মা, বাবা নাকি বউ, কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

প্রিয়াঙ্কা দাস মিলা:

একটু আগে একটা গল্প পড়লাম, যেখানে একজন স্বামী তার মাকে খুশি করার জন্য স্ত্রী কে ডিভোর্স দেন, যদিও সেই ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসেন। আর অন্যদিকে স্ত্রীর কারণে নাকি ছেলেরা তার মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন!

আমাদের দেশের সবচেয়ে কমন সমস্যা হলো এটা, “মা-বাবা বড় নাকি স্ত্রী বড়”। এ ব্যাপারে একটা ছোট্ট প্রয়াস আমার এই লিখা।

মা-বাবা আর স্ত্রী সন্তান হলো দাড়িপাল্লার মতো আর খুঁটি হলো স্বামী বা বাবা। কোন একপাল্লা যদি ভারী হয় তাহলে কিন্তু খুঁটিটা নড়বড়ে হয়ে যায়।অনেকটা আমাদের শরীরের দুহাতের মতো, কোন একটা হাত কেটে ফেললে বেঁচে হয়তো থাকবো, কিন্তু সেটা কি আদৌ বেঁচে থাকা হবে? একজনের জন্য আমরা এই দুনিয়াতে এতোদূর এসেছি, আর অন্যজনের সাথে হাতে হাত রেখে বাকিটা পথ যেতে হবে। দুই হাত বা পাল্লাই সমান গুরুত্বপূর্ণ।

আমার বরের মা-বাবা খুব ছোটবেলাতেই মারা যান। একমাত্র দাদী (ঠাকুরমা) তাকে মা-বাবার আদর দিয়ে বড় করেন। বিয়ের পর প্রায় প্রতিটি সকাল আমার ঘুম ভাঙ্গতো আমার দাদী শাশুড়ি (ঠাকুরমা) আর আমার বরের ঝগড়া শুনে। সে এক বিশাল গ্যাঞ্জাম। ঠাকুরমা প্রায়ই বলতো,’ হ, এহন তো বড় হইয়া গেছো, … জোর বাড়ছে। থাকুম না, আমার বাড়ি যামু গা।” আমার বর ঝগড়া বাঁধলেই তাকে “বুড়ি”বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু তাকে (ঠাকুরমাকে) বুড়ি বলে ডাকার পারমিশন আমার ছিলো না। যদি ডেকেও থাকি আমার বর খুব রাগ করতো। একদিন ডেকে সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছে, ঠাকুরমাকে বুড়ি ডাকবা না।

আমিও বুঝে গেছিলাম। বিয়ের পর একদিন আমার বর আমাকে বলেছিলো, তোমাকে পছন্দ করে আমি বিয়ে করিনি, তোমার মা-বাবাকে দেখে আমি বিয়ে করেছি” ওই মুহূর্তে আমি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিলো, “এই ভদ্রলোক যদি আমাকে সারাজীবন ভালো নাও বাসে, তাকে আমি ভালোবাসবো”। কারণ সে আমার মা-বাবার মাঝে তার মা-বাবাকে খুঁজে নিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা বাঁধতো অন্য জায়গায়। যখনই আমার বরের সাথে আমার ঝগড়া বাঁধতো, ঠাকুরমা ছুটে এসে আমাকে বোঝাতে শুরু করতেন, আমাকে থামাতে চেষ্টা করতেন। ওনার জন্য আমি ঝগড়া করে আমার বরের সাথে পেরে উঠতাম না। আর এজন্য সব রাগ গিয়ে পড়তো ঠাকুরমার উপর। তখন রাগের মাথায় আমি তাকে অনেক কটু কথা শোনাতাম। কিন্তু ঠাকুরমা ঠিকই পরে এসে আমাকে আদর করে বুঝাতেন, “বাপ-মা মরা পোলা, একটু রাগ বেশি। ও যখন রাগ করবে তখন তুমি চুপ কইরা থাইকো”। সেটা কি আর সহ্য হয়! আমিও তাকে বলতাম, “ঠাকুরমা, আমরা যখন ঝগড়া করবো, আপনি তখন যাবেন না”।

কে শোনে কার কথা! সংসারে যখন শুধু স্বামী-স্ত্রী থাকে, তখন দেখা যায়, মারদাঙ্গা ঝগড়া করলেও রাগ পড়ে যাওয়ার পর মনে হয়, “ইশ!! এতো কথা না বললেও পারতাম। ঠিকই পায়ে পায়ে একজন আরেকজনের কাছে চলে আসে।” কিন্তু যখনই সাপোর্ট এর কেউ থাকে, যাকে সাপোর্ট করা হয় সে আর কম্প্রোমাইজ করতে চায় না। সে ধরেই নেয়, সে ঠিকই ছিল। যেমন কোন একদিন আমার আর আমার বরের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়ার সময় আমার ঠাকুরমা রাত সাড়ে বারোটায় আমার মা বাবাকে ডেকে নিয়ে আসেন। তখন আমাদের বাসা কাছাকাছিই ছিলো। আমি হয়তো এই ঝগড়ার কথা মা-বাবাকে জানাতামই না। ব্যাপার হলো, আমার মা-বাবা স্বাভাবিকভাবেই আমাকে সাপোর্ট করবেন। সেক্ষেত্রে আমার জোর বেড়ে যাবে। আর যদি বরের সাপোর্ট করেন, তাহলে বরের জোর বেড়ে যাবে। আর ওই যে, পায়ে পায়ে একজন আরেকজনের কাছে এগিয়ে আসা, দুজনের কম্প্রোমাইজ, সেটা আর হয় না।

আমার মা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা, ছোট বোন আর আমরা একসাথে থাকা শুরু করলাম। আমি জানতাম, যেহেতু একসাথে থাকা শুরু করেছি, কেওয়াজ হবেই। আমাকে স্ট্রং হয়ে সামলাতে হবে। আমি ভাঙ্গলে চলবে না। আমাকে হতে হবে দাড়িপাল্লার খুঁটি। তো, কোন একদিন আমার বরের সাথে আমার তুমুল ঝগড়া। এর মধ্যে আমার বাবা এসে আমার বরকে বকাঝকা শুরু করলেন। আমার বরও রেগে চার-পাঁচ কথা তাকে শুনিয়ে দিলেন। আমার বাবা ডিসিশন নিলেন, আমার বাসায় থাকবেন না। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমার বরও তাকে যেতে দেননি, আর আমার বাবাও ভাবছিলেন, তিনি চলে গেলে তার নাতি-নাতনিদের কে দেখবেন!

সন্তান হিসেবে আমার বাবার কথা বলেন, আর আমার বরের ঠাকুরমার কথা বলেন, দুজনকে দেখে রাখার দায়িত্বই কিন্তু আমাদের দুজনের। কিন্তু আমার দায়িত্ব বরের উপর চাপিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চয়ই তাকে দোষারোপ করতে পারি না। আমার এবসেন্সে আমার বাবাকে ভাত বেড়ে খাওয়ানো, চা বানিয়ে দেয়া এসব আমার বর প্রায়ই করেন। আর আমি কখনোই ঠাকুরমাকে “বুড়ি” ডাকার সাহস করিনি। আমি জানি সেটা আমার বর পছন্দ করবেন না।

আমি কি আমার বরকে ভয় পেতাম? অবশ্যই না। বরং আমি তার জন্য ফিদা ছিলাম। স্কুলের হেডস্যার বা প্রিন্সিপাল এর কথা মনে আছে? আমরা কিন্তু তাকে ভয় পেতাম। আতংকিত ভয় নয় সেটা। শ্রদ্ধার ভয়। সে একজন সম্মানিত ব্যক্তি। সেই ভয়ের মধ্যে শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোবাসা থাকতো। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাও এমন। এই সম্পর্কে শ্রদ্ধা থাকবে, ভালোবাসা থাকবে, ভয়ও থাকবে। সর্বোপরি একজন আরেকজনকে সম্মান করবো, তাকে জড়িত সমস্ত সম্পর্কগুলোর উপর সম্মান থাকবে এবং সেটা আমাদের অর্জন করতে হবে। আর সম্মান দিলেই কেবলমাত্র সম্মান পাওয়া যায়।

আমাদের দেশে কানপড়া দেয়ার মতো মানুষের অভাব নাই। অনেকেই ঠাকুমাকে (বরের দাদী) বলতেন, “তোমার নাতবউ তো শিক্ষিত, তোমারে রাইন্ধ্যা খাওয়াইবো না”। ঠাকুরমা হেসে বলতেন, হেরা সুখে থাকলেই হইবো, আমারে খাওয়ানো লাগবো না”।

আর যদি বরের চেয়ে বউয়ের যোগ্যতা বেশি বা কোনকিছুর এক্সট্রা এচিভমেন্ট হয়, তাহলে তাদের ঘরের লোকজনের যতটা না মাথাব্যথা বা মন খারাপ থাকে, তার চেয়ে শতগুণ বেশি থাকে কিছু কানপড়া দেয়া লোকের। আমার স্কুটি শেখার ব্যাপারে আমার বরের সাথে সাথে অনেকেই আমাকে উৎসাহিত করেছেন, শিখিয়েছেন, হেল্প করেছেন। তাদেরকে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু এই ব্যাপারটা যাদের চোখে কাঁটার মতো বিঁধেছে তারাই প্রায়ই আমার বরকে নানাবিধ মন্তব্যে জর্জরিত করেন।

যেমন, দেইখেন, পিছনে আবার অন্য কাউকে নিয়ে ঘোরে না যেন! সামলায়ে রাইখেন, নাইলে কিন্তু বেশিদিন টিকবে না; আপনার বউ আপনার চেয়ে বেশি স্মার্ট! কেউ কেউ আবার আমাকে এমনভাবে বলেন, “আপনার বর অনেক ভালোমানুষ, অনেক শান্তশিষ্ট, আপনাকে দেখেই বোঝা যায়! নাহলে আপনি “এসব” করতে পারতেন না” নিজেকে লিটারেলি ‘রাক্ষসী’ মনে হয় তখন!

একদিন আমার এক আত্মীয় হন্তদন্ত করে আমাদের বাসায় এসে হাজির। উনি চলে যাওয়ার পর বর বললো, “কোন এক ব্যাংকের কোন এক ম্যানেজারের বউ তার প্রেমিকের সাথে পালিয়েছেন। সেই আত্মীয় এই খবর আমার বরকে জানিয়েছেন, কারণ সেই ভদ্রলোক আর তার পরিবার চাকরির সুবাদে ভিন্ন জায়গায় থাকতেন। আমার বর যেন আমাকে সামলিয়ে রাখেন”! বোঝেন ঠ্যালা! এই যে মানুষ বিভিন্ন মন্তব্য বিভিন্নভাবে রসিয়ে রসিয়ে করেন, এদের কাজই অন্যের সংসারে আগুন লাগিয়ে তাতে আলু পোড়া দিয়ে খাওয়া।

মা-বাবা/ঠাকুমা’রা হলেন বটগাছের মতো। তারা ছায়া দিয়ে যাবেন আজীবন। কিন্তু সেই বটগাছের গোড়ায় পানি দেয়ার দায়িত্ব কিন্তু বটগাছের মালিকের। হ্যাঁ, মালিকের বউ বা স্বামীও অবশ্যই দিবেন পানি এবং যত্ন করেই দিবেন, আর সেই অবস্থান তৈরি করবেন কে? ছেলে যদি মা-বাবা বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে একসাথে থাকে, তাহলে সমস্ত প্রশংসা ছেলের নামে আর যদি বউ বাচ্চা নিয়ে আলাদা সংসার করে তাহলে দোষ হয় বউয়ের! অর্থাৎ মেয়ের জামাই যদি মেয়ের কথা শোনে, তাহলে জামাই খুবই ভালো মানুষ, আর ছেলে যদি বউয়ের কথা শোনে, তাহলে বউ ছেলের মাথা খায়! কেন? এটা হচ্ছে আমাদের মনমানসিকতা।

যেকোনো কাজ করার জন্য যেমন অভিজ্ঞতার দরকার আছে, তেমনি সব অভিজ্ঞতা কিন্তু পড়ালেখা করে পাওয়া যায় না। কিছু অভিজ্ঞতা প্রাকটিক্যাল কাজ করেও অর্জন করতে হয়। সংসারটা এমনই এক জায়গা। সবার অভিজ্ঞতা একরকম হয় না। একেকটা মানুষ একেক রকম অভিজ্ঞতা। একেকরকম অংক, একেক রকম রুলস। সবার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। এজন্য স্বামী-স্ত্রীর কোন ব্যাপারে কোনরকম পরামর্শ না দেয়াই ভালো সে মেয়ের মা হোক কিংবা ছেলের বাবা।

অনেক তো আপনারা (বর বা কনের মা বাবা) পরিশ্রম করলেন। সংসারের দায়িত্ব সামলালেন। এবার নতুন দম্পতিদের উপর সব ছেড়েছুঁড়ে নিজেদের বাকি জীবনটা উপভোগ করুন। ঘোরাঘুরি করুন, আড্ডা দিন, নতুন দম্পতিদের সংসার সামলাতে সাহায্য করুন। তাদের দায়িত্ব তাদের মতো করে সামলাতে দিন। তাদের সিদ্ধান্ত তাদেরকেই নিতে দিন, সেটা দুপুরে কী রান্না হবে থেকে শুরু করে বাচ্চা কবে নেয়া পর্যন্ত, যাই হোক না কেন! নতুন দম্পতিরা নিজেরা প্রচুর সময় দিন নিজেদের সম্পর্ককে। কিছুদিন পরই এমন একটা সময় আসবে তখন আর চাইলেই নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব কমাতে পারবেন না। এখন যত পারেন মধুর স্মৃতি তৈরি করুন, যেটা কিনা বৃদ্ধ বয়সের পাথেয়।

শেয়ার করুন: