রাজনৈতিক পরিচয়ে ছাত্রদের ধর্ষণ উৎসব বন্ধ হোক

শারমিন জান্নাত ভুট্টো:

গণমাধ্যমে গত কয়েকদিনে যে সংবাদটি সবচেয়ে বেশি ঝড় তুলেছে সেটি হচ্ছে তুফান ও তার কাণ্ড। রাজনৈতিক পরিচয়ের ফায়দা লুটে দিনের পর দিন এক একটি অনিয়ম ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে আর তা ধামাচাপা দিতে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, মহল্লাবাসী, সংগঠন সবাই উঠে-পড়ে লেগেছে।

অবশ্য তুফানের মতো ব্যক্তিরাই রাজনৈতিক পরিচয় খাটিয়ে দেদারসে মাল-পানি কামাচ্ছে আর ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় সর্বোচ্চ ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড করতেও দ্বিধা করছে না। অবশ্য দ্বিধা কিংবা হীনমন্যতায় ভোগারও তো কোনো কারণ দেখছি না। গত কয়েক বছরে ধর্ষণের মতো যতগুলো ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্র সংগঠনটি তার কোনটির কী সঠিক কোন বিচার হয়েছে? না হয়নি একটিও। এমনকি হয়নি কোন ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপনও। আর এ কারণেই অনেকে ভাবতে শুরু করেছে, অপরাধ করে এ সমাজে, এ দেশে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ানো যায়, বসা যায় রাজ সিংহাসনে যদি কিনা পশ্চাদে আটকে থাকে রাজনৈতিক স্টিকার।

গত বেশ কয়েক বছরের কিছু ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড উল্লেখ করলে বোঝা যাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে কিভাবে একটি ছাত্র সংগঠনের নেতা/সদস্যরা ধর্ষণের নেশায় মেতে উঠেছে উৎসবে।

ঘটনা এক. বরিশালের বানারীপাড়ায় এক গৃহবধূ ধর্ষণের অভিযোগে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন হোসেন মোল্লাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রবিবার বিকেলে ধর্ষিতার স্বামী শিশু ও নারী নির্যাতন দমন আইনে বানারীপাড়া থানায় মামলা দায়ের করলে সন্ধ্যায় তিনি গ্রেফতার হন।

(http://www.ittefaq.com.bd/wholecountry/2017/07/16/120646.html, ১৬ জুলাই, ২০১৭)

ঘটনা দুই. ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে ঘটনার পাঁচ মাস পরে মামলা হয়েছে কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি কামরুল ইসলাম জানান, মেডিকেল টেস্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে ঘটনায় ছাত্রীর বাবা তিনজনকে আসামি দেখিয়ে মামলা করেছেন

আসামিরা হলেনউপজেলার হবিরবাড়ি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর কবির, তার বন্ধু তুষার (২৬) স্থানীয় মাইক্রোবাস চালক মোখলেছ (২৫)। প্রভাবশালীদের চাপে মানসিক বিপর্যয়ের কারণে মামলা করতে দেরি হয়েছে বলে জানান ছাত্রীর বাবা

(http://bangla.bdnews24.com/samagrabangladesh/article1339277.bdnews, 2017-05-24)

ঘটনা তিন. ঝিনাইদহের কোটচাঁদপরে দুই নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ শাহীন, তাঁর দুই সহযোগী কৃষ্ণপদ দাস রাজু আহমেদকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ

(http://www.ntvbd.com/bangladesh/129531/%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%A3-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BF-%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A6%97-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%B9-%E0%A7%AB, ১০ মে ২০১৭)

ঘটনা চার.

বানারীপাড়ায় ধর্ষিতা স্কুল ছাত্রীকে আটক করে ফের ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে এক ছাত্রলীগ নেতাকে আটক করেছে পুলিশ এসময় ছাত্রীর কথিত প্রেমিক ধর্ষককেও আটক করা হয়

(http://www.jugantor.com/online/country-news/2016/10/11/27492/%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A6%97-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%A3-%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE, ১১ অক্টোবর, ২০১৬)

ঘটনা পাঁচ.

চিরবৈরী রাজনৈতিক সংগঠন ছাত্রলীগ ছাত্রদলের দুই নেতার নেতৃত্বে জেলার চৌগাছায় এক স্কুলছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে দিনের বেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে তুলে নিয়ে লম্পটরা এই অপকর্ম করে

(http://bangla.thereport24.com/article/128613/index.html, ২০১৫ অক্টোবর ০৪)

ঘটনা ছয়.  

চিকিৎসা নিতে রাজধানীতে এসে হোটেলকক্ষে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গৃহবধূ (২৬) গত রোববার গভীর রাতে মগবাজারের এক অাবাসিক হোটেলে পাশের কক্ষে স্বামীকে বেঁধে রেখে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়৷ ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ ওই কক্ষ থেকে মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতা তাঁর এক সহযোগীকে ছুরিসহ গ্রেপ্তার করেছে৷

(http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/238774/%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%81%E0%A6%A7%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%A3-%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A6%97-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%B9, ১১ জুন ২০১৪)

ঘটনা সাত.

২০১০ সালের ২৬ এপ্রিল দিনেদুপুরে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে এক ছাত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে ছাত্রলীগ কর্মীরা

(http://www.bdtodaynews.com/%E0%A6%AA%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B2/)

উপরের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে খালি চোখে এটাই বোঝা যায় যে, বর্তমানে ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের মাঝে এক ধরনের বেপরোয়া ভাব গতি বিরাজ করছে। যার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে আর তা দেখার মতো দৃষ্টিও যেনো কারো নেই।কোন ঘটনায় ভুক্তভোগীরা পায়নি সঠিক কোন বিচার কিংবা হয়নি অপরাধীদের কোন উল্লেখযোগ্য শাস্তি। আর সে কারণেই যে যেভাবে পারছে একটার পর একটা অপরাধ করেই যাচ্ছে। তাদের মাথার ওপর সংগঠনের ছাতা তাদেরকে রক্ষা করছে সবধরনের রোদ, বৃষ্টি, ঝড় থেকে, সেই সাথে দিয়ে যাচ্ছে নিবিড় ছায়া।

এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন যে ছাত্রটি/সদস্যটি ধর্ষণের সাথে জড়িত তার চারিত্রিক বিশ্লেষণ কিভাবে আগে থেকে জানা সম্ভব কোন সংগঠনের পক্ষে? অবশ্যই সম্ভব তা একটু বিশ্লেষণ করেই বলছি। শুধু বিদেশে নয়, দেশেও কোথাও চাকুরী করতে গেলে কি খতিয়ে দেখা হয় ওই ব্যক্তিটির নামে কোন ধরনের ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে কিনা। এমনকি যেতে হয় নানা ধরনের মনস্তাত্বিক/আচরণগত পরীক্ষার মধ্য দিয়েও। ইতিবাচক নম্বর পাবার পরই কেউ জয় করতে পারেন তার কাঙ্খিত পদটি এবং যোগ্যতা অনুযায়ী পাবে পরবর্তী পদগুলো। তারপরও থাকে নানা ধরনের শর্ত যেখানে নিয়ম অনুযায়ী না চললে পেনাল্টি কিংবা শাস্তির বিধান থাকে এমনকি প্রত্যাহার করে নেয়া হয় সদস্যপদও। কেউ অপরাধ করলে তাকে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ীই শাস্তির আওতায় পড়তে হবে যদিও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মামা-ভাগ্নে কিংবা মুল্লুক আইনই বেশি পরিলক্ষিত। মাঝে-মধ্যে অবশ্য বড় গলারও আওয়াজ পাওয়া যায় বেশি।

কেনো ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের সদস্যদের যারা অপরাধের সাথে জড়িত তাদের বহিষ্কার করে না? কিংবা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে ওইসব সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করছে না আইনীভাবে? এ ধরনের একটি-দুটি কড়া সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো ক্ষমতা যদি ছাত্র সংগঠনগুলো নিতো, তবে নি:সন্দেহে ছাত্র সংগঠনগুলো সবার কাছ থেকে অনেক বেশি বাহবা পেতো এবং আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারতো।

ছাত্র সংগঠনের পদ যাতে অপরাধে জড়িয়ে যেতে সেতুর মতো কাজ না করে সেদিকটায় নজর দিতে হবে শীর্ষ নেতাদেরই। তা না হলে নতুন প্রজন্ম ভাবতে শুরু করবে, অমুক সংগঠন বা তমুক সংগঠনে থাকতে পারলেই অনায়াসে কোন মেয়েকে ধর্ষণ করা যাবে, ভয়ভীতি দেখিয়ে তার চুল কেটে নেয়া যাবে যাতে করে সে কোন ধরনের আইনের আশ্রয় নিতে পারে। আর পড়ালেখা না করেই কিংবা সারাজীবন ছাত্র হয়েই আয় করা যাবে লাখ টাকা।

অপরাধী যেই হোক না কেনো তার অপরাধ যাতে ঢাকা না পড়ে রাজনৈতিক চাদরে। শুধু একজন তুফানকে থামাতে পারলেই কেটে যাবে অমানিশা, দেখা মিলবে নতুন আলোর।

শেয়ার করুন: