ধর্ষণ বনাম পরিবার-শিক্ষক সমাজ:  ফিরিয়ে দিন বিশ্বাস

আসমা আক্তার সাথী:

কেউ কি আছেন বিশ্বস্ত পুরুষ, যাকে ভরসা করে পথ চলা যায়! কেউ কি আছেন এমন পুরুষ আত্মীয়, যার পাশে শরীরের সব উত্তাপ নিয়ে একই ছাদের নিচে বাস করা যায়? সমাজে কে আছেন এমন যার সাথে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে এই ভরসায় যে, আমার নিরুত্তাপহীন ছয় বছরের কন্যা সন্তানের দিকে হাত বাড়াবেন না?

আমি ছয় বছরের এক কন্যা শিশুর আতঙ্কিত মা সমাজের কাছে এই প্রশ্ন করছি। কে আছেন এমন, উত্তর দিন। আমার নিদ্রা, আহার, তন্দ্রা, হাসি খুশি, উচ্ছলতা, চঞ্চলতা সব হারিয়ে আমি এখন এক বিষাদগ্রস্ত মা। পৃথিবীর সব চিন্তা বাদ দিয়ে আমার মাথায় সারাবেলা কেবল ঘুর ঘুর করে মেয়ের নিরাপত্তা। কীভাবে, কেমন করে মেয়েকে সমাজের এই শরীরী থাবা থেকে দূরে রাখবো, আমার মাথা এবং মন সেই কৌশল রপ্ত করতে চায়।

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ বইয়ে ছোটবেলায় পড়েছি। সমাজের বাইরে, মানুষের কোলাহল থেকে বাইরে কোথাও বসবাসের কোনো সংকুলান কি হয়েছে? কারো জানা থাকলে জানাবেন, আমি আমার মেয়েকে নিয়ে সেখানে যাবো।

একজন মা প্রধানমন্ত্রীকে বলছি, সামাজিক অবক্ষয়ের এই সমাজে আমি বাস করতে চাই না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। অনুগ্রহ করে কিছু একটা করুন। রাষ্ট্রের সকল দায়ভার সরকারের, বোর্ড কতৃক নির্ধারিত সমাজ বইয়ে পড়েছি। সেই সূত্রে আপনার কাছে আশ্রয় চাওয়া ছাড়া আর কী করতে পারে একজন আতঙ্কিত, বিষন্ন মা।

এ কোন অজানায় পথ চলছি আমরা। যেখানে আমাদের শিশু কন্যা, কিশোরী, তরুণী, প্রতিবন্ধী কন্যা শিশুদেরকে ছিবড়ে খাচ্ছে একজন বাবা, একজন চাচা, মামা, ভাই, এমনকি সমাজ গড়ার কারিগর শিক্ষকেরাও! এক রাতে আমার মেয়ে খেলতে গিয়ে কনুইয়ে একটু ব্যথা পেয়েছে, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কোনরকম শুভ-অশুভ (গুড মর্নিং) বার্তা বিনিময় ছাড়াই তার প্রথম প্রশ্ন মা, আমার হাতের ব্যথা কখন সারবে? আমার সাথে সাথে মনে হলো কনুইয়ের এইটুকু ব্যথায় আমার মেয়ে এতোটা বিচলিত, তাহলে যে শিশুটির যোনি ছিঁড়ে এবড়ো-থেবড়ো করে দিচ্ছে বুড়ো জানোয়ারেরা, সেই আতঙ্কিত শিশুটির প্রশ্নের কী উত্তর দিচ্ছেন তার মা? আমি ভাবতেই পারি না। অবক্ষয়কে হার মানিয়ে এ কোন ভয়ঙ্কর পথে হাঁটছে সমাজ?

কেস স্টাডি ১: সম্প্রতি শরীয়তপুরের সখিপুর থানার সরদার কান্দি গ্রামের দরিদ্র পিতা-মাতার ক্লাস থ্রি পড়ুয়া মেয়ে লিজাকে ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা করে লাশ কৃষি জমিতে ফেলে দিয়েছে লিজার চাচা। আট দিন পর লিজার পচা গলা লাশ সনাক্ত করে তার বাবা-মা। এই আট দিনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী উদ্ধার করতে পারেনি লিজার লাশ। গ্রামের শিশুরা খেলতে গিয়ে লাশটি দেখতে পায়। গত ১৫ জুলাই মেয়েটি বিকালে ভাড়ায় সাইকেল চালানো শেষে আর বাড়ি ফিরতে পারেনি। নরপিশাচ চিরজীবনের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছে চঞ্চল একটি শিশু কন্যার সকল উচ্ছলতা। সেই সাথে কেড়ে নিয়েছে লিজার পরিবারের সব সুখ। লিজার চাচা সাইকেল চালানোর জন্য টাকা দিয়ে প্রলুব্ধ করেছিল লিজাকে। যেহেতু সমাজ পিশাচ, জানোয়ার, অসভ্য, মানুষরূপী অমানুষে ভরে গেছে সমাজ তাই বাবা-মায়েরা সতর্ক হোন। নিজের দুধের বাচ্চাকে কাউন্সিলিং করুন। আগলে রাখুন। আর তো কোনো উপায় দেখি না।

কেস স্টাডি ২: এই রমজান মাসের ঘটনা। দারোয়ানের দাওয়াত খাওয়াতে শিশু কন্যাকে রেডি করে মা পাঠালেন দারোয়ানের রুমে। আহ কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! এই হায়েনাদের যুগে এমন বেকুব মাও আছেন। এই মাকে আমি কোনভাবেই বলতে পারি না যে তিনি মানুষকে ভরসা করেছেন। এই মা সিম্পলি একজন বেকুব, বুদ্ধিহীন মা। যেখানে চারপাশে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটছে শিশু ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা। তাও নিকটাত্মীয়দের দ্বারা। সেখানে কেমন করে এই নারী তার শিশুকে একা দারোয়ানের রুমে পাঠাতে পারেন ইফতার খাওয়ার জন্য! আহা ইফতার পার্টি। আর হ্যাঁ এটাতো ঠিক ঘরে ঘরে গিয়ে এই বেকুব মায়েদের কাউন্সিলিং করবে কে?

কেস স্টাডি ৩: আরমান হোসেন সুমন নামে এক টিভি কর্মী তার সৎ মেয়েকে গত আট বছর ধরে ধর্ষণ করেছে। এই ঘটনার আদ্যোপান্ত সকলের জানা। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করেছে মেয়েটির মা। এ কেমন মা? মা নিজে যার সাথে বেড শেয়ার করছে, তার কাছে মেয়েকেও পাঠাচ্ছে। সুমনের আশ্রয়ের এতো প্রয়োজন ছিল এই নারীর! ধিক এই মাকে। কাউন্সেলিং প্রয়োজন মা-বাবাদের।  

কেস স্টাডি ৪: মানুষ গড়ার কারিগর মহান শিক্ষক। তাদের কাছ থেকেও নিস্তার নেই সন্তানদের। আলো (ছদ্মনাম) কলেজে পড়ার সময়ই টের পায় এক স্যারের যৌন হয়রানিমূলক আচরণ। তার ইশারা ইঙ্গিতে সাড়া না দেয়ায় আলোর প্রাকটিক্যাল খাতা সই না করে পরীক্ষার আগের দিন পর্যন্ত ঘুরিয়েছে। অধ্যক্ষ পরে সই করেন আলোর খাতায়। ইদানিং ভার্সিটি পড়ুয়া অনেক মায়ের কাছে শুনছি, মেয়ের শিক্ষকরা মাকে ফোন করে বলে আপনার মেয়ে তো ঠিকমতো ক্লাস করে না, পড়ে না, শুধু ঘুরে বেড়ায়। আমি বলেছি আমার কাছ থেকে নোট নিতে, তাও আসে না। পরে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবেন না। আহা কী কৌশল! শেয়ালের কাছে মুরগি রাখপাল দাও আর কী!

তা স্যার, আপনার যদি নোট দেয়ারই হয় তো ক্লাসে দিচ্ছেন না কেন? আর ক্লাসে, প্রাইভেটে স্নেহ করার অজুহাতে মেয়েদের পিঠে, গালে, মাথায় হাত দেয়ার প্রবণতা তো স্যারদের আছেই। কী যে এক ভয়াবহ সমস্যায় দিন পার করছি!

কেস স্টাডি ৫: অনেক আগের একটি ঘটনা। নব্বইয়ের দশকে তখন আমি ইডেন কলেজে একাদশ বা দ্বাদশের ছাত্রী। তখনকার শোনা একটি ঘটনা। যা আজ মহামারী আকারে আমাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। সে সময় ওই ঘটনা শুনে আমার হৃদকম্পন বেড়ে গিয়েছিল, আর আজ এক মেয়ের মা হয়ে এই ঘটনাগুলিই হৃদকম্পন প্রায় বন্ধ করে দিচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গার এক দরিদ্র পরিবার। যাদের শোবার জন্য মাত্র একটি ঘরই ছিল। তাদের ছিল দুই সন্তান । ১০ কী ১১ বছরের এক মেয়ে, আর সদ্য হ্ওয়া এক ছেলে। ঘরে ছিল একটি মাত্র চৌকি। নবজাতক বাচ্চার ঠাণ্ডা লাগবে বলে চৌকিতে মা নতুন শিশুকে নিয়ে ঘুমান, আর বাবা (আপন) মেয়েকে নিয়ে নিচে ঘুমায়। একদিন রাতে মা টের পায় মেয়ের গোঙানির শব্দ। ধড়ফড় করে উঠে হাতের কাছের দিয়াশলাই জ্বেলে দেখে এক হাতে মেয়ের মুখ চেপে ধরে রেখে নিজের ঔরসজাত কন্যাকে ধর্ষণ করছে বাবা।

একবার ভেবে দেখুন কী হতে পারে এই মায়ের দশা! তবে সাহসী সেই নারী মেয়েকে উদ্ধার করে থানায় গিয়েছিলেন। ছুটির পর বাড়ি থেকে ফিরে এসে আমার বান্ধবী আমাকে হস্টেলের গেস্ট রুমে বসে যখন এই ঘটনা বললো, তখন আর নিজেবে সামলে রাখতে পারিনি। বার বার আমার স্নেহপরায়ণ বাবার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আর মনে পড়ছিল ক্লাস টেনে পরার সময়্ও বাড়িতে বসে বাবার গলা ধরে ঘুমিয়েছি। দুপুরে বাবা ঘুম পাড়িয়ে দিতেন এবং আমি বাবার গায়ের উপরে পা না দিয়ে ঘুমাতেই পারতাম না। সেই ঘটনায় বিহ্বল হয়ে দুই বান্ধবী গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম অনেকক্ষণ। এখন তো অবস্থা এমন যে কাঁদতে হবে প্রতিদিনই!

তাই বলছি সতর্ক হতে হবে মাকেই। এক কথায় বাঘিনী হতে হবে মাকে। না রাষ্ট্র, না সমাজ, না পরিবার, কেউ দিতে পারবে না নিজ কন্যার নিরাপত্তা। শুধু একজন মা ছাড়া।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.