প্রথার ভাঙ্গন নয়, চাই শুদ্ধিকরণ

Laili
সালেহা ইয়াসমীন লাইলী

সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: ছোটবেলায় নানীর সাথে গ্রামে তার বাবা বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি একটা গ্রাম। যার পাশ দিয়ে তোর্শা নদী ধরলা নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে প্রত্যন্ত এলাকায়। তখন তো কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর টহল চৌকি ও মাঝে মাঝে ক্যাম্পগুলো ছিল। টহলদারদের বলে কয়ে এপার-ওপার হওয়া যেত। আমরা যেতামও অকারণ।

অনেক হিন্দু বাড়ির মাঝে নানীর বাবা বাড়ি। বাবার গ্রামে নানীকে অনেক সমীহ করতো সবাই। হিন্দু বাড়ির বউয়েরা দেখতে আসতেন। সে সময় চিকন পাড়ের এক রঙা শাড়ী পরতেন বউ ও ঝিয়েরা। বয়স্ক ও বিধবা নারীরা পরতেন সাদা থান বা ধুতি। ব্লাউজ ও পেডিকোট পরার তেমন চল ছিল না সে গ্রামে। যারা পরতেন কোন অনুষ্ঠানাদি বা বেড়াতে যাওয়ার সময়। অন্য সময় শুধু শাড়িটা বিশেষ ঢংয়ে পেঁচিয়ে রাখতেন শরীরে। কিন্তু বিবাহিত নারীরা সবাই পরিপাটি করে তিনবেলা সিঁদুর পরতেন। হিন্দু বাড়ির বউয়েরা লাল রঙের সিঁদুর ও শাখা, মুসলিম বাড়ির বউয়েরা হালকা কমলা রঙের সিঁদুর। বিয়ের সময় বউয়ের নাকে বর পক্ষের দেয়া নাকফুল পরিয়ে দেয়া হতো। শুধু মৃত্যুর পরই এই নাকফুল খোলা যাবে। তার আগে এই নাকফুল হারিয়ে গেলে বা ভেঙ্গে গেলে স্বামীর অমঙ্গল হবে। কোন নারীর স্বামী মারা গেলে, মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে শত শোকে সবার আগে তার শরীরের গয়না খুলে নেয়া হতো। নাকফুল খোলা দিয়ে শুরু হতো তার শোকযজ্ঞ। সবাই শেষে বিধবার শরীরে লাশের মতো করে সাদা থান জড়িয়ে দেয়া হতো। মুসলিম বিধবারা তার জীবদ্দশায় চুলে তেল-চিরুনি দিতে পারবেন না। হিন্দুরা এক্ষেত্রে আরও একটু এগিয়ে থাকতো। হিন্দু বিধবাদের মাথার চুল ন্যাড়া করে দেয়া হতো। কখনই আমিষ খেতে দেয়া হতো না। নারীদের অবিবাহিত, বিবাহিত ও বিধবা এই তিন রুপ তার শরীরে বহন করতে হতো।

কিন্তু পুরুষদের বেলায় কোন অবস্থা প্রমাণের দরকার হতো না। তারা একই অবস্থায় থাকেন সব সময়। তাদের বিবাহিত, অবিবাহিত বা  বিপত্নীকেও কিছু আসে যায় না। তাদের শরীরেও কোন চিহ্ন বহনের দরকার হয় না, চলনে-বলনে আহার গ্রহণে পুরুষের কখনই কোন ব্যতিক্রম দরকার পড়ে না।

পুরুষদের আজও সেই অবস্থা চলে আসছে। তবে বিশ্বায়নের এই যুগে নারীদের পোষাকে চলনে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আজকাল শাড়ি পরার বাধ্যবাধকতা নাই বললেই চলে। প্রত্যন্ত গ্রামের মেটো পথে চলা কোন নারীকেও শাড়ি পরিহিতা পাওয়া যায় না। সকল বয়সের, সকল রূপের নারীই আজ ইচ্ছেমতো পোষাক পরে। এমনকি বিয়ের সাজেও আজকাল শাড়ির বদলে ভিন্ন ধাঁচের পোষাক পরা হচ্ছে। শিক্ষিত পরিবারের বিধবারা এখন গয়না ও রঙিন পোশাক পরে। এই বদলে যাওয়া কিন্তু প্রয়োজনেই হয়েছে।

একটা সময় ছিল যখন বিবাহিত মেয়ে মানেই তাকে শাড়ি পরতেই হতো! যত কম বয়সেই বিয়ে হোক না কেন, সংসার সামলানোর চেয়ে তার শাড়ি সামলানো দুষ্কর হয়ে যেত। তবুও বিবাহিত বলে কথা। বিবাহিত পুরুষদের তো কোন বিশেষ ইউনিফর্ম নাই। তবে মেয়েদের কেন?

কিন্তু নামের পরিচয়ে এখনও আগের মতোই রয়ে গেছে। অবিবাহিত হলে মিস, বিবাহিত হলে মিসেস, স্থানভেদে বিধবাদের জন্য নামের শেষে বাংলায় ‘বেওয়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মিস ও মিসেস বিপরীতে পুরুষদের ‘মিস্টার’ নামটি থেকে যায়।

কিছুদিন আগে বন্যাদুর্গতদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। সবাই প্রায় বয়ো:বৃদ্ধ নারী-পুরুষ। তালিকা আগেই করা ছিল স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে। বিতরণের সময় প্রায় প্রত্যেকেটি নারীর নামের সাথে ‘বেওয়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ২/৪ জনকে খাতুন বা বেগম বলে ডাকছে।

 আমি চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাইলাম বেওয়া বলতে আপনার কি বোঝাচ্ছেন? জবাবে তিনি বললেন বিধবাদের বেওয়া বলা হয়। আমি চেয়ারম্যানকে বললাম, এই বৃদ্ধদের মধ্যে কোন বিপত্নীক নাই? তিনি বলতেন, অনেকেই আছে। তবে তাদের ‘বিপত্নীক’ বলা হচ্ছে না কেন?

তিনি বললেন, বেওয়া শব্দের কোন পুংলিঙ্গ নাই। আর ‘বিপত্নীক’ শব্দটি ব্যবহারিক নয়, স্থায়ীও নয়। মানে পুরুষ কখনও বিপত্নীক হয় না। হলেও তার কোন নামের দরকার পড়ে না।

সেদিন এক সিনিয়র সাংবাদিক যোগাযোগের জন্য আমাকে নামের আগে ‘মিস’ লিখবেন না ‘মিসেস’ এটা জানতে চাওয়ার জবাবে আমি বললাম, শুধু নামটি লেখেন। তার হয়তো কৌতুহলটা অন্য জায়গায় ছিল। যার জন্য তিনি আবারো বললেন তবুও—–। কিছুটা বিরক্ত হয়ে আমি বললাম, মিজ লেখেন। তিনি শব্দটি প্রথম শুনেছেন বলে অর্থ জানতে চাইলেন।

বললাম, মিজ মিস্টারের মতোই একটি শব্দ যার কোন রুপান্তর নেই। শুনে তিনি কিছুটা বিস্মিত হয়ে গেলেন। যেন অসম্ভব কিছু বলে ফেলেছি!

পৃথিবীর কক্ষ পথ কি উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছি? না তো। পুরুষদের গর্ভধারণের দাবী জানিয়েছি? তাও তো না। কি এমন ভেবে তিনি আমার সাহসিকতার প্রশংসা করলেন! আমি কিন্তু তার এমন প্রশংসায় খুশি না হয়ে হতাশই হলাম।

একইভাবে কথাটি অন্য একদিন উপস্থাপন করায় এক সরকারী আমলা আমার উপর চটে গিয়েছিলেন। চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে বলেছিলেন, এভাবে কি প্রথা ভাঙ্গতে পারবেন? বলেছিলাম, আপনাদের সহায়তা পেলে বৈষম্যহীন মানবতা প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করা সহজ হতো। যে প্রথায় হীনতা আছে, দীনতা আছে তাকে বদলালে সমাজ এগুবে। ভাঙ্গতে না পারি, শুদ্ধিকরণ তো করাই যায়! তিনি আমাকে উঠে যেতে বলতে পারেননি ঠিকই, তবে নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেছেন।

শুনেছি তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘এমন বিদ্রোহী মেয়েরা সমাজের জন্য হিতকর নয়, যারা প্রথা ভাঙ্গতে চায়।’

এক সময় হয়তো বিশ্বজুড়ে নারী-পুরুষের পোষাক একই রকমের হবে। নামের আগে রূপক কোন শব্দ থাকবে না। যা হবে সময়ের প্রয়োজনে। তাতে হয়তো প্রথা নড়েচড়ে বসবে। সেটাই হবে সে সময়ের প্রথা।

লেখক ও সাংবাদিক

শেয়ার করুন: