পতাকা- সে তো আমারই সন্তান

Flag 2সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: এতোটা স্বচ্ছ হতে নেই! জানতো আয়নার উল্টোদিকে নিকেল আছে বলেই তাতে নিজের চেহারা দেখা যায়! তুমি এতো স্বচ্ছ যে তোমার গায়ে কিছুই প্রতিফলিত হয় না! সবটুকু আলো এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। যে বুঝতে পারে সে ধরতে পারে তোমায়। যে পারে না, সে সারাজীবন খুঁজেও কোন হদিস পায় না। এই বুঝতে পারা মানুষের সংখ্যা সমাজে খুবই কম। বরং তোমাকে খুঁজতে গিয়ে তারা নিজের শরীরে নিজেই ধাক্কা খায়। তবুও বলি এতো স্বচ্ছ হইও না। রোজী আপা (ছদ্মনাম) আমাকে সতর্ক করতে করতে এভাবে বলেন প্রায়ই।

রোজী আপাকে বলি, শুধু আপনার কাছে আমি হয়তো স্বচ্ছ কাঁচ। অন্য কারো কাছে নয়, আপা! অন্যরা হয়তো আমারও উল্টোদিকে নিকেল পেয়ে আমার মাঝে নিজের চেহারা দেখে। তারা নিজের নিজের মতো করে বিশ্লেষণও করে। কারো দেখায় হিংসে থাকে, কারো দেখায় লোভ থাকে, কেউবা সন্দেহের চোখে দেখে, কারো দৃষ্টি ঘৃণার, কারো আবার অযোগ্যতারও। তাদের এই ভিন্ন ভিন্ন ‍দেখায় আমার কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাই আমি আমার মতোই থেকে যাই।

ছোটবেলা থেকে আমার মা-বাবা বলতেন ডানপিটে। পাড়া-পড়শিরা বলতেন চলনে-বলনে মর্দাঙ্গীপনা। বন্ধুরা বলতো, ‘তুই খুব ভাল বন্ধু হতে পারিস, কারো বউ হওয়ার যোগ্যতা তোর নেই!’ ছেলেমেয়েরা বলে আসলে আমি ভাল মা হতে পারিনি। তাদের সবার দেখা নিজের নিজের চোখে! ভুলও হয়তো তারা বলে না। আমি নিজে কি জানি আমি কি বা কেমন?

রোজী আপা, আপনাকে আমার জীবনের প্রতিটি পাতা খুলে খুলে পড়িয়েছি। আমার যাপিত জীবনের নামকরণ করতে যে কত কতদিন আপনার সাথে আলাপ করেছি। তারপর ভুমিকা, পরিচ্ছেদ রোজ-রোজকার প্রতিটি নিঃশ্বাস-দীর্ঘশ্বাস পাতায় পাতায় এগিয়ে চলা উপন্যাস। জীবনের চাওয়া-পাওয়া, হিসেব-নিকেশ, পাপ-পূণ্য কোনটা কি বাদ পড়েছে তাতে? কোন কোন দিন তো পঙ্ক্তি সাজাতে যথার্থ শব্দ ও বাক্যের রতি এগিয়েছে, থেমেছে আপনার সাথে শলা করে করে। যবনিকাও একদিন আপনাকে জানিয়েই টেনে দেব বলে কথা দিয়ে রেখেছি।

পাগলী, সে সময় কি তোমাকে আমি দেব ভেবেছ? এত এত কথা বলে সময় দিয়ে যাচ্ছি, শুনে শুনেও সময় দিচ্ছি। কিন্তু তুমি শুনে রাখ আর একবার, তোমার যবনিকা লেখার সময় আমি কোনভাবেই তোমার পাশে থাকতে পারব না। তুমি বরং সেটা নিজের মতো করেই লিখে নিও। আমি চাই সেটাও খুব স্বচ্ছ হবে! একেবারেই নির্জলা। ঠিক আজকের এই তোমার মতো। বলতে বলতে কিছুটা স্বার্থপর লাগে রোজি আপাকে।

আমি বুঝতে পারি কেন তিনি আমাকে এই সময়টা দিতে নারাজ। বয়সকে হিসেব করে তিনি সময়কে আগে পিছে হিসেব করে ফেলেছেন। যখন আমার জন্মের গল্প শুরু, তখন তিনি ছিলেন ২০ এর মতো। স্বামী চাকুরী করতেন বলে যুদ্ধের সময় দুই সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে ছিলেন। মূলতঃ তারও জীবনের উপন্যাস তখন থেকেই। হয়তো তাই বয়সের এতো ব্যবধানেও গল্প ও উপন্যাসের পথচলা একই পথে। আমাদেরও তাই হয়তো এতটা কাছে আসা।

কবে থেকে রোজী আপা আমাকে এতোটা আপন করে নিয়েছে মনে পড়ে না। ছোটবেলায় যখন তার বাসায় গিয়েছি দেখেছি তিনি নিজে খুব ছটপট করতেন যেন অকারণ। বিড়বিড় করতেন সবসময়। দিনে কয়েকবার গোসল করতেন। সারাক্ষণ হাত ধুতেন। দেখে দেখে খুব বিরক্ত লাগতো আমার। কিন্তু কখনও কখনও আমাকে প্রচণ্ডভাবে জড়িয়ে বুকের সাথে পিষে ফেলতে চাইতেন। এসময় তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠতো। এক অদ্ভুত আপনাপন অনুভব করতাম তার বুকের উষ্ণতায়। কোথায় যেন একটা মিলও খুঁজে নিতাম।

মা-ফুপুর কাছে শুনতাম রোজী আপা বেশ পড়ালেখা জানতেন। পরে জেনেছি মেট্রিক পাশ করা ছিল তার। মা-ফুপুদের সে সুযোগ ছিল না। তাই আন্ডার মেট্রিকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। রোজী আপা নারায়ণগঞ্জে মামার বাসায় থেকে পড়েছেন। একটা ভাল চাকুরীও হয়েছিল। কিন্তু তিনি স্বামীর চাকুরীর জন্য নিজে চাকুরী না করে সংসারের দায় নেন। সংসার বলতে দুই সন্তানের মা হওয়া ছাড়া স্বাধীনতাত্তোর উত্তাল হাওয়ায় তেমন কিছুই ভাবা  শুরু হয়নি তখনও। একজন দুই বছর ও একজন চার মাসের শিশু পুত্রকে নিয়ে একটু নিরাপদ হবে ভেবে বাবার বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন স্বামী। তিনি আর ফেরেননি। রোজী আপারও আর সংসার করা হয়নি। বাবার সংসার থেকে পরে ভাইয়ের সংসারে জীবন জীবনের নিয়মেই এগিয়েছে। ছেলেরা বড় হয়েছে। তাদের সংসার হয়েছে। নাতি-নাতনিও হয়েছে রোজী আপার।

এখন এতো এতো পরিচয় তার! তবুও রোজী আপার কোন একটা পরিচয় আজও দেয়া হয়নি কাউকে। যে পরিচয়ের উত্তাপ তাকে প্রতিদিন পুড়ে পুড়ে ভস্ম করে। রাত ভোরে দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে গেলে মাথার চুল ভিজে যায় অহংকারের ঘামে। রোজী আপাকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে সেই পরিচয়। কিন্তু আজো বলা হয় না। তার কণ্ঠ বুজে আসে। তিনি ছটফট করেন। বিড়বিড় করেন। গায়ে পানি ঢালেন। হাত ধুতে থাকেন। বলা হয় না কিছুই।

যে পরিচয় তাকে আজও পোড়ায়, যে অহংকার তাকে নিত্য ঘামের প্লাবনে ভাসায় সে গৌরব ৪৩ বছর ধরে তিনি বুকের মাঝে কবর দিয়ে রেখেছেন। এই লাল-সবুজের পতাকাটার অনেকটা অংশীদার যে তিনি নিজে। বলেন, বিজয়ের মাস এলে পত পত করে ওড়া লাল সবুজের পতাকার দিকে তাকিযে মনে হয়েছে এই তো আমার অহম, এইতো আমার গৌরব! সবার ওপরে কতটা স্পষ্ট, কতটা স্বাধীনতা নিয়ে ওড়ে পতাকা। আবার নিজের দিকে চোখ ফেরালে ভয় পাই। কষ্ট লুকানোর নিকেল জমে জমে যে নিজের ছবি ফুটিয়ে ওঠে চেহারায়, যে ঘটনার বর্ণনা আমি কোনদিন কাউকে দেই নি।শুধু তুমি জান আমার প্রতিটি র্দীঘশ্বাসের গভীরতা কতখানি।

শোনো, আমার কখনও বিজয় উদযাপন করা হয়নি। তুমি একবার আমাকে নিয়ে যাবে কোন বিজয় উদযাপন মঞ্চে? আমি কিছুই বলব না সেখানে। শুধু দেখব, এত বিসর্জনের বিনিময়ে পাওয়া এই পতাকার ভার কিভাবে বইছে দেশ! পারলে তুমি আমাকে একটা পতাকা এনে দিও। খুব গোপনে। আমি কিছুক্ষণ পতাকাটি জড়িয়ে ধরে থাকব শরীরের সাথে। কেউ না জানলেও শুধু পতাকাটিই জানুক, এই পতাকাটিই আমার সন্তান। যাকে আমি জন্ম দিয়েছি কত কত ত্যাগে!

(রোজী আপা যতটুকু অনুমতি দিয়েছেন লিখতে)

সাংবাদিক ও লেখক

শেয়ার করুন: