কমবেশি দীর্ঘাঙ্গ বিভ্রম দেখা দেবেই, ঠিক যে কারণে শাড়ি নারীদের শরীরে দীর্ঘদেহিতার বিভ্রম জাগায়। এতে সঠিক উচ্চতার তুলনায় তাদের কিছুটা বেশি দীর্ঘ লাগে। ছেলেদের ব্যাপারেও তা–ই। ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার ছেলেদের ভুল করে এভাবে মনে হতে পারে ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির ছেলে!
আর সেইসঙ্গে তাদের চিরস্থায়ী ইগোর উচ্চায়ত রহস্য তো রয়েছেই একটা রহস্যময় পোশাক। পুরুষ দেহকে কতটা প্রদর্শন করলে আর কতটা অপ্রকাশিত রাখলে তা শারীরিক মোহ বজায় রেখেও দর্শকের চোখে অনিন্দ্য হয়ে উঠবে, তা পোশাকটি যেন সহজাতভাবেই জানে।

পাঞ্জাবি ছাড়া এমন জাদুকরি রহস্য আর পরস্পরবিরোধী মাধুরী আছে কোন পোশাকে? শরীর নিয়ে এমন শিল্পিত খেলা আর কে খেলতে পারে? লুঙ্গি-গেঞ্জি, টাইট জিনস, বুক খোলা, সি-থ্রু শার্ট কি এর সমকক্ষ? শেষেরগুলো তো প্রায় পোশাক না থাকারই শামিল।

জাপানি কিমোনোর রং ওদিকে আবার বেশি রকম উচ্চকণ্ঠ। শরীরের সহজাত মাধুর্যকে এ প্রায়শই ছাপিয়ে যায়। বাকি পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই পোশাক হয় শরীরটাকে পুরুষালী গুদামঘর বানিয়ে রাখে, নয়তো প্রায় বিবস্ত্র করে রগরগে যৌনতার মৌতাত উদ্​যাপন করে। পাঞ্জাবির মধ্যে আছে এই দুইয়ের মিলিত জাদু। এ সৌন্দর্যের লালসাকেও বাদ দেয় না, আবার আলোয়–ছায়ায়, মেঘে-রৌদ্রে শরীরকে যেন স্বপ্নরাজ্য বানিয়ে দেয়।

আগেই বলেছি, নানা জাতির দৈহিক বৈশিষ্ট্য একত্র হওয়ায় বাঙালির শরীর অধিকাংশ সময় সুগঠিত নয়। এই ত্রুটিকেও পাঞ্জাবির রুচি স্নিগ্ধ–শৈল্পিক আব্রুর মধ্যে এনে যেন বাঙালি ছেলেকে প্রাণে বাঁচিয়ে দেয়।

তাদের শরীরের অসম অংশগুলোকে লুকিয়ে ও সুষম অংশগুলোকে বিবৃত করে পাঞ্জাবি এই দুর্লভ কাজটি করে।
পাঞ্জাবির আরেকটা দিক আছে, যা দীর্ঘ বা মধ্যম উচ্চতার সব ছেলেকেই সুদর্শন করে তোলে। সেটা হলো এর সহজ প্রীতিময়তা।

কোনো ছেলে পাঞ্জাবিতে সুন্দর হয়ে উঠতে চাইলে তার শরীরকে পাঞ্জাবির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য তাড়াহুড়ো করতে হয় না। বিনীত পাঞ্জাবিই তার কোমলতা দিয়ে ওই শরীরকে সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। পাঞ্জাবি সারা শরীর জড়িয়ে রাখা কাপড়ের একটা দীর্ঘ স্বপ্নখচিত জড়োয়া গয়না। বৈচিত্র্যে, সৌন্দর্যে কারুকার্যে প্রায় তুলনাহীন। আমাদের সোনালি ধানখেতগুলো যেন গোটা বাংলাদেশকে নানান বাঁকে জড়িয়ে দেশজুড়ে বয়ে যায়, পাঞ্জাবিতেও তেমনি পুরুষেরর শরীরে সৌন্দর্যের প্রতিটি ঢেউ আর সরণিকে আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু ভঙ্গিতে বিন্যস্ত করে হাঁটুর কাছে এসে পাঞ্জাবির পায়ের দুইটি সাদা স্তম্ভের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়।

নাসরিন খন্দকার

পাঞ্জাবি বা কিমোনোর মতো ঐতিহ্যময় পোশাককে হটিয়ে লুঙ্গি-গেঞ্জি, প্যান্ট, কোট, ট্রাউজার, শার্ট যে একালের ছেলেদের মন কাড়লো তার কারণ এই নয় যে পাঞ্জাবি বা কিমোনো পোশাক হিসেবে ভালো নয়, এর কারণেই কর্মব্যস্ত ঊর্ধ্বশ্বাস যুগের অকর্ষিত রুচি চাহিদা। জীবন প্রয়োজনের ক্লেদাক্ত চাপ শিল্পকে হটিয়ে দিয়েছে। এ যুগ সৌন্দর্যের পরিশীলনকে জানে না। সে বোঝে শুধু একটা জিনিস; লেস ইজ মোর। এই লেসের আক্রমণে মানুষের পোশাকরুচি তার শরীরের সমস্তরে নেমে গেছে।

আমার মনে হয়, এ রকম একটা অপরূপ পোশাককে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে বাঙালি ছেলেরা সুবুদ্ধির পরিচয় দেয়নি।

 

:: শাড়ি লেখাটি প্রথম আলোতে ছাপা হওয়ার পর অনলাইনে বেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্যারোডিটি ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.