রোকসানা বিন্তী:
মুঘল রাজবংশের চতুর্থ বাদশাহ, সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিশতম স্ত্রী হয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। তার এই ইতিহাসে জায়গা করে নেয়াটা খুবই অদ্ভুত। কারণ রাজনৈতিক কারণেই হোক বা নিজেদের লুচ্চামির কারণেই হোক, মুঘল বাদশাহগণ গণ্ডা গণ্ডা বিয়ে তো করতেনই, সেই সাথে বাদী-রক্ষিতাদের দিয়েও হারেম ভর্তি করে রাখতেন। সম্রাটদের এমন স্ত্রীও থাকতো যে কিনা তার সমস্ত জীবনে মাত্র একবার তার স্বামীর সাথে একান্তে সময় কাটাতে পেরেছেন! অথচ নূরজাহান সম্রাট জাহাঙ্গীরকে এতোটাই সম্মোহন করে ফেলেছিলেন যে বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য তার অঙুলিহেলনে পরিচালিত হতো। যে হারেমে নারীরা চরম অসম্মানের সাথে বসবাস করতেন সেখানে থেকে তিনি কিভাবে পারলেন এতোটা সম্ভ্রম আদায় করে নিতে? সৌন্দর্য তো অবশ্যই, সেইসাথে আছে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, ভবিষ্যতে কী হবে তা বোঝার ক্ষমতা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা, প্রবল ব্যক্তিত্ব, অসীম সাহসিকতা ইত্যাদি গুণাবলী।
এর ফলে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরকে সেইসাথে সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন! তিনি নিজে তো ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেনই, সাথে সাথে নিজের বাবা ও ভাইকেও দরবারের উচ্চ পদে আসীন করেছিলেন। তার বাবা গিয়াস বেগ, যার উপাধি ছিল ইতিমাদ-উদ-দৌলা, প্রচুর ধন সম্পত্তির মালিক ছিলেন। মুঘল আইনে কোন ব্যক্তি মারা যাবার পর তার সম্পত্তির মালিক হয়ে যান সম্রাট তাই ইতি-মাদ-দৌলা মারা যাবার পর এই বিপুল সম্পত্তি পেয়ে যান সম্রাট জাহাঙ্গীর যা তিনি পরবর্তীতে সম্রাজ্ঞী নূরজাহানকে দিয়ে দেন। নূরজাহান হয়ে উঠেন তৎকালীন মুঘল সাম্রাজ্য এর অন্যতম সম্পদশালী ব্যক্তিত্বে। তিনি তার বাবা-মায়ের কবরের উপর একটি সৌধ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রচলিত মুঘল নির্মাণশৈলীর সাথে পারস্য ও তুরস্কের স্থাপত্যের মেলবন্ধন ঘটাতে সমর্থ হোন। মুঘল স্থাপত্যে তিনিই প্রথম সাদা মার্বেল পাথর ব্যবহার করেন যা অনুকরণ করে পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান তাজমহল তৈরি করেন একই পাথর দিয়ে।
যদিও নূরজাহানের দুর্ভাগ্য যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর তার সব ক্ষমতা শেষ হয়ে যায় এবং পরবর্তী সম্রাট শাহজাহান তাকে লাহোরে এক প্রকার নির্বাসনে পাঠান। ফলে তিনি তার পরিকল্পনা মতো সমাধি সৌধটি নির্মাণ শেষ করতে পারেননি এমনকি নির্মাণের পর তা একবার দেখতে আসাও তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু নজরবন্দী থেকেই সাম্রাজ্যের খবরাখবর তিনি রাখতেন। সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল তৈরির বর্ননা শুনে সম্রাজ্ঞী নিশ্চয়ই বিমলানন্দ ভোগ করেছিলেন কেননা তাজমহল এবং ‘টুম্ব অব ইতি-মাদ-দৌলা’ যা কিনা ‘বেবি তাজ’ বলে পরিচিত, দুটোর নির্মাণশৈলীতে প্রভূত মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নূরজাহান তার নিজের সমাধি নিজেই তৈরি করেন যদিও ক্ষমতাহীন অবস্থায় তাতে অতটা জাঁকজমক দেখাতে পারেননি। তিনি কোনো এক মাধ্যমে শাহজাহানকে বলেছিলেন যে, স্ত্রীর পাশাপাশি নিজের সমাধিও তৈরি করে রাখতে কেননা মৃত্যুর পর আর তার জন্য চিরস্থায়ী সমাধি তৈরি করার মতো কেউ নাও থাকতে পারে। এবং সত্যিই তাই ঘটে! নিজের জন্য সম্রাট শাহজাহান কালো তাজমহল তৈরি করতে চাইলেও তা তিনি আর করতে পারেননি। পুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে দশ বছর গৃহবন্দী থেকে মৃত্যুবরণ করেন। ঠিক যেমন করে তিনি সম্রাজ্ঞী নূরজাহানকে বন্দী করে রেখেছিলেন।
মুঘল সাম্রাজ্য এর হারেমের মেয়েরা যখন একপ্রকার অদৃশ্য অবস্থায় দিন যাপন করতো সেই সময় সম্রাজ্ঞী নূরজাহান রাজ্য পরিচালনা, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য, রাজ্য বিস্তার, অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ আরও নানাবিধ কাজে ব্যস্ত থাকতেন। সেইসাথে হারেমেও নিয়ন্ত্রণ করতেন। কোন জাদুতে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরকে সম্মোহন করতে পেরেছিলেন তা আজ আর জানার উপায় নেই, কিন্তু তিনি যে যোগ্যতা ও দূরদর্শিতার সাথে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তার আগে এবং পরে আর কোন সম্রাজ্ঞী এতোটা ক্ষমতা লাভ করতে পারেননি। যদিও তাজমহলের সুবাদে মমতাজ মহল অমর হয়ে আছেন কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের সত্যিকারের ক্ষমতাশালী সম্রাজ্ঞী ছিলেন একজনই!
নূরজাহান!
লেখক:
উপ-পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক