বাইরের সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ বনাম আমরা

Journalismউইমেন চ্যাপ্টার: কেন ফিশার, মাইক বুচার, বব ডটসন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটির গেলর্ড কলেজ অব জার্নালিজম এন্ড কমিউনিকেশনের শিক্ষক। বছর তিনেক আগে ওই ডিপার্টমেন্টে ‘ভিজ্যুয়াল স্টোরি টেলিং ওয়ার্কশপ’ করতে গিয়ে পরিচয় হয় তাদের সঙ্গে।

এর মধ্যে মাইক ত্রিশ বছর কাজ করেছেন সিএনএন এ, এবিসিতেও ছিলেন অনেকদিন। এখনও শিক্ষকতার পাশাপাশি ডাক পেলেই ছুটে যান রিপোর্ট করতে। যুদ্ধ সাংবাদিকতা তার মূল। ইরাক যুদ্ধ, বসনিয়া যুদ্ধ, আফগানিস্তান যুদ্ধ সবই কভার করেছেন তিনি। এ লেখাটি যখন তৈরি হচ্ছিল, তখনও তিনি ই-মেইলে জানালেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন আবারও আফগানিস্তান যাওয়ার। বয়স তাঁর ষাটের ওপরে। এখনও তিনি সচল, উচ্ছল, পেশাদার নিজ পেশার প্রতি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখনও তিনি ছোটেন যুদ্ধের ময়দানে। কখনও ‘এমবেডেড’ হয়ে, কখনও বা কোম্পানির হয়ে।

তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘এমবেডেড’ সাংবাদিক হলে সাংবাদিকতার মূলমন্ত্র থেকে কি বিচ্যুত হওয়া হয় না? মাইক তার স্বভাব-সুলভ বিনীত হাসি হেসে বললেন, একজন প্রকৃত সাংবাদিককে কখনও ‘এমবেডেড’ বানানো যায় না, শুধুমাত্র কিছু শব্দের আড়ালে তাকে লুকিয়ে রাখা যায় না। নিজের নিরাপত্তার জন্য হয়তো বা সে কখনও কখনও কারও ছায়ার আশ্রয় নেয়, কিন্তু যে মনে-প্রাণে সাংবাদিক, সে তো যা দেখছে তাই লিখে, নাকি? এজন্য সে ছলা-কলার কৌশল নিতেও পিছপা হয় না। একথা বলে তিনি তার কাজের কিছু নমুনাও দেখালেন ইরাক যুদ্ধের ওপর।

এই শিক্ষকদের সবারই বয়স একটি নির্দ্দিষ্ট কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে, সাংবাদিকতার তত্ত্বগত, তথ্যগত বিদ্যা, স্ব স্ব অভিজ্ঞতা সবদিক থেকেই তারা সমান পারদর্শী। দিন পাল্টেছে, পাল্টে যাচ্ছে খবরের ভাষা ও ধরন। প্রযুক্তির এ যুগে তারাও নিজেদের গড়ে তুলেছেন বিশ্বমানের করেই। আমাদের দেশে চ্যানেল বদলানোর বদৌলতে একজন সাংবাদিক পুরোপুরি অভিজ্ঞ হয়ে উঠার আগেই বনে যান কর্তা ব্যক্তি। যখন তাদের দেশকে অনেক কিছু দেবার কথা, অপেক্ষাকৃত ছোট ও নবীনরা যখন তাদের দেখে শেখার কথা, পদাধিকার বলে তারা তখন মোটা অংকের মাইনে নিয়ে আর লোক নিয়োগ দিয়েই আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন।

এ ব্যাপারে কেন ফিশারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এই অবস্থার দুরকম প্রভাব সমাজে পড়ে। এক, পুরোপুরি অভিজ্ঞ নন, অথচ নিজেদের যথেষ্টই অভিজ্ঞ ভাবেন, এমন মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে মিডিয়া; দুই, সেই সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। এর সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ ও মিডিয়া দুটোই।

যাক্ সেসব কথা। কেন, মাইক, বব সবার সাথে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা, প্রতিবন্ধকতা, ভবিষ্যত, এমনকি নারী সাংবাদিকদের নানান প্রতিকূলতা নিয়েও অনেক কথাই হয়েছে সাতদিন ধরে। তবে তারা বিশেষভাবে উৎসাহী আমাদের এই উপমহাদেশের ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেলের বিষয়ে। এ যুগে নিউজের বিকল্প কেবল নিউজই, একথাও বললেন বার বার। হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট সময় থাকে না একটা নিউজ নিয়ে ভাবার, তারপরও এই প্রতিবন্ধক সময়কে কিভাবে উতরে গিয়ে একটি ভাল রিপোর্ট একজন সাংবাদিক দিতে পারেন তারই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তারা। নিউজ এডিটর, প্রডিউসার, রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান সবার ওপরই বর্তায় একটি রিপোর্টের সাফল্য।

ওদের কথা শুনছিলাম, আর ভাবছিলাম দেশের মিডিয়ার কথা। নিউজ চ্যানেলগুলোর কথা। যখনই ঘটনা, তখনই খবর জানাতে গিয়ে ‘লাইভ’ এর আশ্রয় নেয় আমাদের চ্যানেলগুলো। আর এর যে কী অবস্থা তা দর্শকমাত্রেই জানেন। কি প্রশ্ন করা হবে, কি উত্তর হবে, কতটা উত্তর হবে, কতক্ষণ চলবে, সবমিলিয়ে এখন লেজেগোবরে অবস্থা। লাইভ এর নামে যা হচ্ছে, তা বলাবাহুল্য।

ওকলাহোমার ওই প্রশিক্ষণে একজন শিক্ষক বলেছিলেন, তিনি এতো বছর পরও রিপোর্ট করতে গিয়ে ভুল করেই যাচ্ছেন, কখনও ৮০ ভাগ সুখী হতে পারছেন না তার কাজ থেকে। ‘আরো ভাল হতে পারতো’ এমন একটি মনোভাব সবসময় পিছু ফেরে তার। আর এই অতৃপ্তি নিয়েই আবারও পরবর্তী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আত্মতৃপ্তির কোনো স্থান নেই, এটাই বোঝাতে চাইলেন। আর আমাদের দেশে? সাংবাদিকরা এতোটাই তৃপ্ত যে, তারা দিনে-দিনে ফুলে-ফেঁপেই উঠছেন কেবল।

সাংবাদিক শিক্ষকরা আরও বলেছিলেন, কোম্পানির জন্য নয়, একেবারে নিজের জন্য কাজ করতে। একজন সাংবাদিকের চেহারা, গঠন-গাঠন কোনো বিষয় নয়, বিষয় তার কাজ। একজন সাংবাদিক কিভাবে নিজেকে যতোটা সম্ভব আড়াল করে একটি রিপোর্টকে এগিয়ে নিতে পারবেন তার কৌশল, ভাষাশৈলী দিয়ে সেটাই বিবেচ্য। অনেকেই নিজেদের দেখানোর প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে পারেন না। কিন্তু একটি রিপোর্টের জন্য সেটা তো প্রয়োজনীয় নয়। মানুষের কথা বলার জন্য নিজেকে দেখানোর কোনো অর্থ হয় না। একটি সাধারণ সেমিনার বা সংবাদ সম্মেলনও যে কতোভাবে রিপোর্ট করা যায় তাও দেখিয়েছিলেন নিজেদের অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে। এ প্রসঙ্গে একটু বাংলাদেশকে দেখি। এখানে কী হয়? সেমিনার জাতীয় নিউজ কভার করতে গিয়ে বেশির ভাগ সাংবাদিকই সময়মতো পৌঁছান না সেখানে। আর পৌঁছালেও ভিতরে কী হচ্ছে,. সেটা প্রধান না হয়ে প্রধান হয় বাইরে ওই সেমিনারের বিশেষ বা প্রধান অতিথি কী বললেন, তা। ফলে প্রায়ই দেখা যায়, সেমিনারের সাথে এই নিউজের কোন যোগসূত্রই নেই।

ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটির সপ্তাহব্যাপী ওই ওয়ার্কশপে অনেক বিষয়ই অন্তভুর্ক্ত ছিল। যেমন, একটি রিপোর্ট কিভাবে দর্শকনন্দিত রিপোর্ট হতে পারে, মানুষের স্থান কতটুকু হতে পারে একটা রিপোর্টে, পিটিসি (পিস টু ক্যামেরা) কত ধরনের হতে পারে, রিপোর্টার-ক্যামেরাম্যান সম্পর্ক কি করে একটি অসাধারণ রিপোর্ট বানাতে পারে, সার্বিকভাবে একটি টিমওয়ার্কের কথাই তারা বললেন গুরুত্বের সাথে। নিউজরুমে যারা রানডাউনের দায়িত্বে থাকেন, যারা এসাইনমেন্ট ডেস্কে থাকেন তাদের করণীয় কি, এসবও ছিল আলোচনায়। পাশাপাশি ওকলাহোমার স্থানীয় চ্যানেল, চ্যানেল ফোর এ গিয়ে তাদের কাজও হাতে-কলমে দেখিয়েছেন তারা। অ্যামি অ্যাওয়ার্ড পাওয়া দুই সংবাদ পাঠকের সাথেও দেখা হলো।

জিজ্ঞ্যেস করলাম, এখানে সংবাদ যারা পড়েন তাদের কোনো বয়সসীমা নির্দ্দিষ্ট নেই? উত্তর এলো, যত অভিজ্ঞ সাংবাদিক হবে, তত ভালো সংবাদ উপস্থাপন (পাঠক, খেয়াল করুন, শব্দটা পাঠক নয়, সংবাদ উপস্থাপক)করতে পারবে সে। অনেকটাই জড়োসড়ো হয়ে গেলাম নিজের দেশের সংবাদ উপস্থাপকদের (?) বয়সের কথা ভেবে। এখানে তো কমবয়সই সবচেয়ে বড় মাপকাঠি সংবাদ উপস্থাপকের, তা সে নিউজ বুঝুক আর নাই বুঝুক।

আরো একটি ব্যাপার, ছোট্ট একটি শহর ওকলাহোমা, যেখানে কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই, সেখানে তারা হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন নিউজ সংগ্রহের জন্য। আর সেটি করেন যিনি, তিনি একাধারে পাইলট, ক্যামেরাম্যান ও রিপোর্টারও। কতো বিড়ম্বনাহীন সাংবাদিক জীবন তাদের!

তিনটি বিষয়ের ওপর তারা গুরুত্ব দিলেন। এক, পেশার প্রতি আনুগত্য; দুই, মানুষ; আর তিন, প্রশ্ন করার ক্ষমতা ও প্রস্তুতি। তবে পেশার প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে জগত সংসারকেও তারা উপেক্ষা করতে বলেননি। সবাই সময় চায়, কাজ যেমন সময় চায়, তেমনি পরিবারও। কাজেই যার যা প্রাপ্য, ঠিক ততোটুকুই দিতে বললেন তারা। আর সবকিছু তুচ্ছ করে পেশাকে ‘আলিঙ্গন’ করতে নিষেধ করলেন।

২৪ ঘন্টার নিউজের কথা বলতে গিয়ে তারা কিছু ‘টেকনিক’ এর কথাও বললেন। বললেন, এক্ষেত্রে যেহেতু খুব কমই সময় পাওয়া যায় একটি রিপোর্টের জন্য, কাজেই, যথাসম্ভব সময়টিকে কাজে লাগাতে হবে। সম্ভব হলে বিষয়বস্তুর চারপাশে একনজর ঘুরে আসার জন্য রিপোর্টার এবং ক্যামেরাম্যান দুজনেরই কিছুটা সময় বের করা প্রয়োজন। তাতে করে বিষয়টা অনেকটাই খোলাসা হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া ঠিক পেশাদার ক্যামেরাম্যান হিসেবে নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে ক্যামেরা হাতে নিয়ে বিষয়বস্তুর চারপাশ একবার ঘুরে এলে অভাবিত ফল পাওয়া যেতে পারে বলেও মনে করেন ওকলাহোমার ওই সাংবাদিক শিক্ষকরা। তাদের কথা, একজন সাধারণের চোখ দিয়ে রিপোর্টটি দেখতে শেখো। ভাবো যে, ওই রিপোর্টের বিষয়বস্তু হিসেবে তুমি নিজেকে কিভাবে দেখতে চেয়েছিলে! হাতে যদি মাত্র ১০ মিনিট সময় থাকে, তবে তা যেন ১০ মিনিটই হয়, সেদিকটিও ভাবতে হবে একজন রিপোর্টারকে।

সাউন্ড বা শব্দ একটি রিপোর্টের অন্যতম অনুষঙ্গ। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, শুটিংয়ের সময় একটি মুহূর্ত বেছে নাও, যখন তুমি ‘নিজ কান’ দিয়ে দেখবে বিষয়টিকে। ক্লোজ আপ শট নেয়ার পাশাপাশি মাইকটিও ধরা হোক ক্লোজ করেই। বিষয় আর শব্দ তখন ভাল রেজাল্ট দেবে। একটি বাড়িতে সাক্ষাত্কার নিতে ঢোকার আগে ভাবো, কি শব্দ তোমার কান শুনতে পারতো। সাক্ষাত্কার শেষে বেশকিছু বাড়তি শব্দ যোগ করে নাও। কল থেকে জল পড়ার শব্দ, শিশুর পিয়ানো প্রশিক্ষণ, মাইক্রোওয়েভের শব্দ, মেঝেতে ধপ ধপ আওয়াজ, এসবও কখনো কখনও রিপোর্টের সাহায্যে আসতে পারে। কথার চেয়ে অনেক সময় শুধুমাত্র শব্দ দিয়েও একটি রিপোর্ট করা যেতে পারে। শিশুর ঘর বোঝাতে খেলনাপাতি দেখানোই সার কথা নয়, শিশুর পড়ার শব্দও এখানে প্রযোজ্য হতে পারে। শব্দ অনেক ক্ষেত্রে পরবর্তী সিকোয়েন্স বোঝাতে সাহায্য করে। যেমন, লরেন্স অব অ্যারাবিয়া ছবিতে একজন উটের আরোহীর পিপাসার কথা বোঝাতে গিয়ে জল পড়ার শব্দ দিয়ে তা বোঝানো হয়েছিল। ছবির মতো শব্দকেও সম্পাদনা করতে হবে ওয়াইড, মিডিয়াম এবং টাইট করেই। মনে রাখতে হবে, একটি রিপোর্ট একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিও। যার শুরু (ইন্ট্রো), মূলকথা (বডি) এবং শেষ (এন্ডিং) থাকে।

ফটো সাংবাদিকদের জন্য উপদেশ হলো, ক্লাসিক ফিল্ম দেখা ভলিউম অফ করে দিয়ে, তাহলেই কম্পোজিশন, আলো, সম্পাদনা এবং বিশেষ করে স্টোরিটা সম্পর্কে একটা ভাল ধারণা মিলবে। ফটোগ্রাফির ৯০ ভাগই আসলেই মনস্তাত্ত্বিক। ভাল ছবিসম্পন্ন যেকোনো রিপোর্টই লোকে মনে রাখে অনেকদিন, এমনকি লিড স্টোরির চাইতেও।

ফিচার স্টোরিকে যতোটা হেয়ই করা হোক না কেন, হার্ড নিউজের চাইতেও এটা কিন্তু কঠিন। সব সময় না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রানডাউনের ওপরের রিপোর্টের চেয়ে মানুষ মনে রাখে শেষের কম গুরুত্ব পাওয়া রিপোর্টটিই। অনেক রিপোর্টারকেই বলতে শোনা যায়, এটা তো ফিচার, রিপোর্ট না। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল হওয়ার সুযোগ থাকে একমাত্র ফিচারেই। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ অনেক হার্ড নিউজই শেষ হতে পারে ফিচার দিয়ে। এখানেই রিপোর্টারের কৃতিত্ব। তবে হার্ড নিউজ যখন ফিচার করা হয়, তখন বালখিল্যপনা থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে একজন রিপোর্টারকে। শব্দ, মিউজিক নির্বাচনের বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে। তা নয়তো পুরো বিষয়টিই একটা হাস্যরসে পরিণত হতে পারে।

পিটিসিও হতে পারে ভিন্ন ভিন্নভাবে। মাইক্রোফোনের লোগোটা দেখা না যাওয়াই ভাল। মনে রাখতে হবে, লোগোসহ মাইক্রোফোন যখন দেখে মানুষ, তারা দেখে টেলিভিশন; আর লুকিয়ে রাখা মাইক যখন ব্যবহার করে কোনো রিপোর্টার, তখন মানুষ দেখে তার উপস্থাপিত স্টোরিটাই। মোদ্দা কথা, খুব যত্নশীল হতে হবে একজন রিপোর্টারকে। সে নিজেই যদি মনোযোগী না হয়, তবে দর্শক-শ্রোতারা তা হবেন, তা আশা করাই ভুল।

শেয়ার করুন: